ফেসবুককে আবারও একহাত নিলেন নোবেল বিজয়ী মারিয়া রেসা, বললেন গণমাধ্যমকে ফেসবুক থেকে দূরে দূরে থাকতে।খবর ডয়েচে ভেলে
সোমবার (২০ জুন) ডয়চে ভেলে গ্লোবাল মিডিয়া ফোরামের উদ্বোধনী দিনে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন ফিলিপাইন্সের সাংবাদিক মারিয়া রেসা৷ ২০২১ সালে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী এই সাংবাদিক বলেন, ‘আপনার কাছে যদি তথ্য না থাকে তাহলে সত্যটাও নেই, আর যদি সত্য না থাকে তাহলে আস্থাও নেই৷’
বক্তৃতায় তিনি ভুয়া সংবাদ এবং গুজব ছড়ানোর জন্য বৃহৎ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি অভিযোগ করেছেন৷ তার মতে গুজব আসলে মিথ্যারই নামান্তর, যা বাস্তবতার বোধকে নষ্ট করছে এবং পুঁজিবাদী নরজরদারিকে উস্কে দিচ্ছে৷ গণমাধ্যমগুলো যাতে সেই ফাঁদে পা না দেয় সে বিষয় সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন তিনি৷
রেসা বলেন, ‘আমরা যাতে নিজেদের গন্তব্য নির্ধারণ করতে পারি, সেজন্য অবশ্যই আমাদের প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে৷..ভার্চুয়াল দুনিয়াতে যদি আইনের শাসন না থাকে তাহলে বাস্তব পৃথিবীতেও আপনি আইনের শাসন পাবেন না৷’
এই পরিস্থিতি কিভাবে গণতন্ত্রকে হুমকির মুখে ফেলছে সেই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি প্রশ্ন করেন, ‘তথ্যের সত্যতা যদি না থাকে, তাহলে নির্বাচনী ব্যবস্থার স্বচ্ছতাই বা কিভাবে থাকবে?’
খ্যাতনামা এই সাংবাদিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণে নীতিমালার পাশাপাশি গণমাধ্যমগুলোর জন্য আরও অর্থ বরাদ্দের দাবি জানান৷ গণতান্ত্রিক সরকারগুলো যাতে তাদের বিদেশি উন্নয়ন সহায়তার মধ্যে সাংবাদিকতার উন্নয়নে ব্যয় করা তহবিল অন্তত দশমিক তিন শতাংশ বাড়ায় সেই আহ্বান জানান তিনি৷
রেসার মতে মিথ্যা এবং ঘৃণা সত্যের চেয়েও দ্রুত ছড়ায়৷ জার্মানির বনে গ্লোবাল মিডিয়া ফোরামে অংশ নিয়ে তিনি বলেন, ‘ফ্যাসিবাদের উত্থান মোকাবিলায় সত্যের প্রতি আস্থা পুননির্মাণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’
ফ্যাসিবাদের উত্থান মোকাবিলায় সত্যের প্রতি আস্থা পুননির্মাণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’
রেসা এমন এক সময় এই বক্তৃতা দিলেন যার কয়েক দিন পরই সাবেক সৈরশ্বাসকের পুত্র ফার্দিনান্দ মার্কোস জুনিয়র ফিলিপাইন্সের রাষ্ট্রপতির আসনে বসতে যাচ্ছেন৷ রবিবার উপ-রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিয়েছেন তার নির্বাচনী সঙ্গী বিদায়ী প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তের কন্যা সারা দুতার্তে৷ দুইজনই তাদের বাবার শাসনামলের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করেননি৷ বরং মার্কোস জুনিয়র তার বাবার নীতি ধরেই এগোনোর ইঙ্গিতই দিয়ে রেখেছেন৷
বিশ্লেষকদের মতে এই দুই রাজনৈতিক পরিবারই সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহার করে বিকল্প একটি তথ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন, যা বিস্তৃত জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছেছে৷
অন্যদিকে রেসার প্রতিষ্ঠিত র্যাপলার গণমাধ্যমটি ২০১২ সাল থেকে ভুয়া সংবাদ ও গুজবের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে৷ সাংবাদিক, আইনজীবী, আন্দোলনকর্মীদের একসাথ করে তারা সত্যতা যাচাই ও গুজব উন্মোচনের কাজ করে চলেছে৷ বিশেষ করে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট রড্রিগো দুতার্তের ছয় বছরের শাসনামলে ভুয়া তথ্যের বিরুদ্ধে লড়াই, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার খবর দিয়ে গেছে র্যাপলার৷ এজন্য বিভিন্ন সময়ে ফিলিপাইন্সের সরকারের রোষাণলে পড়লেও এবং তার বিরুদ্ধে দেশটির বিতর্কিত সাইবার আইনে ব্যবস্থা নেয়া হলেও রেসা জানান, তিনি এতে হাল ছেড়ে দেবেন না৷
র্যাপলারের পাশাপাশি ফেসবুককে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে রেসা রিয়্যাল ফেসবুক ওভারসাইট বোর্ড নামের একটি উদ্যোগ গঠন করেছেন৷ গ্লোবাল মিডিয়া ফোরামে রেসা বলেন, ফেসবুক সাংবাদিকদের স্থানটিতে ‘ইনফ্লুয়েন্সারদের’ বসিয়েছে৷ তিনি অভিযোগ করেন সামাজিক মাধ্যমটি বেশ কিছু দেশে গণতন্ত্রকে পেছনে নিয়ে গেছে৷
বিশ্বে চলছে সোশ্যাল মিডিয়ার রাজত্ব। যুগের চাহিদায় দিন দিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জনপ্রিয়তা বেড়েই চলছে। ফেসবুক ছাড়া এখন ভাবাই অসম্ভব। কী নেই এখানে? চাইলেই সবকিছু মেলে নেট দুনিয়ায়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে ফেসবুক। ভুয়া তথ্য প্রচার, অশালীন মন্তব্য ও ঘৃণা ছড়ানোর অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছে এ মাধ্যম। এ ছাড়া ফেসবুকের বিরুদ্ধে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদে সমর্থন ও পক্ষপাতমূলক আচরণের অভিযোগ তুলেছেন বিশ্বের অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা। মানুষকে বিপথগামী করতে রীতিমতো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটি।
গত বছর শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ফিলিপাইনের সাংবাদিক মারিয়া রেসা ৯ অক্টোবর এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে বলেন, ফেসবুক গণতন্ত্রের জন্য হুমকি। ঘৃণা ও ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ।
‘বিশ্বে সংবাদের সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী ফেসবুক। প্রতিষ্ঠানটির অ্যালগরিদম ভুয়া তথ্য ও ঘৃণা ছড়ানো ঠেকানোকে অগ্রাধিকার দিতে সফল হয়নি। এমনকি তথ্য প্রকাশ ও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করে ফেসবুক। ফেসবুক গণতন্ত্রের প্রতি চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে, এমন মন্তব্য করে মারিয়া রেসা বলেন, ‘আপনার কাছে যদি তথ্য না থাকে, তবে আপনি প্রকৃত সত্য জানতে ও বিশ্বাস স্থাপন করতে পারবেন না। আর এসবের অভাব গণতন্ত্রকে দুর্বল করে তোলে।
ফিলিপাইনের অন্যতম ভিন্নধারার পত্রিকা র্যাপলারের সহ-প্রতিষ্ঠাতা মারিয়া রেসা একসময় সিএনএনে সাংবাদিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। নিউজ ওয়েবসাইট হিসেবে প্রকাশের পূর্বে ২০১১ সালে স্রেফ একটি ফেসবুক পেজ হিসেবে র্যাপলার যাত্রা শুরু করে। দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতোই ফিলিপাইনের মানুষের জন্যও অনলাইন জগতে প্রবেশের অন্যতম প্রধান প্ল্যাটফর্ম হলো ফেসবুক। ফিলিপিনোদের জন্য ফেসবুক ইন্টারনেটের সমতুল্য এমন বক্তব্যও নতুন নয়।
রেসা প্রথম ফিলিপাইনে ফেসবুকের আধিপত্য বাড়ার সঙ্গে কীভাবে ফেসবুকের সামাজিক দায়বদ্ধতাও বেড়ে গেছে, সেটাই মার্ক জাকারবার্গকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন। ৯৭ শতাংশ ফিলিপিনো ফেসবুক ব্যবহার করেন বলে জাকারবার্গকে জানিয়েছিলেন রেসা। ফেসবুকের সঙ্গে যে সমস্যাগুলোর উদ্ভব ঘটছে তা ভালোমতো বোঝার জন্য তিনি জাকারবার্গককে ফিলিপাইনে আসার আমন্ত্রণ জানান।
মার্ক জাকারবার্গ সেই আমন্ত্রণ উপেক্ষা করেন বলেই মনে হয়েছিল। পরিবর্তে তিনি দেশটিতে ফেসবুকের প্রভাব আরও জোরদার করার দিকে মনোযোগ দেন। তিনি নাকি উল্টো প্রশ্ন করেছিলেন, “বাকি ৩ শতাংশ তাহলে কী করছে, মারিয়া?”
প্রেসিডেন্ট রড্রিগো দুতার্তের উত্থানের পর থেকেই রেসা ফেসবুকের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনায় সরব হন। মিথ্যা তথ্য ছড়ানোতে ফেসবুকের সক্রিয় ভূমিকার পাশাপাশি তিনি পশ্চিমা দেশগুলোর বাইরে প্রভাব পর্যালোচনায় ফেসবুকের অনীহা নিয়েও সমালোচনা করেন। অথচ ফেসবুকের বৃহত্তম বাজার এই অ-পশ্চিমা দেশগুলো। তাদের ব্যবহারকারীদের অধিকাংশই এসব দেশের বাসিন্দা। ভারতে হেট স্পিচ বা বিদ্বেষমূলক বার্তা নিয়ন্ত্রণে কিংবা মায়ানমারে জেনোসাইড ও সহিংসা ঠেকাতে ব্যর্থতার জন্যও ফেসবুক তুমুল সমালোচনার সম্মুখীন হয়।
রেসা এবং তার র্যাপলারের নির্ভীক প্রতিবেদক দল দুতার্তের শাসনব্যবস্থায় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও বিরোধীদলকে ভীতি প্রদর্শনের ঘটনা নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ২০১৬ সালের নির্বাচনে দুতার্তে ক্ষমতায় আসার পর রেসা বেশ কিছু ফেসবুক পেজ সামনে নিয়ে আসেন। এই পেজগুলো অন্তত ৩০ লাখ মানুষের কাছে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়েছে। তিনি তার প্রমাণাদি ফেসবুকের কাছেও পাঠান। কিন্তু, ফেসবুক তা আমলে নেয়নি।
২০১৯ সালে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের কাছে রেসা বলেন, “ফেসবুক এখন বিশ্বের বৃহত্তম সংবাদ বিতরণকারী। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা দ্বাররক্ষকের ভূমিকা নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। যখন তারা এই কাজ করে, যখন মিথ্যাকে সত্যের সঙ্গে মিশে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়, তখন সমগ্র জনপরিসরের জন্যই তা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।”
শান্তিতে নোবেল পাওয়ার পর এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে মারিয়া রেসা রয়টার্সকে বলেন, ঘৃণা ও ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। এর মধ্য দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটি গণতন্ত্রের জন্য হুমকি স্বরুপ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯২৭
আপনার মতামত জানানঃ