ইসলাম ধর্মে পশু হত্যার অনুমোদন নেই জানিয়ে আসন্ন ঈদ-উল-আজহায় গরু কোরবানি না করার আহ্বান জানিয়েছেন অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের প্রধান ও ভারতীয় পার্লামেন্ট মেম্বার বদরুদ্দিন আজমল।
হিন্দুস্তান টাইমসের এক প্রতিবেদনে আজমলকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, হিন্দুধর্মাবলম্বীরা গরুকে মায়ের সম্মান দেয়। এই কারণে এই মুসলিম নেতা গরু কোরবানি না করার আহ্বান জানিয়েছেন। তার আহ্বানকে স্বাগত জানিয়েছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ।
বদরুদ্দিন আজমল জানান, ভারতে নানা ধর্ম, জাতি, গোত্রের মানুষ বাস করেন। এই দেশে সনাতন ধর্মের মানুষেরা “গরু”কে পবিত্র হিসাবে মনে করেন। তাই তিনি এই পশু হত্যা না করার আহ্বান জানান।
রবিবার (৩ জুলাই) আসামের হাইলাকান্দিতে সংবাদ মাধ্যমের কাছে এ মন্তব্য করে সাংসদ বলেন, ইসলাম ধর্মে যে কোনও প্রাণীকে কষ্ট না দেওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে। আর যেহেতু ভারতে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের লোকজন একটি পবিত্র ও পূজনীয় জন্তু হিসেবে দেখেন তাই ইসলাম ধর্মাবলম্বী লোকদের গরুর পরিবর্তে অন্য পশুর কুরবানি দেওয়া উচিত।
এদিকে সভাপতি বদরুদ্দিন আজমলের স্বাক্ষরিত জমিয়ত উলেমার পক্ষ থেকে এক প্রেস বিবৃতি জারি করে একই বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কুরবানি সামর্থবান মুসলমানের জন্য অবশ্য পালনীয় কতর্ব্য এবং এই কুরবানির জন্য উট, ছাগল, গর, মহিষ, ভেড়া ইত্যাদি জন্তু ব্যবহার করার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু ভারত একটি বিভিন্ন জাতি, জনগোষ্ঠী ও একাধিক ধর্মাবলম্বী লোকের দেশ। এই দেশের অধিকাংশ লোক সনাতন ধর্মাবলম্বী। সনাতন ধর্মে গরু একটি পূজনীয় জন্তু। গরুকে এই দেশের সংখ্যাগুরু মানুষ মাতৃসম জ্ঞান করেন।
এতে আরও বলা হয়, গরুকে দেশের সংখ্যাগুরু মানুষ মাতৃসম জ্ঞান করার জন্য ২০০৮ সালে ভারতের সর্ববৃহৎ ইসলামিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম দেওবন্দ ঈদ- উল আজহার কুরবানি পর্বে গরুর ব্যবহার না করার জন্য একটি আবেদন জানিয়ে ছিল।
এই আবেদনে বলা হয়েছিল যেহেতু কুরবানি গরুই দিতে হবে বলে তেমন কোনও বাধ্য বাধকতা নেই। এবং যেহেতু গরুর সঙ্গে এদেশের সংখ্যাগুরু মানুষের ধর্মীয় আবেগ জড়িত রয়েছে, তাই কুরবানির ঈদে বিকল্প জন্তুর ব্যবহার করা প্রয়োজন।
জমিয়ত বলেছে, সে জন্য আসন্ন কুরবানির ঈদে যে জন্তু ব্যবহার করলে আমাদের পবিত্র ধর্মীয় কর্তব্য অাদায় হয় এবং কারও অনুভূতিতে আঘাত না লাগে, সেই জন্তু ব্যবহার করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়।
এমপি বদরুদ্দিন আজমলকে আসামের মুসলিমদের নেতা হিসাবে মান্য করা হয়। আসামের মুসলিম অধ্যুষিত নির্বাচনী এলাকা থেকে তিনিবার নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। যদিও সম্প্রতি তার অবস্থান বেশি নাজুক। বিজেপি বাংলাদেশি মুসলিমদের সাথে তাদের চারপাশ দিয়ে ঘিরে আছে।
বদরুদ্দিন আজমলের এই আহ্বানকে স্বাগত জানিয়েছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। সংগঠনের নেতা বিনোদ বনশল হিন্দুস্তান টাইমসকে জানান, “মুসলমান নেতাদের গো হত্যা বন্ধের বিষয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।”
উল্লেখ্য, কট্টরপন্থী হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ক্ষমতায় আসার পর থেকে গো হত্যাকে কেন্দ্র করে ভারতে নানা ধরনের ঘটনা ঘটেছে। গরুর মাংস গাড়িতে রাখার দায়ে পিটিয়ে হত্যার মতো ঘটনাও ঘটেছে।
গো হত্যাকে কেন্দ্র করে তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, গো-রক্ষার নাম করে মানুষ হত্যা গ্রহণযোগ্য নয়।
এছাড়া ২০১৭ সালের দিকে ভারতের গুজরাট রাজ্য বিধানসভায় গো সুরক্ষা আইন সংশোধনের মাধ্যমে আইন লঙ্ঘনের জন্য আগের চেয়ে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করার আইন করা হয়। “গো-হত্যা” করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মতো বিধানও ছিল আইনটিতে।
গুজরাটে ১৯৫৪ সালে প্রাণী সুরক্ষা আইন হয়। এটি এর আগে সর্বশেষ ২০১১ সালে সংশোধন করা হয়েছিল। ২০১৭ সালের প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছিল, গো-হত্যা করলে সর্বোচ্চ ১০ বছর এবং সর্বনিম্ন ৭ বছর সাজা হতে পারে। সংশোধিত নতুন আইন অনুযায়ী, কারও কাছে গরুর মাংস পাওয়া গেলে এক থেকে পাঁচ লাখ রুপি পর্যন্ত জরিমানা করা হবে।
এছাড়া সবশেষে আসামের বিধানসভায় ‘অসম ক্যাটল প্রিজারভেশন বিল ২০২১’ বা গো-সংরক্ষণ বিল পাস হয়। ওই বিল পাসের ফলে অসমে হিন্দু, জৈন, শিখ ও অন্যান্য ধর্মের কোনও মন্দিরের পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে গো হত্যা এবং গরুর মাংস বিক্রি করা যাবে না।
পাস হওয়া এই বিলে বাছুর থেকে শুরু করে ১৪ বছরের কম বয়সী গরু জবাই নিষিদ্ধ করা হয়েছে । সেইসঙ্গে পুরুষ ও স্ত্রী ষাঁড় ও মহিষ, গরু, গাভী, বাছুর, বকনা বাছুর ইত্যাদিকে গরু হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এক জেলা থেকে অন্য জেলায় গরু পরিবহন না করার নিষেধাজ্ঞাও জারি করা হয়েছে। গরু পরিবহন করতে হলে আগে থেকে প্রশাসনের অনুমতি নিতে হবে বলে বিলে বলা হয়েছে বলে জানিয়েছে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমগুলো।
অথচ, টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়, তেল রাজস্ব কমায় ও মুদ্রার দুর্বলতার কারণে রাশিয়াসহ তেলনির্ভর বেশ কয়েকটি দেশে গরুর মাংস আমদানি কমলেও, ভারত থেকে রপ্তানি সবচেয়ে বেশি বেড়েছে।
অন্যদিকে ব্রাজিল, উরুগুয়ে ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে কমলেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও প্যারাগুয়ে থেকে রপ্তানি কিছুটা বেড়েছে। রাশিয়ার বাজার ভারতের গরুর মাংসের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে। এতে চলতি অর্থবছরে ভারতের এ পণ্য রপ্তানি বৃদ্ধির ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।
রাশিয়া ভারতের চারটি কোম্পানিকে মাংস সরবরাহের অনুমতি দিয়েছে এবং এরই মধ্যে প্রথম কিস্তির সরবরাহ পৌঁছে গেছে। চলতি বছর বিশ্বে গরুর মাংস রপ্তানি রেকর্ড ১০ দশমিক ২ মিলিয়ন টনে দাঁড়াবে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।
ভারতের এগ্রিকালচার অ্যান্ড প্রসেসড ফুড প্রডাক্টস এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটির (এপিইডিএ) তথ্য অনুসারে, মূল্যের দিক থেকে কৃষি খাদ্য ক্যাটাগরিতে দেশটির সবচেয়ে বেশি রপ্তানি করা ভোগ্যপণ্য হিসেবে এরই মধ্যে বাসমতী চালকে হটিয়ে জায়গা করে নিয়েছে গরুর মাংস।
ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১১ মাসে ভারতের মোট গরুর মাংস রপ্তানি দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ৫৬ হাজার ৭৯৪ টনে, যার মূল্য ২৬ হাজার ৯৬৫ কোটি রুপি। গত বছরের তুলনায় পরিমাণের দিক থেকে এ হার ১১ শতাংশ বেশি এবং মূল্যের দিক থেকে ১৩ শতাংশ বেশি।
মূল্যের দিক থেকে ১১ মাসের রপ্তানি এরই মধ্যে ২০১৪ অর্থবছরকে ছাড়িয়ে গেছে। ওই অর্থবছরে রপ্তানি মূল্য ছিল ২৬ হাজার ৪৫৮ কোটি রুপি (৩২,২৩৬ কোটি টাকা)। এ প্রবৃদ্ধির হার অনুযায়ী, ২০১৫ অর্থবছরে গো-মাংস রফতানি ৩০ হাজার কোটি রুপি ছুঁতে পারে। অন্যদিকে রফতানির পরিমাণ ১৫ লাখ টনে দাঁড়াতে পারে, আগের অর্থবছরে যা ছিল ১৪ লাখ ৪৯ হাজার ৭৫৯ টন।
অল ইন্ডিয়া মিট অ্যান্ড লাইভস্টক এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ডিবি সাবহারওয়াল বলেন, ব্রাজিলে মুদ্রার অবমূল্যায়ন ও ভিয়েতনাম থেকে হংকংয়ে গরুর মাংস পুনরায় রপ্তানি নিয়ে সৃষ্ট সমস্যা ভারতের রপ্তানিতে প্রভাব ফেলেছে। ভারতের গরুর মাংসের সবচেয়ে বড় ক্রেতা ভিয়েতনাম, আর ব্রাজিল দেশটির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী।
রাশিয়ার মতো বড় বাজার ও মিশরের মতো অনেক দেশ আরো বেশি করে ভারতীয় মাংস কিনছে। উত্তর প্রদেশ থেকে ভারতের সবচেয়ে বেশি গরুর মাংস রপ্তানি হয়।
এসডব্লিউ/এসএস/২৩৩৫
আপনার মতামত জানানঃ