মার্কিন ও পাশ্চাত্য মিডিয়ায় মুসলিমদেরকে খুবই নেতিবাচকভাবে চিত্রিত করা হয়। দুই রাজনীতি বিজ্ঞানী লাখ লাখ প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন।
এসোসিয়েন প্রেসের আউটলেট দি কনভারসেশনে মিডলবারি এবং উইলিয়াম অ্যান্ড মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক এরিক ব্লিচ ও এ মরিটস ভ্যান ডার ভিন তাদের সমীক্ষা প্রকাশ করেন।
তারা বলেন, যে পাশ্চাত্য দুনিয়ার বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়া আউটলেট ও সংস্থাগুলো প্রতিবেদনের ওপর তারা সমীক্ষা চালিয়েছেন। তারা দেখেছেন, গত ২৬ বছর ধরে মুসলিমদের ব্যাপারে নেতিবাচকভাবে লেখালেখি হচ্ছে।
গবেষক দুজন ক্যাথলিক, ইহুদি ও হিন্দুদের মতো সংখ্যালঘুদের নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনও যাচাই করে দেখেছেন। তারা দেখতে পেয়েছেন, এসব ধর্মের চেয়ে মুসলিমদের নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো অনেক বেশি নেতিবাচক হয়।
তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, ওই তিন ধর্ম নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোর ৫০ ভাগ ইতিবাচক, ৫০ ভাগ নেতিবাচক। কিন্তু মুসলিমদের নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোর ৮০ ভাগই নেতিবাচক।
নেতিবাচকভাবে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোতে অনেক সময় পরোক্ষ ও সূক্ষ্মভাবে ইসলাম ও মুসলিমদের সম্পর্কে বক্তব্য থাকে।
ইসলামফোবিয়া কি আমেরিকার রাজনৈতিক হাতিয়ার?
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নাগরিক স্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ করার ইতিহাস বহু পুরনো। শতাব্দী আগে ভুক্তভোগী ছিল ইহুদি ও ক্যাথলিকরা। বর্তমানে লক্ষ্যবস্তু মুসলমানরা। দুই দশক ধরে মিডিয়া আমেরিকানদের মধ্যে মুসলমানদের সন্ত্রাসী হিসেবে ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরেছে। তবে আমেরিকায় ইসলামফোবিয়ার এই বাড়বাড়ন্ত চেহারার পেক্ষাপট তৈরি হয়েছে নাইন ইলেভেনের সন্ত্রাসী হামলার উপর দাঁড়িয়েই।
ইসলামফোবিয়া শব্দটার সূত্রপাত ‘৭০ এর দশকেই হয়, কিন্তু জনপ্রিয় হতে থাকে ‘৯০ এর দিকে এসে। ১৯৮৯ সালে সালমান রুশদি’র ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ বইতে হযরত মুহাম্মাদ (সা)-কে অপমান করা হয়, যার ফলশ্রুতিতে ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি রুশদির মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে ফতোয়া দেন। বিশ্ব তখন প্রথমবারের মতো দেখলো কীভাবে কোনো ফৌজদারি অপরাধ কিংবা খুনখারাবি না করেও কেউ মৃত্যুহুমকি পেতে পারে এবং সে হুমকি আসে ধর্ম থেকেই।
১৯৮৯ সালের ঘটনার পর থেকে মানুষ ইসলাম ধর্মকে ভয় পেতে থাকে। এ ধর্মকে বর্বর আর মৃত্যু-আনয়নকারী হিসেবে জানতে থাকে। ‘ইসলামোফোবিয়া’ শব্দের অর্থই তাই, ইসলামে প্রতি ভীতি, ইসলাম নামের আদর্শকে ভয় পাওয়া, ইসলাম ধর্ম পালনকারীদের কাছ থেকে ক্ষতির আশংকা করা।
আর তাই হয়তো যুক্তরাষ্ট্রে লাখ লাখ মুসলমান চিকিৎসক, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, আইনজীবী এবং অন্যান্য পেশাজীবী কীভাবে দেশটির সামগ্রিক উন্নয়নের ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন, তা নিয়ে এসব সংবাদমাধ্যমে খুব কমই খবর হয়েছে। ২০১৮ সালে ইউনিভার্সিটি অব আলাবামা পরিচালিত একটি জরিপে দেখা গেছে, ২০০৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে অমুসলিম নাগরিকদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ে সেখানে যে পরিমাণ খবর প্রচার করা হয়েছে, কোনো সন্ত্রাসী ঘটনায় মুসলমানরা জড়িত থাকলে সে তুলনায় ৩৫৭ গুণ বেশি খবর প্রচার করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকজনের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে, তাদের ওপর মাত্রাতিরিক্ত নজরদারি আরোপ করে এবং তাদের দেশ থেকে বের করে দিয়ে রাজনীতিকেরা মিডিয়াকে মুসলমানদের খল চরিত্র হিসেবে চিত্রায়িত করার বৈধতা দিয়েছেন।
এমনকি বর্ণবাদের ইভ্যালুয়েশনে ধর্ম সেখানে যুক্ত হয়েছে আমেরিকার হাত ধরেই। পূর্বে একজন লোকের শরীরের গড়ন, তার গায়ের রং, চুলের রং, তার মুখের আকৃতি—এসব দেখে তার জাতীয়তার উৎস সম্পর্কে ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সে অনুযায়ী সে সমাজের কোন স্তরে কীভাবে কতটুকু মর্যাদা পাবে, তা সামাজিকভাবে নির্ধারিত হয়ে থাকে। কিন্তু আমেরিকার প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্টানদের একটি বড় অংশ ঐতিহাসিকভাবে এই জাতিগত পরিচয়ের বাইরে ধর্মীয় পরিচয়কে বর্ণবাদের ভিত্তি হিসেবে ধরে এসেছে। তারা প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্টান নয়, এমন গোত্র বা অন্য ধর্মের অনুসারীদের প্রতি ঐতিহাসিকভাবে বর্ণবাদী আচরণ করে থাকে।
১৮৮০ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ এবং পূর্ব ইউরোপের লাখ লাখ অভিবাসী যখন যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিল, তখন তারা স্পষ্টতই সেখানে বর্ণবাদী আচরণের শিকার হিসেবে নিজেদের দেখতে পেয়েছিল। এই লোকেরা ইউরোপিয়ান বংশোদ্ভূত ইহুদি ও ক্যাথলিক ছিল। আমেরিকার তৎকালীন আইন অনুযায়ী তারা সামাজিকভাবে ‘মধ্যম মানের’ নাগরিকের স্বীকৃতি পেয়েছিল। তাদের কৃষ্ণাঙ্গ, আদিবাসী আমেরিকান ও এশিয়ানদের চেয়ে উচ্চ স্তরের নাগরিক মনে করা হলেও তাদের উত্তরাঞ্চলীয় ইউরোপিয়ান প্রোটেস্ট্যান্টদের চেয়ে নিম্নস্তরের ভাবা হতো।
সে সময় যেভাবে ইহুদিবিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছিল, আজ ঠিক একইভাবে ইসলামভীতি ছড়ানো হচ্ছে। বিংশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়ায় ইহুদিদের চোখের রং, নাকের গঠন, মুখের আদল—ইত্যাদি নিয়ে নেতিবাচকভাবে মন্তব্য করা হতো। এই ধারাবাহিক প্রচারের ফলে ১৯৩৮ সাল নাগাদ আমেরিকানদের মধ্যে এই বিশ্বাস জন্মাল যে ইহুদিদের খারাপ কাজের কারণেই ইউরোপে তাদের ওপর নির্যাতন করা হয়েছিল এবং সেই নির্যাতন তাদের পাওনা ছিল।
এদিকে মুসলিমদের নিয়েও দুই দশক ধরে ধারাবাহিক প্রচারের ফলে ২০১৭ সাল পর্যন্ত অবস্থা যা দাঁড়ায় তা ভয়াবহ। পিউ রিসার্চের এক জরিপে দেখা যাচ্ছে, ৫০ শতাংশ আমেরিকান মনে করে মুসলমানরা মূলধারার মার্কিন নাগরিক নন। ৪৮ শতাংশ আমেরিকান মুসলমানদের বিষয়ে উষ্ণ অনুভূতি প্রকাশ করেছেন।
দেখা যাচ্ছে অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায়, বিশেষ করে নাইন–ইলেভেন হামলার পর আমেরিকায় মুসলমানদের কোণঠাসা করার চেষ্টা হয়েছে। ক্রিশ্চিয়ানিটিকে স্বাভাবিক হিসেবে ধরা হলেও ইসলামকে ভয়ংকর একটি মতাদর্শ হিসেবে তুলে ধরায় যুক্তরাষ্ট্রে গোটা মুসলিম সম্প্রদায় বেকায়দায় পড়েছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯৫২
আপনার মতামত জানানঃ