উন্নত দেশগুলোতে কলেরা, ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মার মতো রোগগুলোর প্রাদুর্ভাব এখন আর তেমন দেখা যায় না। তবে চোখ রাঙাচ্ছে ‘চোখের নতুন সমস্যা’। পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে মায়োপিয়া বা ক্ষীণদৃষ্টি আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।
এই সমস্যার অন্যতম প্রধান ভুক্তভোগী শিশু-কিশোরেরা। কারণ হিসেবে গবেষকেরা বলছেন, দিনের আলোতে তাদের কম উপস্থিতি। এ ছাড়া অন্যান্য কারণ তো রয়েছেই।
পূর্ব এশিয়ায় এই অবস্থা প্রকট হলেও ইউরোপ-আমেরিকাও এই সমস্যা থেকে মুক্ত নয়। ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট পূর্ব এশিয়ায় মায়োপিয়ার বিস্তারকে ‘মহামারি’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। বলেছে, পশ্চিমা বিশ্বেও এর অবস্থা খুব একটা ভালো নয়।
তাইওয়ানে ১৯৮৩ সালে ৭০ শতাংশ মাধ্যমিক স্কুলপড়ুয়া মায়োপিয়ায় আক্রান্ত ছিল। বর্তমানে এই হার ৮০ শতাংশের ওপরে। ১৯৬০-এর দশকে চীনের ২০-৩০ শতাংশ স্কুলপড়ুয়া চোখে কম দেখত। বর্তমানে দেশটির কোনো কোনো অঞ্চলে মায়োপিয়ায় আক্রান্তের হার ৮০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।
চীনের গুয়াংজু, ইনার মঙ্গোলিয়ায়ও ৮০ শতাংশ স্কুলপড়ুয়া শিশু-কিশোর মায়োপিয়ায় আক্রান্ত। দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে ৯৭ শতাংশ স্কুলপড়ুয়া মায়োপিয়ায় আক্রান্ত। হংকং, সিঙ্গাপুরেও এ হার সিউলের কাছাকাছি।
২০১৫ সালে প্রকাশিত এক গবেষণার বরাত দিয়ে ইকোনমিস্ট জানাচ্ছে, ইউরোপে মাধ্যমিক স্কুলপড়ুয়াদের প্রায় ২০ থেকে ৪০ শতাংশই ক্ষীণদৃষ্টিসম্পন্ন।
লন্ডনের মোরফিল্ড চক্ষু হাসপাতালের চিকিৎসক অ্যানেগ্রেট ডালমান নূর বলেছেন, ‘এটা বলা নিশ্চয়ই ভুল হবে না যে—মায়োপিয়া বিশ্বজুড়েই জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে হাজির হচ্ছে।’ অস্ট্রেলিয়ার সিডনি ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির অধ্যাপক ক্যাথারিন রোজ বলেছেন, আগামী কয়েক দশকে এই সমস্যা আরও প্রকট হয়ে উঠবে।
২০১৯ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় অ্যানেগ্রেট ডালমান নূর বলেন, ‘তবে এই সমস্যা মারাত্মক হলে মানুষ তার দৃষ্টিশক্তিও হারিয়ে ফেলতে পারে।’ ওই গবেষণায় আরও বলা হয়, চোখের লেন্সের ক্ষমতা এত ডায়অপ্টার কমে যাওয়ার অর্থ হলো মায়োপিক ম্যাকুলোপ্যাথির ঝুঁকি ৬৭ শতাংশ বেড়ে যাওয়া।
মায়োপিক ম্যাকুলোপ্যাথি হলে চোখের দীর্ঘ মাসকুলার টিস্যুগুলো প্রসারিত এবং পাতলা হয়ে যায়, রক্তনালিগুলো দুর্বল হয়ে যায়, রক্তক্ষরণ হয় এবং চোখের রেটিনায় দাগ পড়ে।
সাধারণভাবে মায়োপিয়া জীবনভর ভোগায়। তবে মারাত্মক মায়োপিয়া অন্ধত্বের দিকেও নিয়ে যেতে পারে। মায়োপিয়ার কারণ হলো—কোনো কারণে যদি মানুষের ‘আই বল’ ক্ষতিগ্রস্ত হয় তবে বস্তু থেকে আগত আলোকরশ্মি যথাযথভাবে রেটিনায় পৌঁছাতে পারে না। ফলে দূরে থাকা বস্তুকে ঝাপসা মনে হয়।
কিন্তু শিশু-কিশোররাই কেন বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে গবেষকেরা বলছেন, শিশু-কিশোরদের মায়োপিয়া হওয়ার কারণ হলো—শিক্ষাব্যবস্থা পূর্ব এশিয়ার শিশু-কিশোরদের মায়োপিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম কারণ।
আগে মায়োপিয়াকে বংশগত বলে ধারণা করা হলেও ১৯৬৯ সালে আলাস্কার ইনুইটদের মধ্যে পরিচালিত এক গবেষণা এই ধারণা বদলে দেয়। গবেষণায় দেখা যায়, তাদের অধিকাংশ প্রাপ্তবয়স্কের কোনো মায়োপিয়া নেই। কিন্তু শিশু-কিশোরদের ৫০ শতাংশই মায়োপিয়ায় আক্রান্ত। এর বাইরেও পড়ুয়াদের মায়োপিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি।
আমেরিকান অপটোমেট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য ডা. মরগান বলেন, ‘আপনি যত বেশি পড়ুয়া, যত বেশি উচ্চ ডিগ্রিধারী আপনার মায়োপিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা তত বেশি।’
এদিকে ২০০৭ সালে ক্যালিফোর্নিয়া বিভিন্ন অঞ্চলের শিশুদের মধ্যে পরিচালিত এক গবেষণা থেকে দেখা গেছে, বেশি সময় দিনের আলোয় থাকাদের মায়োপিয়া হওয়ার ঝুঁকি কম। একই বছর, ডা. ক্যাথারিন রোজ, ডা. মরগান সিডনির ৪০০০-এরও বেশি শিশুর ওপর গবেষণা চালান। তারাও একই ফলাফল পান।
এই গবেষণা থেকে আরেকটি বিষয় পরিষ্কার হয় যে—শিশুদের মায়োপিয়া হওয়ার অন্যতম কারণ হলো তাদের বেশি সময় ঘরে থাকা।
ড. মরগান বলছেন, পূর্ব এশিয়ার শিশু-কিশোরদের মায়োপিক হওয়ার কারণ হলো—স্কুলে কাটানো সময়ের বাইরে গৃহশিক্ষকদের কাছে পড়া। মানে হলো—তারা খুব বেশি সময় দিনের আলোতে থাকে না।
২০২০ সালে তাইওয়ানের চ্যাং গুং ইউনিভার্সিটি কলেজ অব মেডিসিনের পেই-চ্যাং উ তাইওয়ানের কয়েক লাখ শিশুকে নিয়ে কাজ শুরু করেন। তাঁর গবেষণা থেকেও দেখা যায় দিনের আলো শিশু-কিশোরদের মায়োপিয়া হওয়া এবং না-হওয়ার অন্যতম কারণ।
অন্যদিকে, কম সময় স্কুলে থাকার কারণে শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে—এমনটা ভাবা অভিভাবকদের জন্য উদাহরণ পারে ফিনল্যান্ড এবং সুইডেনের মতো দেশগুলো। শিক্ষা কার্যক্রমে বিশ্বের সেরা অবস্থানে থাকা দেশগুলো যেমন শিক্ষার দিকেও মনোযোগ দেয়, তেমনি শিক্ষার্থীদের আউটডোর কারিকুলামেও বেশ প্রাধান্য দিয়ে থাকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ ভালো। তাঁদের মত হলো—হয়তো বিশেষ ধরনের ড্রপ, কনটাক্ট লেন্স মায়োপিয়া কমাতে ব্যবহৃত হতে পারে। কিন্তু দিনের আলোয় থেকে যদি শুরুতেই মায়োপিয়া কমিয়ে ফেলা যায়, তবে কেন তা আগে অনুসরণ করা হবে না? তাই, শিক্ষার্থীদের স্কুলের পাশাপাশি দিনের আলোয় খেলার মাঠসহ অন্যান্য সামাজিক পরিমণ্ডলেও অংশগ্রহণ করা উচিত।
পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সরকার এই বিষয়ে ক্রমশ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছে। মায়োপিয়াকে জাতীয় সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করে ২০১৮ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং শিশুদের মায়োপিয়া রোধের বিষয়টিকে জাতীয় অগ্রাধিকার হিসেবে ঘোষণা করেন। তারই ধারাবাহিকতায় দেশটি ভিডিও গেম নির্মাতাদের ওপর খড়গহস্ত হয়ে ওঠে।
তবে তারও আগে, তাইওয়ান সরকার ২০১২ সালে ‘তিয়ান তিয়ান আউটডোর ১২০’ নামে একটি কর্মসূচি চালু করে। যার আওতায় স্কুলপড়ুয়াদের প্রতিদিন ২ ঘণ্টা বাইরে ঘুরতে নেওয়া হয়। ফলে দেশটিতে ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তিন বছরের মধ্যেই মায়োপিয়ার হার ৪৯ দশমিক ৪ থেকে নেমে ৪৬ দশমিক ১ শতাংশে চলে আসে। তাইওয়ানের মতো একই ধরনে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল সিঙ্গাপুরে। সেখানেও বেশ ভালো ফল দিয়েছে।
এ ক্ষেত্রে বৈশ্বিক মহামারি হয়ে ওঠার আগেই মায়োপিয়া নিয়ে সচেতন হতে হবে সবাইকে। প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ ভালো—এই আপ্তবাক্য মেনেই অগ্রিম প্রতিরোধ ব্যবস্থা গৃহীত হলেই কেবল ক্ষীণদৃষ্টিতে আক্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা পাবে আগামী প্রজন্ম।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭০৫
আপনার মতামত জানানঃ