ইতিহাসের তথ্যপ্রমাণ বলে, রঘু ডাকাত জন্মেছিলেন অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে, অবিভক্ত বাংলার এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে। জন্মসূত্রে তার নাম রঘু ঘোষ। সে প্রায় দুশো বছর আগের কথা। সুতানুটি, গোবিন্দপুর, কলিকাতায় তখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাহেবপ্রভুরা। আর বাংলার গ্রামদেশে দমন-পীড়ন চালাচ্ছে নীলকর সাহেবদের দল।
নীল চাষে জমির উর্বরতা নষ্ট হতো। অন্য ফসল ফলত না আর। কিন্তু সেসব কথা লালমুখোরা শুনবে কেন! যেসব চাষিরা নিজেদের জমিতে নীল চাষে আপত্তি জানাত, তাদের পেয়াদা দিয়ে তুলে আনত তারা। চলত মারধর, অত্যাচার। বাদ যেত না চাষিদের পরিবার পরিজনেরাও।
শোনা যায়, রঘু ডাকাতের বাবাও ছিলেন এমনই একজন সাধারণ কৃষক। নীল চাষে রাজি না হওয়ায় নীলকরের পেয়াদা এক রাতে তাকে তুলে নিয়ে যায়। সাহেবকুঠিতে ভয়ংকর অত্যাচারে অসহায়ভাবে মারা যান রঘুর বাবা। বাবার এই নির্যাতন আর অন্যায় মৃত্যু মেনে নিতে পারেননি তরুণ রঘু। এই হত্যার বদলা নিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন তিনি। ছেলেবেলা থেকেই লাঠি খেলায় বেশ পোক্ত ছিলেন রঘু। নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের সামনে সেই লাঠিকেই অস্ত্র হিসেবে তুলে নিলেন তিনি। তার পাশে এসে দাঁড়াল একরোখা আরো একদল মানুষ। গড়ে উঠল লাঠিয়াল বাহিনী। যাদের প্রথম কাজই ছিল নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো।
দলবল নিয়ে একের পর এক নীলকুঠিতে চড়াও হন রঘু ঘোষ। লুটপাট চালান, জ্বালিয়ে দেন নীলকরদের ঘরবাড়ি। ধীরে ধীরে এলাকার অত্যাচারী জমিদার-মহাজনদের ত্রাস হয়ে ওঠেন রঘু।
শুধু নীলকরদের অত্যাচারের প্রতিশোধ নেওয়াই নয়, ছোটবড় যেকোনো শোষণযন্ত্রের কাছেই রঘু ডাকাত ছিল মূর্তিমান যম। সদলবলে বড়লোকদের বাড়িঘর টাকাপয়সা লুঠ করা শুরু করেছিল তারা। সে সময় যারাই সাধারণ মানুষের সম্পদ কুক্ষিগত করত, তাদের বাড়িতেই হানা দিত রঘু ঘোষের দল। জ্বালিয়ে দেওয়া হতো জমির বেনামি দলিল, পুড়িয়ে দেওয়া হতো অন্যায়ভাবে হস্তগত করা গরিবের ধন-সম্পদের খতিয়ান। প্রায় কপর্দকশূন্য করে ছেড়ে দেওয়া হতো তাদের। কখনো কখনো পিটিয়ে মারা হতো অত্যাচারী শোষক জমিদার জোতদারদের। আর লুণ্ঠিত টাকা পয়সার সবটাই ভাগ-বাটোয়ারা করে দেওয়া হতো সাধারণ গরিব প্রজাদের মধ্যে।
সাধারণ মানুষের মধ্যে দিন দিন বাড়ছিল রঘু ডাকাতের জনপ্রিয়তা। বাড়ছিল শক্তিও। প্রায় এক অঘোষিত যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছিল তারা অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে। আত্মবিশ্বাস এতটাই বেশি ছিল এই ডাকাতদলের যে ডাকাতির আগে অগ্রিম চিঠি দিয়ে অপরপক্ষকে জানিয়ে লুঠতরাজে আসত। রীতিমতো বলে-কয়ে ডাকাতি আর কী! সেই চিঠি যারা পেত তাদের মনের অবস্থা কেমন হতো কল্পনা করা যায়? গ্রামের বেহাল যোগাযোগ ব্যবস্থাও এক্ষেত্রে সহায় হতো ডাকাতদলের। থানায় যোগাযোগ করে পুলিশ পেয়াদার ব্যবস্থা করতে করতেই ডাকাতির দিন এসে যেত।
ডাকাতির ব্যাপারে রঘুর দল ছিল অপ্রতিরোধ্য আর নিষ্ঠুরও। এক্ষেত্রে তাদের ভাগ্যকেও বেশ সুপ্রসন্নই বলতে হয়। বহু চেষ্টা করেও পুলিশের জালে একবারের জন্যও ধরা পড়েননি রঘু ডাকাত। উপরন্তু তার ডাকাতি করার অভিনব কায়দাকানুন লোকের মুখে মুখে আরো পল্লবিত হয়ে এক আশ্চর্য রোম্যান্টিসিজমের জন্ম দিয়েছিল।
কীভাবে শ্বেতাঙ্গ পুলিশদের নাকাল হতে হতো রঘুর চালাকির কাছে, তা নিয়ে বেশ মজার মজার গল্পও। এই জনপ্রিয়তা, সাধারণের ঘরের লোক হয়ে ওঠা, এটাই ছিল রঘু ডাকাতের ক্রম সাফল্যের চাবিকাঠি। ডাকাত নয়, সাধারণ মানুষের চোখে তারা প্রায় বিপ্লবীর মর্যাদা পেতে শুরু করেছিল সেসময়।
বাংলার ডাকাতদের অধিকাংশই মা কালীর পরম ভক্ত ছিলেন। অমাবস্যার রাতে ভক্তি সহকারে কালী পুজো করে, সিঁদুর আর বলির রক্ত মেশা তিলক পরে তবেই লুঠপাটের বের হতেন তারা। আর রঘু ডাকাতের কালীভক্তির গল্প! সে তো প্রায় মিথ হয়ে গেছে।
কলাকাতার যে সাতটা গ্রাম নিয়ে সপ্তগ্রাম বন্দর, তার অন্যতম গ্রাম বাসুদেবপুর। সপ্তগ্রাম থেকে পাণ্ডুয়ার দিকে যেতে পূর্ব দিকে নেমে গেছে এক পায়ে চলা পথ, জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এই পথ এঁকেবেঁকে গিয়ে মিশেছে সুদূর গঙ্গাতীরে, ত্রিবেণীতে। এটা সেই সময়ের কথা যখন গরুর গাড়ি ভিন্ন যানবাহন ছিল না। সাধারণ মানুষ পায়ে হেঁটেই পাড়ি দিত ক্রোশের পর ক্রোশ পথ। ত্রিবেণীতে গঙ্গাচানের সংকল্প নিয়ে সে সময় বহু পুণ্যার্থী মানুষের যাতায়াত ছিল ঘন জঙ্গলে ঢাকা এই সুঁড়িপথে।
আপাতদৃষ্টিতে ছায়াসুনিবিড় শান্ত হলেও, ভুক্তভোগীরা জানতেন এ পথ কতো ভয়ঙ্কর! এ পথের উত্তর পাড়ে বাঘটি গ্রাম, এই বাঘটি জয়পুর গ্রামেই সে সময় আস্তানা গেড়েছিল রঘু ডাকাতের দল। তারা দিনের বেলা আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো ক্ষেতমজুরের কাজ করত, আর সূর্যাস্তের পর রাতে এলাকার ধনী ও প্রভাবশালীদের বাড়িতে ডাকাতি করতে বেরোত।
যদিও অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, রঘু ডাকাত খাস কলকাতার মানুষ। কিন্তু তার কাজের জায়গা ছিল হুগলি, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া এই তিন জেলা। বাংলার অর্ধেকই তখন ঘন জঙ্গল। গহন নদীপথ, আর পায়ে চলা পথে ঠ্যাঙাড়ে, ডাকাত আর জলদস্যুদের বাড়বাড়ন্ত। তাদের উৎপাতে দেশিয় জমিদারদের পাশাপাশি ইংরেজপ্রভুদেরও নাভিশ্বাস উঠেছে তদ্দিনে। নড়ে বসেছে প্রশাসনও। উঁচুতলার আদেশে প্রতিটি থানায় সেসময় খোলা হয়েছিল ডাকাত ধরার আলাদা দফতর। ডাকাতদের গতিবিধি জানার জন্য গুপ্তচর নিয়োগ করেন পুলিশকর্তারা। থানায় থানায় জারি হয় রেড এলার্ট। পুলিশদের চোখে ধুলো দিতে গা ঢাকা দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে ডাকাতদেরও। একটা নির্দিষ্ট এলাকায় থিতু না হয়ে তারাও ছড়িয়ে পড়ে জেলায় জেলায়, বাংলার বিস্তৃত প্রান্তরে। রঘু ডাকাতের ক্ষেত্রেও সম্ভবত তেমনটাই ঘটেছিল।
বাগহাটির জয়পুরের বাসিন্দা বিধুভূষণ ঘোষ সম্পর্কে রঘু ডাকাতের ভাই। দুই ভাই মিলেই দল চালাত সেসময়। পুলিশের ভয়ে সেসময় দুভাই গা ঢাকা দিয়েছিল দেবীপুরের ঘন জঙ্গলে। সেই বনের মধ্যেই তারা প্রতিষ্ঠা করেন আরাধ্যা মা কালীর মন্দির। রঘু ডাকাতের দলবল জঙ্গলের ভিতর দিয়ে যাওয়া আসা করা ধনী মানুষজনদের টাকাপয়সা কেড়ে নিয়ে তাদের বেঁধে নিয়ে যেত মায়ের মন্দিরে। এরপর অমাবস্যা বা বিশেষ যোগের দিনে পুণ্যতিথি দেখে ঢাকঢোল পিটিয়ে পুরোহিত ডেকে হতো নরবলি। এতেই না কি তুষ্ট হতেন করালবদনা মা কালী। এক চূড়াবিশিষ্ট সেই ডাকাত কালীমন্দির আজও আছে।
লোকশ্রুতি বলে, স্বপ্নাদেশ পেয়ে রঘু এই কালীমূর্তি খুঁজে বের করেছিল এক পুকুরের তলা থেকে। দেবী নিজেই রঘুর পুজো চেয়েছিলেন। এই কালীই বর্তমানে রঘু ডাকাতের কালী নামে জনপ্রিয় ও সিদ্ধেশ্বরী কালী হিসেবে এখনও ভক্তদের পূজা পান। ল্যাটামাছ পোড়া দিয়ে কালীর পুজো করতেন রঘু। আজও দেবীর প্রসাদে একইরকমভাবে ব্যবহার করা হয় পোড়া ল্যাটামাছ।
ডাকাতদের এই আশ্চর্য দেবীভক্তি দেখে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কালী তো আদতে শক্তিদেবী। গায়ের জোরে লুঠতরাজ করাই যাদের পেশা, তারা কালীপুজো করবে না তো কে করবে? তাছাড়া অনেকে যে বলে, কালী মূলে অন্ত্যজ, সেজন্যই কালো এবং রক্তলোভী- সেটাও এই ডাকাতদের কালীপুজোর রীতিকে সমর্থন করে।
রবীন্দ্রনাথের ‘বাল্মীকি প্রতিভা’-তেও তো দস্যু রত্নাকরের কালীপুজো ও নরবলির প্রসঙ্গ এসেছে। যেমন রঘু ডাকাতের নরবলির গল্পের সঙ্গে অবলীলায় জড়িয়ে গেছে সাধক কবি রামপ্রসাদের কাহিনি।
কার্তিকের অমাবস্যা তিথি। কিন্তু সেদিনই পথঘাট আশ্চর্য নিঝুম, জনমানবশূন্য। রঘু পড়লেন মহা বিপাকে। মায়ের বিশেষ পুজোর আয়োজন করা হয়েছে, এদিকে বলির দেখা নেই। ঠিক সেদিনই নিজের বাড়ি হালিশহরে ফিরছিলেন সাধকশ্রেষ্ঠ রামপ্রসাদ। তাড়াতাড়ি ত্রিবেণীর গঙ্গাঘাটে যাওয়ার উদ্দেশ্যে দৈবদুর্বিপাকে রঘু ডাকাতের কুখ্যাত জঙ্গলে পা রাখেন তিনি। আর যাবে কোথায়! বলি দেবার উদ্দেশ্যে তাকেই বেঁধে মন্দিরপ্রাঙ্গনে নিয়ে আসে রঘু ডাকাতের স্যাঙ্গাতেরা। মায়ের সামনে বলি জন্য প্রস্তুত করা হয় রামপ্রসাদকে। হাসিমুখে মায়ের ইচ্ছে জ্ঞান করে ডাকাতদলের সব অত্যাচার সহ্য করেন তিনিও। সামনে রক্তজবায় সাজানো হাড়িকাঠ, খাঁড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জল্লাদ… কিন্তু মরে গেলে মাকে তো আর গান শোনানো হবে না। তাই মৃত্যুর আগে মা কালীর সামনে একটি গান গাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন রামপ্রসাদ। অনুমতি দেন রঘু। উদাত্ত কণ্ঠে মায়ের কৃষ্ণবর্ণা মূর্তির দিকে তাকিয়ে গেয়ে ওঠেন রামপ্রসাদ ‘তিলেক দাঁড়া ওরে শমন বদন ভরে মাকে ডাকি’।
সেদিন সাধক কবি রামপ্রসাদের গলায় এ গান শুনে ঠিক কী ভাবান্তর হয়েছিল কালান্তক রঘু ডাকাতের তা বলা মুশকিল। সে কি নিছকই বিভৎসরস ছাপিয়ে ভক্তিরসের জয় ছিল! জনশ্রুতি মতে, সেদিন যূপকাষ্ঠে রামপ্রসাদের বদলে আরাধ্যা দেবী কালীকেই দেখেছিলেন রঘু। তক্ষুনি রামপ্রসাদকে সসম্মানে মুক্তি দেন তিনি। ক্ষমা চান কবির কাছে। আর এরপর থেকেই মা সিদ্ধেশ্বরীর সামনে নরবলি দেওয়ার প্রথা এক্কেবারে বন্ধ করে দেন রঘু ডাকাত। চালু হয় পাঁঠাবলির রীতি।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯০৫
আপনার মতামত জানানঃ