সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, নাট্যকার ও গবেষক অধ্যাপক ড. রতন সিদ্দিকীর বাসায় হামলার অভিযোগ উঠেছে।এ সময় এই অধ্যাপক ও তার গাড়িচালককে লাঞ্ছিত করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করা হয়েছে। এ নিয়ে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে বলে জানা গেছে।
শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর উত্তরায় ৫ নম্বর সেক্টরে ৬/এ রোডের একটি মসজিদ থেকে শতাধিক মুসল্লি বেরিয়ে এই হামলা চালায় বলে অভিযোগ করেন রতন সিদ্দিকী ও তার পরিবার।
বাংলা একাডেমির সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত নাট্যকার-গবেষক বলেন, ‘আজকে দুপুরের সময় এক দল মুসল্লি নারায়ে তাকবির স্লোগান দিয়ে আমার বাসায় হামলা করে। তারা আমার কলাপসিবল গেট ভাঙার চেষ্টা করে। এক ঘণ্টা পর পুলিশ-র্যাব এসে তাদেরকে সরিয়ে দেয়।’
রতন সিদ্দিকীর অভিযোগ, ‘হঠাৎ করে একজন এসে বলেছে, আমি নাকি বলেছি, এখানে ধর্মের নামে ভণ্ডামি হয়। অথচ আমি কিছুই বলিনি। আমার বাসার সামনে একটি মোটরসাইকেল রাখা ছিল, সেটি সরানোর জন্য ড্রাইভার হর্ন দেয়। একজন মসজিদ থেকে এসে বলেছে, নামাজের সময় কেন হর্ন দিল। এরপরই আরেকজন এসে বলে, আমি নাাকি ধর্মের বিরুদ্ধে বলি। এই বলে হামলা করে।’
অধ্যাপক রতন সিদ্দিকীর মেয়ে পূর্ণাভা হক সিদ্দিকী বলেন, ‘আজ জুমার নামাজের সময় কয়েকশ’ মানুষ আমাদের বাড়ির গেটে হামলা করে, গেট ভেঙে ফেলার চেষ্টা করে। আমার বাবা ও তার ড্রাইভারের গায়ে হাত তোলে। এ সময় আমার মা ও বাড়ির দারোয়ানকেও গালিগালাজ করে।’
হামলার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘একটি চক্র বাসার গেটের সামনে নিয়মিত বাজার বসায়, গেটের সামনে সবজির ভ্যান দাঁড়িয়ে থাকে। এসব কারণে আমরা বাড়িতে গাড়ি নিয়ে ঢুকতে পারি না। আজও গাড়ি ঢুকতে দিচ্ছিলো না। গেটের সামনে একটি মোটরসাইকেল রাখা ছিল, বাবা মোটরসাইকেলটি সরাতে বলেন। তারা বলেন সরাবেন না। এরপর হঠাৎ করেই নাস্তিক নাস্তিক বলে চিৎকার করে বাসার গেটে হামলা শুরু করে। এ সময় অনেকেই হিন্দু, হিন্দু বলে চিৎকার করেন। এদের মধ্যে কেউ ঢিল ছোড়েন, তারপর গেট ভাঙার চেষ্টা করেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ নারায়ে তাকবির বলে স্লোগান দিতে থাকেন।’
আজকে দুপুরের সময় এক দল মুসল্লি নারায়ে তাকবির স্লোগান দিয়ে আমার বাসায় হামলা করে। তারা আমার কলাপসিবল গেট ভাঙার চেষ্টা করে। এক ঘণ্টা পর পুলিশ-র্যাব এসে তাদেরকে সরিয়ে দেয়।’
অধ্যাপকের মেয়ে আরও বলেন, ‘তারা বলেন, এই বাসার সামনে কোনও কুকুর থাকতে পারবে না। কুকুরকে খাওয়ানো যাবে না। হুমকি দেয়, আমাদের মেয়েদের বের হতে দেবে না। কুকুরগুলোকে মেরে তাড়িয়ে দেবে। জুমার নামাজের পর থেকে আড়াইটা পর্যন্ত এরকম চলতে থাকে। কেউ আসেনি সাহায্য করতে।’
এলাকার মুসল্লি, ভ্যানওয়ালা ও কিছু বস্তির ছেলে এই হামলা চালিয়েছে অভিযোগ করে পূর্ণাভা হক সিদ্দিকী বলেন, ‘হামলার দেড়ঘণ্টা পর পুলিশ আসে। আর বাসার সামনের স্কুলের প্রিন্সিপাল স্যার ও কয়েকজন শিক্ষক আসেন। আমার বাবা একজন শিক্ষক, একজন জাতীয় ব্যক্তিত্ব। আজকে তাকে অসম্মানিত হতে হলো। হামলার শিকার হতে হলো।’
রতন সিদ্দিকীর মেয়ে বলেন, ‘বাসার সামনে ভ্যান দিয়ে বাজার বসালে কিছু বলতে পারবে না, এ কেমন কথা। যে মানুষ আজীবন সম্মানের সঙ্গে মাথা উঁচু করে সমাজে চলেছেন, আজকে মসজিদে বসে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে তাকে হামলা করা হলো কেন? তারপরও আমার বাবা হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়েছেন, সেই হামলাকারীদের কাছে। এর দায় কার?’
তিনি আরও বলেন, ‘সারা জীবন এই মানুষটি সমাজ পরিবর্তনের চেষ্টা করেছেন। রাজপথে থেকেছেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথা বলেছেন। ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বলেছেন। আজকে তাকেই হামলার শিকার হতে হয়েছে।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘স্যার গাড়ি নিয়ে বাসায় ঢুকছিলেন, এ সময় তার বাসার সামনে একটি মোটরসাইকেল রাখা ছিল। তখন নামাজ চলছিল, স্যার মোটরসাইকেল সরাতে বলায় কিছুটা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। এখন সেটি সমাধান হয়েছে।’
প্রসঙ্গত, ড. রতন সিদ্দিকী জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহসভাপতি ও বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এছাড়া তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগ এ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের আজীবন সদস্য। নাটকে অবদান রাখায় ২০২০ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেছেন। তার স্ত্রী ফাহমিদা হক কলিও একজন লেখক ও নাট্যব্যক্তিত্ব
বিশ্লেষকরা বলেন, জাতিগত ও ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, বৈষম্য এবং সহিংসতার ঘটনা মোকাবিলা ও প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বাংলাদেশের সংবিধান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের অধীনে বাংলাদেশ সরকারের দায়বদ্ধতা রয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে এবং সাম্প্রদায়িকতা, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার, ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্য বা পক্ষপাতিত্ব নিষিদ্ধ করা হয়েছে (অনুচ্ছেদ ১২)। সংবিধানে আরও বলা হয়, ‘রাষ্ট্র শুধুমাত্র ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ বা জন্মস্থানের ভিত্তিতে কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্য করবে না (অনুচ্ছেদ ২৮ (১))।’
বাংলাদেশ নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী যা জাতি, বর্ণ, ধর্ম, জাতীয়তা, জন্ম বা অন্যান্য কারণে বৈষম্য নিষিদ্ধ এবং সবার সমান মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলে।
সরকার এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট অংশীজনের প্রতি ধর্ম, বিশ্বাস এবং জাতিসত্তার ভিত্তিতে সংঘটিত সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিরোধ, বিদ্বেষমূলক বক্তব্য প্রতিরোধ ও সহনশীলতা বৃদ্ধির জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৫৮
আপনার মতামত জানানঃ