বর্তমান সময়ে বিবাহ-বিচ্ছেদ তথা ডিভোর্সের পরিমাণ আশংকাজনক হারে বেড়ে গিয়েছে। কেউই শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারছে না কোন্ দম্পতির কখনই ডিভোর্স হবে না। যেকোন সময় যেকারও ডিভোর্স হতে পারে, জনমনে এধরনের একটি শঙ্কা তৈরি হয়েছে। সমাজ বিজ্ঞানীরা বেশ কিছু বিষয় পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন, ডিভোর্স কাদের হয় এবং কেন হয়? কারণগুলো জানা থাকলে ডিভোর্সের দিকে ধীরে ধীরে এগোনো দম্পতিরা চাইলে তাদের সম্পর্কটা রক্ষা করতে পারবেন।
টিনএজে কিংবা ৩২ বছরের পর বিয়ে
গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ২৭-৩০ বছরের মধ্যে বিয়ে করেন তাদের দাম্পত্য জীবন তুলনামূলক বেশি মজবুত ও স্থায়ী হয়ে থাকে।
অন্যদিকে যারা টিনএজ (১৩-১৯ বছর) বা ৩২+ বয়সে বিয়ে করে তাদের ডিভোর্সের হার বেশি। বিশেষ করে কম বয়সে বিবাহ বন্ধনে যারা আবদ্ধ হয় তারা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
এছাড়া, স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বয়সে বেশি ফারাক থাকলে সেটাও ডিভোর্সের দিকে ঠেলে দেয়। যেসব দম্পতির বয়সের পার্থক্য ১ বছর তাদের ডিভোর্সের হার ৩ শতাংশ। বয়সের পার্থক্যটা ৫ বছরে দাঁড়ালে ১৮ শতাংশ এবং ১০ বছর হলে ৩৯ শতাংশ দম্পতির বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়ে থাকে।
স্বামীর ফুল-টাইম জব না থাকা
১৯৭৫ সালের পরে হওয়া বিয়েগুলোর ওপর গবেষণা করে অ্যালেকজান্ড্রা কিলওয়্যাল্ড দেখেছেন, যাদের স্বামী ফুল-টাইম কাজ করে তাদের ডিভোর্সের হার ২.৫ শতাংশ। অন্যদিকে যাদের স্বামী ফুল-টাইম কাজ করে না তাদের ডিভোর্সের হার ৩.৩ শতাংশ। অর্থাৎ, স্বামী স্থায়ী উপার্জন বা পেশার ওপর ডিভোর্স কিছুটা হলেও নির্ভরশীল।
অবশ্য স্ত্রী উপার্জন করে কিনা সেটা ডিভোর্সের ক্ষেত্রে তেমন কোন প্রভাব ফেলে না। গবেষণায় দেখা গেছে, সংসারের যাবতীয় ব্যয়ভার স্বামীই বহন করবে এরকম প্রাচীন ধ্যান-ধারণা সমাজে এখনও বিদ্যমান রয়েছে। আর একারণেই স্বামীর স্থায়ী উপার্জন মাধ্যম বা ফুল-টাইম পেশা দাম্পত্য জীবনের স্থায়ীত্বের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
হাই স্কুল পাশ না করা
শুনতে খারাপ লাগলেও গবেষণা কিন্তু এটাই বলছে যে, কলেজ গ্রাজুয়েট দম্পতিদের চেয়ে হাই স্কুল না পেরোনো দম্পতিদের মাঝে ডিভোর্সের হারটা প্রায় দ্বিগুণ।
কারণ স্বল্প শিক্ষিত ব্যক্তিদের উপার্জন কম হওয়ায় তাদের জীবনযাত্রা বেশি কঠিন হয়ে পড়ে। আর যেখানে প্রতি পদে পদে কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়, সেখানে সাধারণত ভালাবাসাময় সুখী দাম্পত্য জীবন কাটানো সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। ফলাফল: বিবাহ-বিচ্ছেদ।
সঙ্গীর প্রতি নেতিবাচক ভাব প্রদর্শন
মনোবিজ্ঞানী জন গটম্যান ডিভোর্সের পেছনে চারটি প্রধান কারণকে দায়ী করেছেন। যে দম্পতিদের মাঝে এই চারটি বিষয় উপস্থিত থাকে তাদের ডিভোর্স হওয়ার সম্ভাবনা অত্যাধিক।
১. সঙ্গীকে ছোট করে দেখা। অবজ্ঞা করা।
২. সঙ্গীর স্বভাব-চরিত্রের ব্যাপারে লাগাতার সমালোচনা করা।
৩. দাম্পত্য জীবনের কোনো সংকটে বা কঠিন পরিস্থিতে নিজেকে সবসময় নির্যাতিত কিংবা ভুক্তভুগী হিসেবে উপস্থাপন করা।
৪. একে অন্যের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়া।
দাম্পত্য জীবনের শুরুতে বাড়াবাড়ি রকমের রোমান্টিকতা
বৈবাহিক জীবনের শুরুতে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে একটু বাড়তি উচ্ছ্বাস, আগ্রহ কাজ করে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেটা যখন মাত্রা ছাড়িয়ে যায় তখন সমস্যার সৃষ্টি করে।
মনোবিজ্ঞানী টেড হিউসটন ১৬৮ জন দম্পতিকে তাদের বিয়ের পর থেকে টানা ১৩ বছর নজরে রেখেছিলেন। বিভিন্ন সময় দম্পতিদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তিনি। পরবর্তীতে এর ওপর ভিত্তি করে ইন্টারপার্সনাল রিলেশনস অ্যান্ড গ্রুপ প্রসেস জার্নালে একটি পেপার প্রকাশ করেন।
এছাড়াও সাইকোলজি টুডে-তে আভিভা প্যাটজ লেখেন, “যেসব দম্পতিদের বৈবাহিক জীবন অতিরিক্ত রোমান্টিকতা দিয়ে শুরু হয় তাদের মধ্যে ডিভোর্স প্রবণতা বেশি। কারণ, ওরকম রোমান্টিকতা ধারাবাহিকভাবে বজায় রাখা অত্যন্ত কঠিন। বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও এটাই সত্য যে, যাদের দাম্পত্য জীবনের শুরুতে তুলনামূলক কম ‘হলিউড রোমান্স’ থাকে তাদের বৈবাহিক সম্পর্ক তত মজবুত হয়।
বাদানুবাদে নীরবতা পালন
যখন সঙ্গীর সাথে কোনো বিষয়ে আপনার মতের মিল না হয় বা ঝগড়া হয় তখন সে যদি বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে চায় তখন কি আপনি চুপ মেরে যান? ঝামেলা নিয়ে কথা বলতে চান না? তাহলে এটা খারাপ লক্ষণ।
২০১৩ সালে জার্নাল অব ম্যারেজ অ্যান্ড ফ্যামেলিতে একটি লেখা প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়েছে, সমস্যার সমাধান না করে এধরনের নিরবতা পালন বা কথা বলতে না চাওয়ার স্বভাবটা দাম্পত্য জীবনকে ডিভোর্সের দিকে ঠেলে দেয়। প্রায় সাড়ে ৩৫০ নব-দম্পতির সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে এই তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছিল।
২০১৪ সালে কমিউনিকেশন মনোগ্রাফ জার্নালে আরেকটি লেখা প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়েছে, যেসব দম্পতিদের একজন কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলতে চেয়ে বিনিময়ে সঙ্গীর কাছ থেকে নিরবতা পায় তারা দাম্পত্য জীবনে খুব একটা সুখী নয়।
গবেষক পল শ্রড বলেন, এটা খুবই কঠিন একটি বিষয়। কারণ স্বামী-স্ত্রী দু’জনই একে অন্যকে সৃষ্ট সমস্যার জন্য দায়ী ভেবে থাকেন।
একে অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে নয়, সমস্যার সমাধানের জন্য কে কতটা অবদান রাখার চেষ্টা করছে সেদিকে নজর দেয়া উচিত। পরস্পরের যদি সম্মান ও শ্রদ্ধা অক্ষুণ্ন রেখে দাম্পত্য জীবনের বিভিন্ন ঝামেলা মিটিয়ে ফেলার জন্য খোলামেলাভাবে কথা বলা জরুরী।
দাম্পত্য জীবনকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা
ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনে গবেষক গটম্যান ও অন্যান্য গবেষকরা “ওরাল হিস্টোরি ইন্টারভিউ” নামের একটি সাক্ষাৎকারের আয়োজন করেন। সেখানে দম্পতিদেরকে তাদের দাম্পত্য জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে বলতে দেয়া হয়।
দম্পতিদের কথা পর্যালোচনা ও পর্যবেক্ষণ করে গবেষকরা ভবিষ্যৎবাণী দিতে সক্ষম হয়েছিলেন কোনো কোন দম্পতি ডিভোর্সের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
২০০০ সালে জার্নাল অব ফ্যামেলি সাইকোলজি-তে একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। ৯৫ জন নবদম্পতির “ওরাল হিস্টোরি ইন্টারভিউ” নিয়ে সেগুলো খতিয়ে দেখা হয়েছে কোন কোন দম্পতির বৈবাহিক বন্ধন কতটা মজবুত কিংবা দুর্বল। যেসব বিষয় পর্যালোচনা করা হয়েছে সেগুলো হলো:
১. একে অন্যের প্রতি ভাললাগা, ভালবাসার নমুনা।
২. দম্পতিদের মধ্যে কারা “আমরা” শব্দের ওপর বেশি জোর দিচ্ছে। আর কারা বারবার “আমি” বলছে।
৩. একে অন্যের বক্তব্যগুলোকে কতটা বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হচ্ছে।
৪. নেতিবাচক কথার পরিমাণ।
৫. বিয়ে বা দাম্পত্য জীবন নিয়ে হতাশা।
৬. কে কে তাদের বিয়েকে “ঝামেলা” হিসেবে বর্ণনা করছে।
পশ্চিমাদের পাশাপাশি বাংলাদেশেও বিগত কয়েক বছরে ডিভোর্স বেড়েছে ভয়াবহ পরিমাণে। ২০১৫ সালে শুধুমাত্র ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনেই ডিভোর্স কার্যকর হয়েছে মোট ৩ হাজার ৫৩০টি! (সূত্র : প্রথম আলো ২৬ জুলাই ২০১৭)
২০২০ সালে, দুই সিটির মেয়রের কার্যালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, জুন থেকে অক্টোবর মাসে তালাক হয়েছে ৫ হাজার ৯৭০টি। ২০১৯ সালের একই সময়ের চেয়ে ২০২০ সালে ডিভোর্সের সংখ্যা প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে। এই সময়ে দৈনিক ৩৯টি তালাকের ঘটনা ঘটেছে, অর্থাৎ প্রতি ৩৭ মিনিটে একটি তালাক কার্যকর হয়েছে!
পারিবারিকভাবে হোক বা প্রেম করে উভয় ক্ষেত্রেই ডিভোর্সের পরিমাণ আশঙ্কাজনক। রেস্টুরেন্টে বসে কয়েক ঘণ্টার প্রেমালাপ বা সপ্তাহে দুই দিন ঘোরাঘুরি করা আর বিয়ের পর এক ছাদের নীচে থাকার মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। যতই পূর্ব পরিচিত হোক না কেন, বিয়ের পরই একজন মানুষকে গভীরভাবে চেনা যায়। দাম্পত্য জীবনে যারা একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়, সঙ্গীর ওপর প্রভাব বিস্তার করতে চায় তারা সুখী হতে পারে না।
অন্যদিকে পারিবারিকভাবে হওয়া বিয়ের ক্ষেত্রে দু’জন অপরিচিত মানুষের স্বভাবগত পার্থক্যের পাশাপাশি পূর্বের প্রেমের সম্পর্ক, সত্য গোপন করা, সন্দেহ প্রবণতা, বোঝাপড়ার অভাব, অনীহা কিংবা ভয়ের কারণে শারীরিক সম্পর্ক উপভোগ না করা বিবাহ-বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
তথ্যসূত্র :
sciencealert.com
প্রথম আলো
আপনার মতামত জানানঃ