ভোটকেন্দ্রে ইভিএমের বাটন টিপতে না পারলে টিপে দেওয়ার জন্য নিজের লোক রাখবেন বলে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী মুজিবুল হক চৌধুরী। তিনি আরও বলেছেন, ইভিএম না থাকলে রাতেই সব ভোট নিয়ে ফেলতেন।
চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার চাম্বল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নৌকা প্রতীকের প্রার্থী বর্তমান চেয়ারম্যান মুজিবুল হক চৌধুরী নির্বাচনী সভায় এমন বক্তব্য দিয়েছেন। গত শনিবার দেওয়া এ বক্তব্যের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
প্রায় ৪১ সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মুজিবুল হক চৌধুরী চট্টগ্রামের ভাষায় ভোটারদের উদ্দেশে হ্যান্ডমাইকে বলেন, ‘তো এখানে ইভিএম একটা করেছে সরকার। তো কী করতাম। একটু কষ্ট করে গিয়ে আঙুলে চাপ দিয়ে ভোট দিতে হবে। চাপ দিতে না পারলে চাপ দেওয়ার জন্য সেখানে আমি মানুষ রাখব। তো আমাকে একটু দোয়া করবেন সকলে।’
তিনি আরও বলেন, ‘রিকশা করে পারেন, যেভাবে পারেন ভোটটা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। কারণ, ইভিএমের ভোট। ইভিএম না হলে আমি কাউকে খুঁজতাম না, ভোট আমি মেরে দিতাম। যেভাবে পারি ভোটটা মেরে দিতাম।’
মুজিবুল হক আরও বলেন, ‘ইভিএমে আইডি কার্ড ঢুকিয়ে দিতে হয়, নইলে হয় না। এটা না হলে আমি রাতেই নিয়ে ফেলতাম। তো আপনারা একটু কষ্ট করেন, আপনাদের একটু কষ্ট করে ওটা নিয়ে যেতে হবে। গিয়ে মেশিনে ফিঙ্গার দিতে হবে। কথা বুঝেননি?
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চাম্বাল ইউনিয়নের বাংলাবাজার ১ নম্বর ওয়ার্ডে নির্বাচনী প্রচারে মুজিবুল হক চৌধুরী এমন বক্তব্য দেন। এ সময় কেউ কেউ তার প্রতি সমর্থন জানান। আবার কেউ কেউ হাসছিলেন।
ভাইরাল হওয়া ওই ভিডিও এবং বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে মুজিবুল হক বলেন, ‘আমি আপনাকে একটু পর ফোন দিচ্ছি। তবে এক দিন পরও তার ফোন আসেনি। তিনি আর ফোনও ধরেননি।’
এ বিষয়ে নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. ফয়সাল আলম বলেন, ভিডিও লিংকটি দেখেছি। আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আগামী ১৫ জুন এখানে ভোট গ্রহণ হবে।
ইভিএম নিয়ে ইসির বক্তব্য
নির্বাচন কমিশনার (ইসি) আনিছুর রহমান বলেছেন, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত। নির্বাচন কমিশন অধ্যাপক জাফর ইকবাল ও অধ্যাপক কায়কোবাদসহ দেশের শীর্ষ বিশজন অধ্যাপককে ইভিএম দেখিয়েছে। তারাও ত্রুটিমুক্ত বলে মত দিয়েছেন। সেজন্য ইভিএমে ভোট কারচুপি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
আনিছুর রহমান বলেন, ইমিএমে শূন্য থেকে ভোট প্রদান শুরু হবে এবং প্রতি ঘণ্টায় কতটি ভোট গ্রহণ করা হয়েছে সেই তথ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পৃথক একটি ট্যাবে সংরক্ষণ করবেন।
আগে ব্যালট নিয়ে অন্য জায়গায় সিল মেরে এনে বাপে ঢুকিয়ে দেওয়া হতো উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইভিএম কেন্দ্রের বাইরে নিয়ে গেলে কোনো কাজ করবে না। তা ছাড়া ইভিএমের সঙ্গে ইন্টারনেটের কোনো সম্পর্ক নেই। তাই বাইরে থেকে এটি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ারও সুযোগ নেই। তা ছাড়া কোন ইভিএম কোন কেন্দ্রে কিংবা কোন বুথে যাবে, সেটি আগে থেকে নির্ধারণ করা থাকবে না। সকাল ৮টার এক মিনিট আগেও ভোট দেওয়া যাবে না।
বিয়ানীবাজার পৌরসভা নির্বাচনসহ সব নির্বাচন প্রভাবমুক্ত থাকবে জানিয়ে নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান বলেছেন, সুষ্ঠুভাবে ভোট গ্রহণ করতে না পারলে আমরা চেয়ার দখল করে থাকব না। নির্বাচন সুষ্ঠু করতে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন রয়েছে। নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠুভাবে ভোট গ্রহণ করতে যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়েছে। নির্বাচনের দিন গোপন কক্ষ ছাড়া প্রতিটি কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা বসানো হবে।
প্রসঙ্গত, আগামী ১৫ জুন ইভিএমের মাধ্যমে বিয়ানীবাজার পৌরসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
ইভিএম কতটা নির্ভরযোগ্য?
বাংলাদেশের রাজনৈতিক আঙ্গিনায় বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়বস্তু ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)। দেশের কয়েকজন স্বনামধন্য বিশেষজ্ঞ এই মর্মে মতামত প্রদান করছেন যে, ইভিএম ম্যানুপুলেট করা প্রায় অসম্ভব। অতএব, এর মাধ্যমে ভোট গ্রহণে কারো কোনো আপত্তি থাকা সমীচীন নয়।
বাস্তব চিত্রটি একটু বিস্তারিত ভাবে দেখা যাক। ইভিএমে অংশ মূলত ২টি। একটি হার্ডওয়্যার। এতে রয়েছে মাদার বোর্ড, মাইক্রোপ্রসেসর ও ভোট গ্রহণের জন্য সংযোজিত অন্যান্য যন্ত্রপাতি। দ্বিতীয় অংশ সফটওয়্যার। এতে রয়েছে অপারেটিং সিস্টেম, ডিভাইস ড্রাইভার, বিভিন্ন ফাইল ও কম্পিউটার এপ্লিকেশন।
যেহেতু ইভিএমে ব্যবহৃত সফটওয়্যারের ওপরই নির্বাচনের ফলাফল নির্ভর করে, তাই এই অংশের নিয়ন্ত্রণ যার হাতে থাকবে তার পক্ষে নির্বাচনের ফলাফল প্রভাবিত করা অত্যন্ত সহজ।
বাংলাদেশে যে সব ইভিএম ব্যবহৃত হয় তা ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত নয়। তাই অনেকেই মনে করছেন, যন্ত্রটি ভার্চ্যুয়ালি ম্যানুপুলেট করা অসম্ভব। এই ধারনাটি ভুল। ইন্টারনেট সংযোগ ছাড়াও একটি কম্পিউটার সিস্টেম হ্যাক করা যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যন্ত্রটির ভেতরে গোপনে মোবাইল সিম জাতীয় আইসি (ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট) স্থাপন করে দূর থেকে ইভিএম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
তাছাড়া ইভিএমের সঙ্গে সংযোজিত যেকোনো ইনপুট পোর্টের মাধ্যমে যন্ত্রটির ভেতর ম্যালওয়্যার (ম্যালওয়্যার-মলিকুলাস কোড) প্রবেশ করিয়ে ভোটের ফলাফল বিকৃতি করা কঠিন কোনো ব্যাপার নয়। ভোটার আইডি কার্ড যেখানে স্ক্যান করা হয় তা এমনই একটি ইনপুট পোর্ট।
বাংলাদেশে যে ইভিএম ব্যবহার করা হচ্ছে তাতে ডিজিটাল অডিট ট্রেইলের একটি ব্যবস্থা আছে বলে শুনেছি। এই ব্যবস্থাটিও যেহেতু সফটওয়্যার চালিত, তাই সোর্স কোড সংক্রান্ত সমস্যাটি এখানে থেকেই যাচ্ছে।
ইলেকশন সংক্রান্ত আইনের প্রায়োগিক দিকের প্রধান শর্ত হচ্ছে পদ্ধতিটি হতে হবে স্বচ্ছ। এ কারণেই ভোটের প্রাক্কালে সব দলের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে ব্যালট বাক্স খুলে দেখানো হয়। কিন্তু ইভিএম মেশিন হচ্ছে এমন একটি অন্ধকার প্রকোষ্ঠ যার ভেতরে আসলে কী ঘটছে তা জানা সম্ভব নয়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৪২
আপনার মতামত জানানঃ