বিগত কয়েক বছরের টানা খরায় ইরাকের অধিকাংশ জলাধারই শুকিয়ে গিয়েছে। দেখা দিয়েছে পানির সংকট। ফলে লোকজন দূরদূরান্তে যেতে বাধ্য হচ্ছে পানির সন্ধানে। সম্প্রতি পানির সন্ধানে গিয়েই প্রায় ৩ হাজার ৪০০ বছরের পুরোনো এক শহরের ধ্বংসাবশেষের দেখা মিলেছে।
যেখানে একসময়ে ছিল একটি প্রাসাদ এবং একটি বিস্তৃত দুর্গ। ব্রোঞ্জ যুগের সময়ে এখানে বসতি গড়ে উঠেছিল। শহরটি টাইগ্রিস নদী দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল। বর্তমানে এখানে রয়েছে মসুল বাঁধ। বাঁধটি পুনরায় পানিতে ভরাট হবার আগে প্রাচীন শহরটির ধ্বংসাবশেষ খনন করতে শুরু করেছিলেন গবেষকরা।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খরার পরিস্থিতি কীভাবে অপ্রত্যাশিত আবিষ্কারগুলি সামনে এনেছে তার সর্বশেষ উদাহরণ গত মাসে দেখা গেছে। নেভাডায়, লেক মিডে পানির স্তর হ্রাস পেয়ে কয়েক দশক পুরানো কঙ্কালের অবশেষ পাওয়া গিয়েছিল।
ইরাকের মসুলে অবস্থিত মসুল ড্যামের জলাধারটিই ইরাকের সবচেয়ে বড় জলাধার। তীব্র গরম ও খরায় এই জলাধারের পানিও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে শুকিয়ে গিয়েছে। ফলে জলাধারের তলদেশের অনেকটাই উন্মুক্ত হয়ে এসেছে। আর উন্মুক্ত জলাধারের তলদেশেই দেখা পাওয়া গেছে ৩ হাজার ৪০০ বছরের পুরোনো ওই শহরের।
গবেষকেরা বলছেন, ওই শহরটি মিসরীয় শাসক ফারাও তুতেনখামেনের শাসনামলের সমসাময়িক। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, মিত্তানি সাম্রাজ্য খ্রিষ্ট পূর্ব ১৫০০ সাল থেকে খ্রিষ্ট পূর্ব ১৩০০ সাল পর্যন্ত তাদের শাসন চালিয়েছে।
প্রত্নতাত্ত্বিকদের একটি দল বিশ্বাস করেন যে—শহরটি অ্যাসেরিয় সভ্যতার শহর। যা মধ্য অ্যাসেরিয় বা মিত্তানি সাম্রাজ্য নামে পরিচিত সাম্রাজ্য নামে পরিচিত। ব্রোঞ্জ যুগের এই সাম্রাজ্য বর্তমান ইরাকের উত্তরাংশ এবং বর্তমান সিরিয়া শাসন করত। বিশেষজ্ঞদের মত, মিত্তানি সাম্রাজ্য তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিট্টি ও অ্যাসেরিয় সাম্রাজ্যের আক্রমণে।
এ বছরের শুরুর দিকে, ওই স্থানে একটি বড় ধরনের শহর থাকার সম্ভাবনা দেখতে পান। সেসময় তারা শহরটিতে গুদামঘর, শিল্প কারাখানার দালান এবং দুর্গের নমুনা আবিষ্কার করেছিলেন। এমনকি তাঁরা সেখান থেকে কয়েক হাজার বছরের পুরোনো কিছু তৈজসপত্রও খুঁজে পান। সেসময় তাঁরা কিউনিফর্ম লিপিতে লেখা বেশ কিছু মাটির ফলকও উদ্ধার করেছিলেন।
প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা, শহরটি বড় ধরনের কোনো ভূমিকম্পের ফলে ধ্বংস হয়েছে। তাও আজ থেকে প্রায় ৩ হাজার ৩৫০ বছর আগে অর্থাৎ ১৩৫০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে।
জার্মান এবং কুর্দি প্রত্নতাত্ত্বিকদের একটি দল জানাচ্ছেন ইরাকের প্রাচীন শহরটি কুর্দিস্তান অঞ্চলে কেমুন নামে পরিচিত একটি স্থানে অবস্থিত। জার্মানির ফ্রেইবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ার ইস্টার্ন আর্কিওলজির জুনিয়র প্রফেসর এবং গবেষণা দলের সদস্য ইভানা পুলজিজ বলেন, ১৫৫০ থেকে ১৩৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে মিতানি সাম্রাজ্যের সময় বসতিটি গড়ে ওঠে। যেহেতু শহরটি সরাসরি টাইগ্রিসের উপর অবস্থিত ছিল, এটি মিতানি সাম্রাজ্যের মূল অঞ্চলকে সংযুক্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে বলে অনুমান গবেষক দলের।
শহরের উত্তর-পূর্ব পরিধি বিস্তৃত ছিল বর্তমান সিরিয়া পর্যন্ত। গবেষকরা ধ্বংসাবশেষের মধ্যে টাওয়ার, একটি স্মারক প্রাসাদ এবং অন্যান্য বেশ কয়েকটি বড় ভবন পেয়েছেন। প্রত্নতাত্ত্বিকরা এই অঞ্চলটিকে প্রাচীন শহর জাখিকু বলে মনে করছেন, যা একসময় অন্যতম রাজনৈতিক কেন্দ্র ছিল।
নগরের বড় বড় দুর্গের যে প্রাচীর রোদে শুকানো মাটির ইট দিয়ে নির্মিত হয়েছিল তা সত্ত্বেও আশ্চর্যজনকভাবে ভালভাবে সংরক্ষিত রয়েছে।
প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, খ্রিস্টপূর্ব ১৩৫০ সালের দিকে এই অঞ্চলে ভূমিকম্পের জেরে ব্রোঞ্জ যুগের শহরটি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। খননকালে পাঁচটি সিরামিক পাত্রও পাওয়া যায় যাতে ১০০ টিরও বেশি ট্যাবলেট কিউনিফর্ম লিপিতে খোদাই করা ছিল। জার্মানির টিউবিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ার ইস্টার্ন আর্কিওলজি বিভাগের পরিচালক এবং গবেষণা দলের সদস্য পিটার ফাল্জনার বলেছেন, কাদামাটি দিয়ে তৈরি কিউনিফর্ম ট্যাবলেটগুলি এত দশক ধরে পানির নিচে টিকে ছিল। ফসল শুকিয়ে না যাওয়ার জন্য ডিসেম্বরের শুরুতে মসুল বাঁধের পানির স্তর নিচে নামানোর পর প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটি উন্মোচিত হয়। ইরাকের এই অঞ্চলটি এমনিতেই কম বৃষ্টিপাত এবং চলমান খরার দ্বারা জর্জরিত। জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী মাসের মধ্যে, প্রত্নতাত্ত্বিকরা প্রাচীন শহরটির যতটা সম্ভব মানচিত্র তৈরি করতে এবং খনন করতে দৌড়েছিলেন।
১৯৮০-এর দশকে মসুল বাঁধ নির্মাণের পর থেকে এই সাইটটি ক্রমাগত পানির নিচে চলে যায়। আশ্চর্যজনকভাবে গত তিন বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো মসুল জলাধারের জলের স্তর অনেকটাই নেমে যায়, তারপরেই গবেষকরা এই হারিয়ে যাওয়া শহরের সন্ধান পান। প্রাচীন শহরটির সংরক্ষণের জন্য প্রত্নতাত্ত্বিকরা ধ্বংসাবশেষটিকে প্লাস্টিকের আবরণ দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলেন এবং স্থানটিকে নুড়ি দিয়ে পূর্ণ করে দিয়েছিলেন যাতে কাদামাটির দেয়াল রক্ষা করা যায়।
তবে গবেষকরা চিন্তিত কারণ ফেব্রুয়ারী থেকে বাঁধের পানির স্তর ধীরে ধীরে বাড়ছে এবং শহরটি এখন আবার ডুবে গেছে। বাঁধের পানি আবার কবে নামবে এবং জেগে উঠবে হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস তা এখন সময়ের ওপর নির্ভর করছে বলে জানাচ্ছেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা।
এর আগে ইরাকে মাটির তৈরি বহু পুরনো একটি মসজিদের সন্ধান পাওয়া গেছে। সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, ডাই কার অঞ্চলে সন্ধান পাওয়া মসজিদটি ৬০ হিজরি অর্থাৎ ৬৭৯ খ্রিস্টাব্দের দিকে উমাইয়া যুগে তৈরি করা হয়ে থাকতে পারে।
যেহেতু ইসলামের প্রাথমিক যুগের সুনির্দিষ্ট ইতিহাস আমাদের অনেকটাই অজানা, এ কারণে ওই সময়ের একটি মসজিদের সন্ধান পাওয়ার ঘটনাকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭১৫
আপনার মতামত জানানঃ