পাকিস্তানের ‘গুমের শিকার’ ব্যক্তিদের অধিকার রক্ষায় এগিয়ে এসেছেন আদালত। গত বছরের ১ ডিসেম্বর ইসলামাবাদ হাই কোর্ট (আইএইচসি) প্রস্তাব দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী ও ফেডারেল মন্ত্রিসভা যেন নিখোঁজ ব্যক্তিদের বৈধ উত্তরাধিকারীদের ক্ষতিপূরণ দেয়, যেহেতু নাগরিকদের নিরাপত্তা এবং গোয়েন্দা ও তদন্ত সংস্থাগুলোর তদারকি করা তাদেরই দায়িত্ব।
নিখোঁজ সাংবাদিক মুদাসসর নারুকে খুঁজে বের করার জন্য দায়ের করা পিটিশনের শুনানির সময় আইএইচসির প্রধান বিচারপতি আতহার মিনাল্লাহ ফেডারেল মানবাধিকার মন্ত্রী শিরিন মাজরাইকে বলেন তিনি যেন মন্ত্রিসভাকে এ পরামর্শ দেন।
তারই ধারাবাহিকতায় গত রোববার(২৯ মে) আইএইচসি ফেডারেল সরকারকে সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল (অব.) পারভেজ মোশাররফ ও তার পরবর্তী শাসকদের—তাদের মধ্যে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফও আছেন—বলপূর্বক গুমের ব্যাপারে নোটিশ জারি করেছেন।
গুম-সংক্রান্ত নীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ইসলামাবাদের হাই কোর্ট। এছাড়া গত কয়েক বছরে অনেকগুলো নিখোঁজ হওয়ার ঘটনার উদাহরণও আদালত টেনেছেন।
আইএইচসির প্রধান বিচারপতি আতহার মিনাল্লাহ রোববার সাংবাদিক মুদাসসর নারুসহ আরও পাঁচ ব্যক্তির গুম হওয়া নিয়ে দায়ের করা পিটিশনের চূড়ান্ত যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের মামলায় ১৫ পৃষ্ঠার একটি আদেশ জারি করেন।
এ আদেশে মিনাল্লাহ বলেন, বলপূর্বক গুমের নীতিকে নীরব অনুমোদন দিয়ে এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে বিশেষ করে সামরিক বাহিনীকে এর সঙ্গে জড়িয়ে জাতীয় নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগের জন্য পারভেজ মোশাররফ ও তার পরবর্তী সব শাসকের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, এর ব্যাখ্যা দিতে হবে তাদের।
মিনাল্লাহ বলেন, ‘পারভেজ মোশাররফ তার আত্মজীবনী “ইন দ্য লাইন অভ ফায়ার”-এ অকপটে স্বীকার করেছেন যে “বলপূর্বক গুম” রাষ্ট্রের একটি অঘোষিত নীতি ছিল।’
আদেশে বলা হয়, নাগরিকের মানবাধিকার ও স্বাধীনতা লঙ্ঘন হয়, এমন কর্মকাণ্ডে সশস্ত্র বাহিনীর জড়িত থাকা কিংবা জড়িত থাকার ধারণা আইনের শাসনকে দুর্বল ও ক্ষুণ্ন করে।
বিচারপতি মিনাল্লাহ বলেন, যদি গুম হওয়া ব্যক্তিদের উদ্ধার করা না হয় অথবা কার্যকর ও লক্ষণীয় পদক্ষেপ বা সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় (ফেডারেল) সরকার গ্রহণ না করে, তাহলে বর্তমান ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের সশরীর আদালতে হাজির হতে হবে। অভিযোগের পর ব্যবস্থা গ্রহণ ও সহানুভূতি প্রদর্শনে অনীহায় আবেদনকারীরা যে অকল্পনীয় যন্ত্রণা ও বেদনাবোধের শিকার হয়েছেন, এ কারণে কেন তাদের (স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) বিরুদ্ধে আবেদন (পিটিশন) গ্রহণ ও তাদের ওপর দৃষ্টান্তমূলক ক্ষতিপূরণ আরোপ করা হবে না, সে ব্যাখ্যা তাদের দিতে হবে।
নাগরিকের মানবাধিকার ও স্বাধীনতা লঙ্ঘন হয়, এমন কর্মকাণ্ডে সশস্ত্র বাহিনীর জড়িত থাকা কিংবা জড়িত থাকার ধারণা আইনের শাসনকে দুর্বল ও ক্ষুণ্ন করে।
সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়ায় জাতীয় সংসদেরও নিন্দা জানান ইসলামাবাদ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি আতহার মিনাল্লাহ। একইসঙ্গে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার না করায় গণমাধ্যমের ভূমিকারও সমালোচনা করেন তিনি।
প্রশ্নবিদ্ধ এই নীতিমালার জন্য প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রের কোন অংশীদার দায়ী তা প্রধান বিচারপতি নিঃসন্দেহেই ভালোমতো জানেন। নেতৃত্বদানে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ প্রয়োজন। দেশের শাসকদের সরাসরি দায়ী করে তিনি এই সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন। ফলে যে শক্তিগুলো আড়ালে রাষ্ট্রপ্রধানদের পরিচালনা করে, তাদের প্রতি মৌন বা অন্যকোনো সমর্থন প্রকাশের ক্ষেত্রেও ভবিষ্যতে অন্যরা চাপে থাকবেন।
চলতি বছরের শুরুতে বলপূর্বক গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের কার্যকারিতা নিয়ে হাইকোর্টে পেশ করা একটি প্রতিবেদন থেকে বিষয়টি স্পষ্ট যে নিখোঁজ ব্যক্তিদের উদ্ধারের চেষ্টা খুব সামান্যই কাজে এসেছে। এমনকি আদালতের নির্দেশ ছিল এমন নিখোঁজ ব্যক্তিদের খুঁজে পেতেও কমিশনকে প্রায়ই ব্যর্থ হতে দেখা গেছে।
যত গুরুতর অপরাধের অভিযোগই থাকুক না কেন, কোনো নাগরিককে বলপ্রয়োগ করে গুম করার যৌক্তিকতা থাকতে পারে না। এই নীতি সমর্থনকারীদের দাবি, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড রোধে কখনও কখনও এটাই একমাত্র কার্যকর পন্থা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বিদ্যমান আইনি ব্যবস্থায় মাধ্যমে অপরাধ প্রতিরোধ, তদন্ত ও বিচারিক দায়িত্বপালনে কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতাকেই তা তুলে ধরে।
এই ব্যর্থতাগুলো শুধু অবিশ্বাসের দুষ্ট চক্রকেই টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে। বলপূর্বক গুমের ঘটনা প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলোর দুঃখ, হতাশা ও বিচ্ছিন্নতা বোধ আরও বাড়িয়ে তুলে। ফলে রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডেও তাদের সমর্থন বাড়ে।
বেলুচিস্তানে জোরপূর্বক গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সবচেয়ে বেশি। প্রদেশটিতে শাসন করা এখন রাষ্ট্রের জন্য দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে। ত্রুটিপূর্ণ নীতিমালার কারণেই রাষ্ট্র নাগরিকদের মন জয় করতে ব্যর্থ। কৌশলগত এই নীতি বদলে ফেলার এখনই সময়।
এদিকে গুম কীভাবে ‘রাষ্ট্রীয় নীতি’তে পরিণত হয়েছে, তার ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য রোববার সরকারপ্রধানদের নির্দেশ দিয়েছিলেন পাকিস্তানের ইসলামাবাদ হাই কোর্ট (আইএইচসি)।
আইএইচসির এ নির্দেশের পর গতকাল সোমবার ফেডারেল সরকার গুমে ‘মৌন সম্মতির নীতি’র বিষয়ে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করেছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, আইন ও বিচারমন্ত্রী আজম নাজির তারার নেতৃত্বে গঠিত কমিটিতে থাকবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রানা সানাউল্লাহ, পাওয়ার অ্যালেভিয়েশন অ্যান্ড সোশ্যাল সেফটি মন্ত্রী শাজিয়া মারি, যোগাযোগমন্ত্রী আসাদ মাহমুদ, প্রতিরক্ষা উৎপাদন মন্ত্রী মুহাম্মদ ইসরার তারিন, সমুদ্রবিষয়ক মন্ত্রী ফয়সাল আলী সাবজওয়ারী এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী আগা হাসান বালুচ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০৩২
আপনার মতামত জানানঃ