বিশ্ব বাজারের পণ্যের দাম বৃদ্ধি ও ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের ফলে দেশের মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতিতেও ২০২২ সালের প্রথম তিন মাসে কোটি টাকার বেশি আমানতকারী ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সংখ্যা বেড়েছে ১ হাজার ৬২১টি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য উঠে এসেছে। বর্তমানে কোটিপতি অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ১,০৩,৫৯৭। ২০২১ সালের ডিসেম্বরের শেষে এ সংখ্যা ছিল ১,০১,৯৭৬।
২০২০ সালের মার্চ মাসে দেশে করোনাভাইরাস প্রকোপ শুরুর সময় দেশের ব্যাংকগুলোতে এক কোটি টাকার বেশি থাকা অ্যাকাউন্টের (ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান) সংখ্যা ছিল ৮২,৬২৫। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, এর এক বছর পরে, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে এ এক লাখ ছাড়িয়ে যায়।
এসব একাউন্টে আমানতের পরিমাণ মার্চ শেষে ৬ লাখ ৬৩ হাজার ৫০৫কোটি টাকা। ডিসেম্বরে জমার পরিমাণ ছিল ৬ লাখ ৫৩ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসে কোটিপতিদের আমানত বেড়েছে ৯ হাজার ৬৪৭কোটি টাকা।
কোটিপতি অ্যাকাউন্ট ও আমানত বৃদ্ধি প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন তথ্য দিয়ে সকল কোটিপতি হিসাব এখানে আসেনি। কারণ অনেক কোটিপতি আছেন যারা ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বাইরে রয়েছে।
“এই সংখ্যা একদিকে যেমন দেশের উন্নয়ন ও আয় বাড়ার প্রমাণ দিচ্ছে অন্যদিকে এটি বৈষম্য বৃদ্ধিরও প্রমাণ।”
এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, দেশের প্রবৃদ্ধি ভালো আছে। নতুন নতুন কলকারখানা হচ্ছে। আমদানি-রপ্তানি বাড়ছে। এতে মুনাফা বাড়ছে। তাই কোটিপতির সংখ্যাও বাড়ছে।
“কিন্তু অন্যদিকে দরিদ্র মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। এটি প্রমাণ করে যে দেশে বৈষম্যও বেড়ে চলেছে।”
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে দেখা যায়, মোট ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তুলনায় কোটিপতিদের একাউন্ট সংখ্যা ১ শতাংশও নয়। কিন্তু এসব অ্যাকাউন্টে মোট আমনতের প্রায় ৪৪ শতাংশ টাকা জমা আছে।
এছাড়া চলতি বছরের মার্চ মাস শেষে ব্যাংকখাতে মোট অ্যাকাউন্ট সংখ্যা দাড়িয়েছে ১২.৭৩ কোটি এবং এসব অ্যাকাউন্টে মোট আমানত জমা আছে ১৫ লাখ ১৪ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা।
ব্যাংকাররা বলছেন, কোটি টাকার ব্যাংক হিসাবের সবগুলোই ব্যক্তি অ্যাকাউন্ট নয়। এখানে প্রাতিষ্ঠানিক অ্যাকাউন্টও আছে। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার কোটি টাকার অ্যাকাউন্ট আছে।
২০১০ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত গত ১০ বছরে দেশে ধনকুবেরের (৫০ লাখ ডলারের বেশি সম্পদের অধিকারী) সংখ্যা বেড়েছে গড়ে ১৪.৩ শতাংশ হারে। যা এই সময়ে সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি। বহুজাতিক আর্থিক পরামর্শ দানকারী প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ এক্স এর প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছিল।
চলতি বছর মার্চ মাসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, করোনার ২১ মাসে (মার্চ-২০২০ থেকে ডিসেম্বর-২০২১) কোটিপতি বেড়েছে ১৯ হাজার ৩৫১ জন। গত এক বছরে কোটিপতি আমানতকারী ৮ হাজারের বেশি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১ হাজার ৯৭৬ জনে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের মার্চে দেশে যখন করোনা মহামারি ছড়িয়ে পড়ে তখন ব্যাংকে কোটি টাকার বেশি আমানত রাখা হিসাবের (অ্যাকাউন্ট) সংখ্যা ছিল ৮২ হাজার ৬২৫টি। মহামারি চলাকালীন ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরেই কোটিপতির সংখ্যা ১ লাখ ছাড়িয়ে যায়। ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে তা দাঁড়ায় এক লাখ এক হাজার ৯৭৬ টিতে। সে হিসাবে মহামারির ২১ মাসে দেশে কোটিপতি হিসাব (অ্যাকাউন্ট) বেড়েছে ১৯ হাজার ৩৫১টি।
বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের প্রতিবেদনে জানায়, ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে কোটি টাকার বেশি অ্যাকাউন্ট ছিল ৯৩ হাজার ৮৯০টি। ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক লাখ এক হাজার ৯৭৬টিতে। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে কোটিপতি অ্যাকাউন্ট বেড়েছে ৮ হাজার ৮৬টি।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে ১২ কোটি ৪৮ লাখ ৯৬ হাজার ৯৩৪টি ব্যাংক হিসাব (অ্যাকাউন্ট) খোলা হয়। যেখানে জমা ছিল ১৫ লাখ ১২ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। এর মধ্যে কোটি টাকার বেশি হিসাবে (অ্যাকাউন্ট) জমা ৬ লাখ ৫৩ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা। ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে কোটিপতি ব্যাংক হিসাবগুলোতে জমা ছিল ৫ লাখ ৯৫ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা। ওই সময় মোট আমানতের স্থিতি ছিল ১৩ লাখ ৭৯ হাজার ১৫০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এক কোটি এক টাকা থেকে পাঁচ কোটি টাকার আমানতকারীর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৭৯ হাজার ৮৮৩টি। যাদের হিসাবে জমা টাকার অংক এক লাখ ৬৬ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা। পাঁচ কোটি থেকে ২০ কোটির মধ্যে রয়েছে ১৭ হাজার ৯টি অ্যাকাউন্ট। তাদের অ্যাকাউন্টে টাকার অংক এক লাখ ৫৮ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া ২০ কোটি থেকে ৫০ কোটির উপরে মোট হিসাবধারীর সংখ্যা ৫ হাজার ৮৪টি। এই হিসাবগুলোতে জমার অংক তিন লাখ ২৮ হাজার ৭১৯ কোটি টাকা।
একবেলা না খেয়ে আছে মানুষ
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নাজেহাল নিম্ন আয়ের মানুষ থেকে শুরু করে মধ্যবিত্তরা। ভোগ্যপণ্যের বাজারে যেন অস্থিরতা কমছেই না। তেলের বাজারের আগুন শেষ হতে না হতেই বেড়েই চলেছে অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম। এতে করে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
গত জুন মাসে প্রকাশিত বেসরকারি সংগঠন পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (বিআইজিডি) এক গবেষণায় বলা হয় করোনা পরিস্থিতিতে দেশে তিন কোটির বেশি মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়েছিল। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এই সংখ্যা কিছুটা কমলেও নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে ২১ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়েছে।
এ ছাড়াও গ্রামের চেয়ে শহরের মানুষের আয় কমেছে অনেক বেশি। শহরে যেখানে আয় কমার হার ৮ শতাংশ গ্রামে তা ৩ শতাংশ। দেশে দ্বিতীয় দফায় দেওয়া লকডাউন খুলে দেওয়ার পর মাথাপিছু দৈনিক আয় বেশ ভালোভাবে বাড়ছিল। আগস্ট ২০২১ থেকে জানুয়ারি ২০২২ পর্যন্ত আয় বৃদ্ধির এই হার ছিল ২৭ শতাংশ। কিন্তু মূল্যস্ফীতির কারণে জানুয়ারি এবং মে ২০২২-এর মধ্যে এই আয় পুনরায় কমেছে ৬ শতাংশ।
চলমান মূল্যস্ফীতির কারণে অর্থ সংকটে পড়ে গত মে মাসে অন্তত একদিন শহরের স্বল্প আয়ের ৫ শতাংশ মানুষ সারাদিন অনাহারে থেকেছে। গ্রামে এ অবস্থা ৩ শতাংশ। অন্তত এক বেলা কম খেয়েছে এমন পরিবার শহরে ২১ শতাংশ এবং গ্রামে ১৩ শতাংশ। এমনকি পরিবারগুলোর অনেকে ফেব্রুয়ারি মাস থেকে মাছ, মাংস, দুধ ও ফল খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। ২৭ শতাংশ পরিবার কমিয়ে দিয়েছে চাল কেনার পরিমাণ। নিম্নমানের চাল কিনছে ৩৬ শতাংশ পরিবার। ৪৭ শতাংশ পরিবার দুধের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। একেবারে বাদ দিয়েছে ২০ শতাংশের মতো পরিবার। মাছ কেনার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে ৭৩ শতাংশ মানুষ। পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে আবার অনেকে। গতকাল রবিবার এ গবেষণা প্রতিবেদন ভার্চুয়ালি গণমাধ্যমের সামনে তুলে ধরেন পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান এবং বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ইমরান মতিন।
দেশে ২০২০ সালের মার্চে করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে ওই বছরের এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের মে মাস পর্যন্ত নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর করোনার প্রভাবসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে পাঁচ দফা জরিপ করে পিপিআরসি ও বিআইজিডি। প্রথমবার এপ্রিল ২০২০, দ্বিতীয়বার ওই বছরের জুন, তৃতীয়বার মার্চ ২০২১ ও চতুর্থবার ওই বছরের আগস্টে এই জরিপ চালানো হয়। গতকাল ‘মূল্যস্ফীতি, খাপ খাওয়ানো ও পুনরুদ্ধারের প্রতিবন্ধকতা’ শীর্ষক পঞ্চম দফার জরিপের ফলাফল প্রকাশ করা হয়। এই জরিপের কাজ চলে গত ১৪ থেকে ২১ মে পর্যন্ত। গ্রাম ও শহরের তিন হাজার ৯১০ জন মানুষের ওপর এই জরিপ চালানো হয়। মোট ১১ সেকশনে প্রত্যেকটি মানুষের কাছে ৮০ থেকে ৯০টি প্রশ্ন করা হয়।
গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরে হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘করোনার পর বাংলাদেশ অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। নতুন দরিদ্র মানুষের পরিস্থিতির উন্নয়ন হচ্ছে না। দরিদ্র মানুষ টিকে থাকার চেষ্টা করছে খাওয়া কমিয়ে, কাজের সময় বাড়িয়ে এ প্রচেষ্টা চলছে। মানুষের আয় করোনাপূর্ব সময়ের চেয়ে এখনও ১৫ শতাংশ কম। ‘শহরে এ হার অনেক বেশি, ২৫ শতাংশ। গ্রামে তা ১ শতাংশ।
তিনি আরও বলেন, কোভিড-১৯-এর ধাক্কা সামলানোর সময়টিতে মূল্যস্ফীতি ঘটায় পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে। বাংলাদেশ এখন একটি নতুন ঝুঁকির সম্মুখীন। তা হলো টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় পুষ্টি ও শিক্ষার যে লক্ষ্য নির্ধারিত, সেটি পূরণ না হওয়ার আশঙ্কা।
জরিপে দেখা গেছে, গ্রাম-শহরের কৃষি ও পরিবহন খাতের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে অনেকটা খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছেন। কিন্তু রিকশাচালক, কারখানা শ্রমিক ও গৃহকর্মীর ওপর এর প্রভাব মারাত্মক। জরিপে বলা হয়, মূল্যস্ফীতির এই চাপ অনেক নারীকে কাজের খোঁজে বাইরে বের হতে হয়েছে। তবে করোনাকালে কাজ হারানো ৩৬ শতাংশ নারী এখনও কর্মক্ষেত্রে ঢুকতে পারেননি।
দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধির পেছনে নানা কারণকে দোষারোপ করছেন সাধারণ মানুষ। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৬২ শতাংশ মনে করছে, দুর্বল ব্যবস্থাপনার জন্যই এমনটি ঘটছে। এর পাশাপাশি সরবরাহের ঘাটতি, জনসংখ্যা বৃদ্ধিকেও কারণ বলে মনে করে অনেকে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের ব্যবস্থা হিসেবে সর্বোচ্চ ৬৯ শতাংশ মনে করে, ব্যবস্থাপনা বা সুশাসন ফিরিয়ে আনতে হবে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির বিস্তারের কথা বলেছে ৩৬ শতাংশ।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭৪০
আপনার মতামত জানানঃ