গত বুধবার পিরোজপুরে ইন্দুরকানী উপজেলার পত্তাশী ইউনিয়নের পত্তাশী গ্রামে জমি নিয়ে বিরোধের জেরে আছলাম আলী খান তার বড় ভাই ওবায়দুল খানের চোখে আঘাত করেন। এতে চোখ বের হয়ে যায়।
এলাকাবাসী বলছেন, ছোট ভাই বড় ভাইয়ের চোখ তুলে নিয়েছে। কাঠের টুকরো দিয়ে তিনি এই আঘাত করেন। গুরুতর অবস্থায় তিনি এখন খুলনা আড়াইশ’ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে ভর্তি আছেন। জীবনহানির শঙ্কা না থাকলেও চোখ নিয়ে শঙ্কার কথা বলেছেন চিকিৎসকেরা।
ওবায়দুল খানের সঙ্গে হাসপাতালে রয়েছেন তার ভগ্নিপতি রেজাউল করিম। তিনি বলেন, “পারিবারিক জমি নিয়ে তাদের এই বিরোধ। ডাক্তাররা আগামীকাল শুক্রবার মেশিন দিয়ে চোখ দেখবেন, তখন বলতে পারবেন এটা ভালো হবে কি-না। শুধু চোখ নয়, তার নাকের হাড়ও ভেঙে গেছে। এখন অবস্থা একটু ভালোর দিকে।”
ইন্দুরকানী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এনামুল হক বলেন, “খবরটা আমরা শুনেছি। কেউ এখনও অভিযোগ দেয়নি। তারপরও আমরা আছলামকে গ্রেফতারের জন্য একাধিক জায়গায় অভিযান চালিয়েছি। তার বাড়িতে তালা দেওয়া। এ বিষয়ে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছি।”
সম্প্রতি পারিবারিক সহিংসতার বিষয়ে পত্রিকার তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, পারিবারিক বিরোধে গত ছয় মাসে অন্তত ৬৮ জন খুন হয়েছেন। এর মধ্যে ভাইয়ের হাতে ভাই, পিতার হাতে পুত্র বা পুত্রের হাতে পিতা, ভাইয়ের হাতে বোন, স্বামীর হাতে স্ত্রী বা ছাত্রের হাতে শিক্ষক খুন হয়েছেন। কয়েকদিন আগে সাভারে শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যা করলেন তার ছাত্র।
সারাদেশ জুড়ে সহিংসতা বাড়ছে। ভাইয়ের হাতে ভাই খুন হচ্ছে, পিতার হাতে পুত্র বা পুত্রের হাতে পিতা খুন হচ্ছেন। শিক্ষককে স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করছে ছাত্র। এই ধরনের অসহিষ্ণুতা কি বেড়ে গেছে? নাকি আগেও এমন ছিল, মিডিয়ায় না আসার কারণে আমরা জানতে পারতাম না। এখন মিডিয়ায় বেশি করে আসার কারণে আমরা জানতে পারছি? তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অসহিষ্ণুতা আগের চেয়ে বেড়েছে।
কেন বাড়ছে সহিংসতা?
গত ১৯ জুন নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার জয়াগ ইউনিয়নের ভাওরকোট গ্রামে সম্পত্তি নিয়ে বিরোধের জেরে এলোপাতাড়ি পিটিয়ে ও কুপিয়ে বড় ভাই শাহ আলমের হাতে ছোট ভাই ইলিয়াস হোসেন খুন হয়েছেন। সোনাইমুড়ী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) জিসান আহম্মেদ জানিয়েছেন, সম্পত্তি ভাগভাটোয়ারা নিয়ে তাদের মধ্যে অনেকদিন ধরেই কলহ চলছিল। এর জের ধরে এই হত্যাকাণ্ড।
প্রশ্ন উঠছে সাম্প্রতিক সময়ে কি পারিবারিক সহিংসতা বেড়ে গেছে? আপনারা কেমন তথ্য পাচ্ছেন? জানতে চাইলে ওসি হক বলেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর এই এলাকার জমির দাম বেড়ে গেছে। ফলে অনেকেই এতদিন যে জমিকে গুরুত্ব দেননি, এখন তারা সেটা দখলে নিতে চাচ্ছেন। এগুলো নিয়েই সংকট বাড়ছে। গত কয়েকমাসে আমার এলাকায় যতগুলো ঘটনা তার অধিকাংশই জমি নিয়ে বিরোধের কারণে।
পত্তাশী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহীন হওলাদারও এই ধরনের তথ্য দিয়েছেন। তার মতে, সাম্প্রতিক সময়ে পারিবারিক বিরোধ বেড়েছে। মানুষের মধ্যে অসহিষ্ণু আচরণও বেড়েছে। কেউ কাউকে ছাড় দিতে চাচ্ছেন না।
গত ৫ জুন ইন্দুরকানির খুর কাছে ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার টিঅ্যান্ডটি সড়কে বড় ভাই মেহেদী হাসান তালুকদার তার ছোট ভাই মেশকাত হোসেন তালুকদারকে পাইপ দিয়ে মাথায় বাড়ি দিয়ে হত্যা করেছেন। এই ঘটনাটিও জমি নিয়ে বিরোধের জেরে ঘটেছে বলে জানিয়েছেন নলছিটি থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আতাউর রহমান। তিনি বলেন, ভাইকে হত্যার পর মেহেদী হাসান তালুকদার নিজেই থানায় এসে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পন করেছেন।
গত ২ মে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের পতনউষার ইউনিয়নের পূর্ব শ্রীসূর্য গ্রামে জমি নিয়ে পারিবারিক বিরোধের জের ধরে বড়ভাই মানিক মিয়া পিটিয়ে হত্যা করেছেন ছোট ভাই খালেদুর রহমানকে।
গত ৫ মে খুলনার তেরখাদা উপজেলার আদালতপুরে চাচাতো ভাইয়ের টেঁটার (মাছ ধরার ধারালো কোঁচ) আঘাতে বাবুল শেখের মৃত্যু হয়েছে। তেরোখাদা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) জহুরুল আলম জানিয়েছেন, এই ঘটনাটিও জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ থেকেই ঘটেছে।
গত ১২ এপ্রিল নরসিংদীর রায়পুরায় শফিকুল ইসলাম নামের এক যুবককে বাড়ির আঙিনায় গাছের সঙ্গে বেঁধে পিটিয়ে হত্যা তারই দুই ভাই আব্দুল মোতালিব ও মাসুম মিয়া। ঘটনার পর তারা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান। রায়পুরা থানার উপ-পরিদর্শক আতিকুর রহমান জানান, বাড়িতে থাকা অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা নিয়ে বিরোধের জেরে তার বড় দুই ভাই শফিকুল ইসলামকে পিটিয়ে হত্যা করেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, এই ধরনের ঘটনা আগেও ছিল, এখনও হচ্ছে। তবে কিছুটা ধরণ পাল্টে গেছে। আগে মানুষের মধ্যে ছাড় দেওয়ার মানষিকতা ছিল, এখন সেটা দিন দিন কমছে। আর আগে সব ঘটনা তো মানুষ জানতে পারত না, এখন মিডিয়ার কারণে সেগুলো জানতে পারছেন। আগে পারিবারিক বিষয় ভাগাভাগির সময় পরিবারের সদস্যরা যে সহনশীলতা দেখাতেন, এখন সেটা দেখাচ্ছেন না।
এগুলো কমার পেছনে কারণটা হল, এখন মানুষ অনেক বেশি ব্যক্তি কেন্দ্রিক হয়ে পড়ছেন। এখাণে সমাজ রাষ্ট্রকে কাজ করতে হবে। এখানে পরিবারকে কাজ করতে হবে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে সমাজ সংস্কৃতির সংযোগ ঘটাতে হবে। সামাজিক বন্ধনে আমরা যথেষ্ট পিছিয়ে আছি। মোটা দাগে যদি বলি, আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক যে জিডিপি সেটা অর্থনৈতিক জিডিপির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এগিয়ে যেতে পারছি না।
মানুষের এই অসহিষ্ণু হয়ে উঠার পেছনে কি কোন মনস্তাত্ত্বিক কারণ আছে? জানতে চাইলে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বলেন, এগুলো নিয়ে এখন গভীরভাবে গবেষণা করা প্রয়োজন। আমাদের মধ্যে এক ধরনের সামাজিক অসহিষ্ণুতা তৈরি হয়েছে।
মানুষের মধ্যে অনেক ক্ষোভ আছে। যেটা তাকে অসহিষ্ণু করে তুলছে। ক্ষোভের প্রকাশ অনেক সময় পরিবর্তন হয়। কেউ হয়ত কোন একটা বিষয় নিয়ে অসন্তুষ্ট, কিন্তু সেই অসন্তোষ অনেক সময় যেটা নিয়ে অসন্তুষ্ট না, সেটার উপর পড়ে। এগুলো মূলত মনস্তাত্ত্বিক কারণ।
এসডব্লিউ/এসএস/০৮০৩
আপনার মতামত জানানঃ