মালদ্বীপের সংবিধান মোতাবেক দেশটির নাগরিক হতে হলে মুসলিম হওয়া আবশ্যক। ফলে অমুসলিম কোনো নাগরিক সেখানে পাওয়া যায় না। ইতিহাসের তথ্য মতে, আরব নাবিক-বণিকদের হাত ধরেই মালদ্বীপে সর্বপ্রথম ইসলামের আগমন। (মান আদখালাল ইসলাম লিল মালদ্বীপ, আল-জাজিরাডটনেট : ২৩/০৫/২০১৯)। এর সাথে জড়িয়ে আছে এক উপকথা।
মালদ্বীপের এক উপকথা অনুযায়ী, রান্নামারি হচ্ছে এক সামুদ্রিক দানব। এক হাজার বছর আগে এই দানবের উৎপাত শুরু হয়। রাতের বেলা এই দানব সমুদ্রের তলদেশ থেকে উঠে এসে মালদ্বীপের রাজধানী মালের লোকালয়ে পা রাখত, তারপর ধ্বংসযজ্ঞ চালাতো।
এই দানব মূল লোকালয়ের কুমারী নারীদের হত্যা করতো। মাসের পর মাস এই দানবের আক্রমণে মালদ্বীপের সমাজে নারীদের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমতে শুরু করে। যেসব পরিবারে কুমারী নারী ছিল, সেসব পরিবার রাত হতেই চরম আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়তো।
মালদ্বীপের তৎকালীন রাজা চিন্তায় পড়ে যান। এই দানবের হাত থেকে কীভাবে মালদ্বীপের সমাজকে রক্ষা করা যায়, তা নিয়ে তার সভাসদদের নিয়ে আলোচনায় বসেন। সবার সঙ্গে পরামর্শের পর রাজা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, রাজধানী মালে থেকে কাছে সমুদ্রতীরে একটি মন্দির তৈরি করা হবে, যে মন্দিরের ভেতরে প্রতি দুই সপ্তাহ পর পর একজন কুমারী নারীকে রেখে আসা হবে।
সাধারণত যে কুমারী নারীকে মন্দিরে রেখে আসা হবে, তাকে রাতের বেলা একেবারে সাজিয়ে নিয়ে যাওয়া হতো মন্দিরের কাছে, এরপর মন্দিরের ভেতরে তাকে শক্ত করে বেঁধে রেখে আসা হতো। পরদিন ভোরবেলা গিয়ে সেই কুমারী নারীর পরিবারের সদস্যরা গিয়ে তার প্রাণহীন দেহ বহন করে নিয়ে আসত, এবং সৎকারের আয়োজন করতো।
মালদ্বীপের সমাজে যেসব পরিবারের কুমারীদের রান্নামারি দানবের উদ্দেশ্য উৎসর্গ করা হতো, সেই পরিবারগুলো সমাজে বিশেষ মর্যাদা অর্জন করতো।
কিন্তু রান্নামারি বলতে কিছুই ছিল না, বরং মালদ্বীপের তৎকালীন রাজা ছিলেন একজন বিকৃত মস্তিষ্ক, ও চরম নারীলিপ্সু ব্যক্তি। রান্নামারি দানবের অন্তরালে তিনিই সেই মন্দিরে গিয়ে সারারাত ধরে কুমারী নারীদের ভোগ করতেন।
এরপর তার ভোগকর্ম শেষ হলে গেলে অসহায় নারীটিকে হত্যা করতেন, যাতে পরবর্তীতে সে মুক্ত হয়ে কোনো ঝামেলা করতে না পারে। অর্থাৎ, ‘রান্নামারি’ দানব ছিল তার একটি বানানো গল্প, যার আড়ালে তিনি নিজে তার ব্যক্তিগত নারীলিপ্সা মেটাতেন।
কিন্তু ১২০০ সালের দিকে এক মরক্কান পর্যটক, যিনি মালদ্বীপে ইসলাম প্রচার করতে এসেছিলেন, তিনি এই ঘটনা শুনে দারুণ বিস্মিত হন। তিনি এরপর প্রস্তাব করেন, কুমারী নারীর পরিবর্তে তিনি নিজে একরাত সেখানে কাটাবেন। মালদ্বীপের তৎকালীন রাজা তাকে প্রথমে বাধা দিলেও পরবর্তীতে তার জেদি মনোভাবের জন্য তার প্রস্তাব মেনে নিতে বাধ্য হন।
নিয়ম অনুযায়ী, তাকে রাতের বেলা মন্দিরের ভেতর রেখে আসা হয়। পর দিন যখন রাজার প্রতিনিধি সেই মরক্কান পর্যটকের মৃতদেহ আনার জন্য মন্দিরে প্রবেশ করে, তখন তিনি বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করেন যে, সেই মরক্কান পর্যটক কোরআন শরীফ থেকে বিভিন্ন আয়াত তেলাওয়াত করছেন। এরপর রান্নামারি দানব তাকে আক্রমণ না করে সমু্দ্রে ফিরে যায়।
তিনি মালদ্বীপের তৎকালীন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাজা ও তার জনগণকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের আহ্বান জানান। উপকথা অনুযায়ী, এভাবেই মালদ্বীপে ইসলামের আগমন ঘটে।
মালদ্বীপের ক্ষেত্রে রান্নামারি দানবের উপকথার সত্যতা নিয়ে কারও মাথাব্যথা না থাকলেও সেই মরক্কান পর্যটকের মাধ্যমে যে দ্বীপরাষ্ট্রটিতে ইসলামের প্রচার ও প্রসার ঘটেছিল, এর পক্ষে ঐতিহাসিক প্রমাণ রয়েছে।
এই পর্যটকের নাম ছিল আবুল বারাকাত। একবার আরবের কোনো এক বাণিজ্য-জাহাজ পূর্ব দিকে যাত্রা করে। কিন্তু জাহাজটি পথিমধ্যে তরঙ্গ-বিক্ষুব্ধ সমুদ্রঝড়ে আক্রান্ত হয়। এতে জাহাজের সব অভিযাত্রী মারা যান। তবে একজন কোনোভাবে ভেঙে যাওয়া জাহাজের কাঠখণ্ড আঁকড়ে ধরে এই দ্বীপে এসে আশ্রয় নেন।
ভিনদেশি ওই যাত্রী ছিলেন, একজন আরব যুবক ও পবিত্র কোরআনের হাফেজ। তার নাম আবুল বারাকাত ইউসুফ আল-বারবারি আল-মাগরিবি। (কিসসাতুলি ইফরিত আল্লাতি আদখালাতিল ইসলাম ফি জাজারিল মালদ্বীপ, আমল খালেদডটনেট : ১১ জুলাই ২০১৮)।
জানা যায়, আবুল বারাকাতের এই সাহসিকতার পর পর থেকে সেই মহাবিপদ মালদ্বীপে আর আসেনি। তখন রাজা ও তার দরবারের সবাই ইসলাম গ্রহণ করেন। অতঃপর পুরো রাজ্যের মানুষ দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। প্রথম দিনেই পঁয়ষট্টি হাজার লোক মুসলমান হয়। এরপর দলে দলে মালদ্বীপবাসী আশ্রয় নিতে থাকে ইসলামের সুশীতল ছায়ায়। (মান আদখালাল ইসলাম লিল মালদ্বীপ, আল-জাজিরাডটনেট : ২৩/০৫/২০১৯)
জানা গেছে, এটা ১১৪০ সালের ঘটনা। আর ওই রাজার নাম ছিল সনুরাজা। মরক্কোর বিশ্বখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতার সফরনামায় তার বর্ণনা এসেছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮৩৫
আপনার মতামত জানানঃ