বাংলাদেশে মাঝে-মধ্যেই পোশাকের কারণে নারীদের বিব্রত হবার ঘটনার খবর গণমাধ্যমে আসে। এমনকি নির্যাতনের শিকার হওয়া নারীকে উল্টো তার পোশাকের জন্য দায়ী করার প্রবণতাও দেখা যায়। সম্প্রতি কপালে টিপ পরা নিয়ে এক পুলিশ সদস্য একজন শিক্ষিকাকে হেনস্থা করার অভিযোগ নিয়েও তুমুল শোরগোল হয়েছিলো।
সম্প্রতি ঢাকা যাওয়ার পথে আধুনিক পোশাক পরায় এক তরুণীকে হয়রানি ও মারধরের অভিযোগ উঠেছে। বুধবার (১৮ মে) নরসিংদী রেল স্টেশনে এ হামলার ঘটনা ঘটে।
এদিকে নরসিংদী রেলস্টেশনে পোশাকের জন্য তরুণীকে হেনস্তার প্রতিবাদ জানাতে নিজেদের ‘পছন্দমতো পোশাক’ পরে স্টেশনটিতে গিয়েছেন ২০ জন নারী-পুরুষ।
আজ শুক্রবার(২৭ মে) সকাল সড়ে আটটার দিকে ঢাকা থেকে নরসিংদীগামী একটি ট্রেনে করে স্টেশনটিতে যান তারা।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এ যাত্রার নাম তারা দিয়েছেন ‘অহিংস অগ্নিযাত্রা’। অগ্নি ফাউন্ডেশন নামে একটি সংগঠনের সঙ্গে তারা যুক্ত।
তাদের ভাষ্য, ১৮ মে ঢাকা থেকে নরসিংদীতে বেড়াতে যাওয়া এক বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রী রেলস্টেশনে যে আক্রমণ ও সহিংসতার শিকার হয়েছেন, তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে এখানে এসেছেন তারা। এটিকে তারা প্রতিবাদ হিসেবে দেখছেন। তাদের এ দলে শিল্পী, সংগঠক, নাট্যকর্মী, চলচ্চিত্র নির্মাতা, আলোকচিত্রী, গবেষক, উন্নয়নকর্মী ও প্রকৌশলীরা আছেন।
দলটির দলনেতা ও অগ্নি ফাউন্ডেশনের সভাপতি তৃষিয়া নাশতারান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আজ আমরা নরসিংদী রেলস্টেশন ও এখানকার মানুষদের দেখতে এসেছি। তাদের সঙ্গে আমরা মানবিক যোগাযোগ স্থাপন করতে চেয়েছি। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল, শান্তিপূর্ণভাবে জনপরিসরে শরীর ও পোশাকের স্বাধীনতার জায়গাটা রিক্লেইম করা। আমাদের বৈচিত্র্যময় শারীরিক উপস্থিতিই আমাদের বক্তব্য।’
আমাদের উদ্দেশ্য ছিল, শান্তিপূর্ণভাবে জনপরিসরে শরীর ও পোশাকের স্বাধীনতার জায়গাটা রিক্লেইম করা। আমাদের বৈচিত্র্যময় শারীরিক উপস্থিতিই আমাদের বক্তব্য।’
নরসিংদী রেলস্টেশন সূত্রে জানা গেছে, ট্রেন থেকে নামার পরপরই এই দলটি নানা বয়সী অপেক্ষমাণ যাত্রী ও ভ্রাম্যমাণ দোকানিদের সঙ্গে ১৮ মের ঘটনা নিয়ে কথা বলেন। পরে তারা কয়েকটি উপদলে ভাগ হয়ে স্টেশনের নানা প্রান্তে ঘোরেন। এরপর স্টেশনমাস্টার এ টি এম মুছার সঙ্গে বৈঠক করেন তারা। এর আগে রেলওয়ে পুলিশ ও রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গেও ওই দিনের ঘটনা নিয়ে কথা বলেন দলটির সদস্যরা।
নরসিংদী রেলস্টেশনের মাস্টার এ টি এম মুছা বলেন, ‘দলটি ঢাকা থেকে ট্রেনে করে আমাদের স্টেশনে এসে নেমেছে। তারা স্টেশন ঘুরে দেখেছে এবং এখানকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছে। আমার সঙ্গে তারা বসেছিল, জানতে চেয়েছে ওই দিনের বিস্তারিত। আমিও তাদের ওই ঘটনার সর্বশেষ পরিস্থিতি জানিয়েছি। তারা তরুণী হেনস্তার প্রতিবাদ জানাতে এসেছেন বলে আমাকে জানিয়েছেন।’
গত বুধবার রেলওয়ে স্টেশনের ১ নং প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী ঢাকা মেইল ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন এক তরুণী ও তার দুই বন্ধু। এ সময় স্টেশনে অবস্থানরত মাঝবয়সী এক নারী তাদের দেখে বাজে মন্তব্য করে। ওই তরুণী সেটার জবাব দিলে ওই নারীর সঙ্গে তর্ক হয়। এক পর্যায়ে ওই নারী তরুণীর গায়ে হাত তুলতে গেলে তার দুই বন্ধু প্রতিবাদ করেন। তখন স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন বখাটে তরুণীর দুই বন্ধুর সঙ্গে তর্কে জড়ায় এবং তাদের মারতে যায়। এক পর্যায়ে তারা তিনজন স্টেশন মাস্টারের কক্ষে গিয়ে রক্ষা পান।
এ ঘটনার একটি ভিডিও ওইদিনই ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। পরে রেলওয়ে স্টেশনের ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার ফুটেজ দেখে নরসিংদী রেলওয়ে স্টেশন এলাকা থেকে একজনকে আটক করে পুলিশ। আটক ওই যুবকের নাম মো. ইসমাইল ইসলাম (৩৫)। তিনি নরসিংদী সদর উপজেলার নজরপুর ইউনিয়নের বুদিয়ামারা এলাকার মৃত বাদল মিয়ার ছেলে।
নরসিংদী রেলওয়ে স্টেশন সূত্রে জানা যায়, বুধবার ভোর সোয়া পাঁচটার দিকে নরসিংদী রেলওয়ে স্টেশনে আসেন ওই তরুণী ও দুই তরুণ। সকাল পৌনে ছয়টা পর্যন্ত স্টেশনটির ১ নম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে তাঁরা ঢাকাগামী ঢাকা মেইল ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এ সময় স্টেশনে মধ্যবয়সী এক নারী ওই তরুণীকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘এটা কী পোশাক পরেছো তুমি’। তরুণীও পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘আপনার তাতে কী সমস্যা হচ্ছে?’ এ নিয়ে তাদের মধ্যে বাগবিতণ্ডা শুরু হয়। এর মধ্যে সেই বিতর্কে যোগ দেন স্টেশনে অবস্থানরত অন্য কয়েকজন ব্যক্তি।
ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটিতে দেখা যায়, ওই তরুণীকে ঘিরে রেখেছে একদল ব্যক্তি। এর মধ্যেই এক নারী উত্তেজিত অবস্থায় তার সঙ্গে কথা বলছেন। বয়স্ক এক ব্যক্তিও তার পোশাক নিয়ে কথা বলছেন। একপর্যায়ে ওই তরুণী সেখান থেকে চলে যেতে উদ্যত হলে ওই নারী দৌড়ে তাকে ধরে ফেলেন। এ সময় অশ্লীল গালিগালাজ করতে করতে তার পোশাক ধরে টান দেন ওই নারী। কোনোরকমে নিজেকে সামলে দৌড়ে স্টেশনমাস্টারের কক্ষে চলে যান তরুণী।
এ সময় তার সঙ্গে থাকা দুই তরুণকেও মারধর করতে দেখা যায় ঘটনাস্থলে থাকা কয়েকজন ব্যক্তিকে। পরে তারাও দৌড়ে স্টেশনমাস্টারের কক্ষে চলে যান। পরে ভুক্তভোগী তরুণী জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯-এ ফোন দিলে নরসিংদী মডেল থানার পুলিশ রেলস্টেশনে এসে তাঁদের ঢাকার ট্রেনে উঠিয়ে দেয়।
ওই রাতেই ভৈরব রেলওয়ে থানায় মামলা করেন নরসিংদী রেলওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ইমায়েদুল জাহেদী। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১০ ও ৩০ ধারা এবং দণ্ডবিধির ১৪৩, ৩২৩ ও ৫০৬ ধারায় মামলাটি করা হয়। মামলায় মো. ইসমাইল ও শিলা আক্তারের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা আরও একজন নারী ও ৮ থেকে ১০ জন পুরুষকে আসামি করা হয়।
গত সোমবার ইসমাইলকে এই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করা হলে তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। তবে তরুণীকে গালিগালাজ, মারধর, শ্লীলতাহানি ও মুঠোফোনে ছবি তোলার অভিযোগে মামলার আসামি ওই নারীকে এখনো গ্রেপ্তার করা যায়নি।
রেলওয়ে পুলিশের ভাষ্য, ‘ওই নারীকে শনাক্ত ও চিহ্নিত করা হয়েছে। তিনি বারবার স্থান ও মুঠোফোন নম্বর পরিবর্তন করছেন। দ্রুতই তাকে আমরা আইনের আওতায় নিয়ে আসব।’
মামলার এজাহার থেকে জানা গেছে, তরুণীকে হেনস্তা করা ওই নারীর নাম শিলা আক্তার ওরফে সায়মা (৪৫)। তিনি নরসিংদী শহরের সদর উপজেলা মোড়ের ভাড়াটিয়া ফয়েজ আহমেদের স্ত্রী। প্রথম স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি ফয়েজ আহমেদকে বিয়ে করেন। স্থানীয়ভাবে ওই নারী একজন ঘটক হিসেবে পরিচিত।
ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ও সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ওই নারীকে শনাক্ত করা হয়। গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ ও দেশজুড়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হলে তিনি বাসা ছেড়ে চলে যান।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সবার রুচি এক নয়। তা হওয়ার দরকারও নেই। আলাদা রুচির লোক দেখলে যদি আমাদের অনুভূতি আহত হয়, যদি তাকে মারার ইচ্ছা হয়, তাহলে আমরা যখন চিকিৎসা নিতে ভারতে যাই, বেড়াতে যাই নেপালে, কিংবা কাজের সন্ধানে ইউরোপে গিয়ে হাজির হই; তখন কোথায় থাকে সেই রুচির অহংকার, অনুভূতি সুরক্ষার দাপট?
তারা বলেন, গায়ে হাত তোলা তো দূরের কথা, অপমান করার অধিকারও সংবিধান কাউকে দেয়নি। তালিবান শাসনের মতো করে নারীদের দেখার প্রবণতা বাড়ছে।
তারা আরও বলেন, কেউ কেউ বলছেন, ঘটনাটা সাজানো হয়ে থাকতে পারে। সামনে যখন নির্বাচনপূর্ব কালবৈশাখী সময়, তখন অনেক কিছুই হতে পারে। সন্দেহ করা সত্য জানার শর্ত। শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে ছাত্রদের উসকানির পেছনে ধর্মীয় কারণ যত না, তার চেয়ে বেশি দেখা গেছে অন্য কিছু শিক্ষকের পেশাগত ঈর্ষা। তাই নিরপেক্ষ তদন্ত জরুরি।
নরসিংদী স্টেশনে কে উসকানি দিয়েছিল, কারা মারার জন্য তৈরি হয়েছিল; সেটা বের করা দরকার। তাদের শাস্তি না হলে এ রকম ঘটনা ঘটার হার বেড়ে যাবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮২৯
আপনার মতামত জানানঃ