ডিজিটাল অপরাধ নিয়ন্ত্রণের কথা বলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) প্রণয়ন করা হলেও এর সর্বোচ্চ প্রয়োগ করা হচ্ছে গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর। এ আইনের মাধ্যমে সাংবাদিকদের নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। আইনটির ২০টি জায়গায় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে, যার ১৪টিই জামিন অযোগ্য। প্রণয়নের পর গত ৪ বছরে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ আইনের যথেচ্ছা ব্যবহার করা হচ্ছে। সর্বোপরি দেশের স্বাধীন সাংবাদিকতা বিকশিত হওয়ার বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। সম্পাদক পরিষদ আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
বক্তারা আরো বলেন, গণমাধ্যমের হাত-পা বেঁধে রেখে দেশে গণতন্ত্রের বিকাশ সম্ভব হবে না। এ আইন নিপীড়নমূলক, এটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ভয়াবহতা আমরা উপলব্ধি করছি। গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতার বিকাশের লক্ষ্যে যা কিছু করার আমরা সব কিছু করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ।
শনিবার(১৪ মে) বিকেলে ‘বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস: ডিজিটাল নজরদারিতে সাংবাদিকতা’ শীর্ষক এই আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয় রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে।
গত ৩ মে পালিত হয় ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে বা বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিল জার্নালিজম আন্ডার ডিজিটাল সিজ বা ডিজিটাল নজরদারিতে সাংবাদিকতা। ডিজিটাল নজরদারি বা আক্রমনের মুখে বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকতা যে হুমকি মোকাবিলা করছে সে বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েই এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়।
সম্পাদক পরিষদের ভাষ্য, সম্প্রতি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনও বাংলাদেশে স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য এক নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে সাংবাদিকতায় স্বাধীন ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিতে আলোচনার জন্য উল্লিখিত বিষয়টিকে বেছে নেওয়া হয়েছে।
সভাপতির বক্তব্যে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, স্বাধীন মত প্রকাশের বিরুদ্ধে এত আইন কেন? আমরা কি করি? যার জন্য এত আইন দিয়ে আমাদের হাত-পা বেঁধে দিতে হবে। এখন আবার গণমাধ্যম আদালত, আপিল আদালত এমন নানা আদালত সৃষ্টি কর গণমাধ্যমের হাত পা আরো বেশি বেঁধে দেয়ার প্রয়াস হচ্ছে। আমার একটি সহজ বক্তব্য, গণমাধ্যমের হাত-পা বেঁধে দিয়ে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিকাশ হবে না। গণতন্ত্র আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম একটি চেতনা, একটি স্বপ্ন। তাই আমি মনে করি, গণমাধ্যমের হাত-পা বেঁধে গণতন্ত্রকে ব্যাহত করার চেষ্টা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী।
তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনমুক্ত গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতার বিকাশের অন্তরায়। এ আইনের ভয়াবহতা আমরা উপলব্ধি করছি। এর ১৪টি ধারই জামিন অযোগ্য। ২০টি ধারা আছে সাংবাদিকদের সাজা দেওয়ার জন্য। এটা সবচেয়ে জঘন্য আইন। এ আইন কার্যকর না হলেও ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করে। এ আইন থাকলেই মনে হবে এ আইনে আমাকে যে কোনো সময় আটক করতে পারে।
তিনি বলেন, গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতার বিকাশের লক্ষ্যে প্রয়োজনে সম্পাদক পরিষদ সব কিছু করবে বলেও তিনি অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতার এ দুঃসময় অতিক্রম করতে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম করারও উদ্যোগ গ্রহণ করবে সম্পাদক পরিষদ।
আলোচনায় অংশ নিয়ে নোয়াব সভাপতি এ কে আজাদ তার লিখিত বক্তব্যে বলেন, ‘সংবাদপত্র জগত আজ অনেকটা সংকুচিত। ছাপা কাগজের চাহিদা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে ডিজিটাল বাস্তবতা বিশ্বজুড়ে গণমাধ্যমের জন্য একদিকে যেমন অনেক সুযোগ এনে দিয়েছে, তেমনি সাংবাদিকদের জন্য অনেক ঝুঁকি তৈরি করেছে। তাদের ওপর নজরদারি বেড়েছে।’
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিষয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়ে নোয়াব সভাপতি আরও বলেন, ‘নোয়াব আগেই এই আইনের বিষয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে। আমরা মনে করি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর চাপ সৃষ্টি করছে।’
আমরা মনে করি ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট আমাদের সাংবাদিকতার, আমাদের মত প্রকাশের, আমাদের পেশার বিকশিত হওয়ার ক্ষেত্রে সাংঘাতিক অন্তরায়।’
সাংবাদিকতার স্বাধীনতা কেবল সাংবাদিকদের জন্যই নয়, বরং দেশ ও সমাজের বৃহত্তর স্বার্থেই রক্ষা করা দরকার মন্তব্য করে নিউ এজ’র সম্পাদক নূরুল কবির বলেন, ‘আমরা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছি। ডিজিটাল টেকনোলজি, যা মানুষের পক্ষে হওয়া উচিত ছিল, গণতন্ত্রের পক্ষে হওয়া উচিত ছিল, উন্নয়নের পক্ষে হওয়া উচিত ছিল, তা এখন ব্যবহার হচ্ছে মানুষের চিন্তার বিরুদ্ধে, মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে।’
এই ‘অবরোধ’ থেকে মুক্তির জন্য সংঘবদ্ধভাবে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লড়াই শুরুর তাগিদ দেন তিনি।
এ অবস্থার জন্য সাংবাদিক সংগঠনগুলোর মধ্যকার বিভাজনের বিষয়টিকেও সামনে আনেন ভোরের কাগজ’র সম্পাদক শ্যামল দত্ত। তিনি বলেন, ‘গণমাধ্যমের স্বার্থের জায়গায় আমাদের একত্রিত হওয়া দরকার। অন্যথায় এই সংকটের সমাধান নেই।’
এদিকে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সেল্ফ সেন্সরশিপ বা স্বনিয়ন্ত্রণের মতো বিষয়টি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ধারণ করেছে বলে মনে করেন মানবজমিন’র সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আমরা দেখছি কিন্তু দেখছি না। শুনছি কিন্তু শুনছি না। লিখছি কিন্তু লিখছি না।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই ভয় থেকে মুক্তি পেতে হবে। এ জন্য সম্মিলিত প্রয়াস দরকার।’
বিএফইউজের সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, ‘আমরা বলেছিলাম ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে যদি কোনো সংবাদপত্র বা সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয় তাহলে তা প্রেস কাউন্সিলে পাঠাতে। প্রেস কাউন্সিল ঠিক করুক যে…(সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন) সাংবাদিকতার জন্য ব্যবহার করেছে না ব্যক্তিগত কাজে। যদি ব্যক্তিগত কাজে হয়, ধরেন। আপত্তি নাই। কিন্তু যদি পেশাগত কাজেই ব্যবহার করে তাহলে তাদের প্রোটেকশনটা দিতে হবে। আমাদের কোনো কথা রাখা হয়নি।’
এ অবস্থায় এই সাংবাদিক নেতা যে আইনি-বেআইনি বাধাগুলো সাংবাদিকতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, তার একটি বিশ্লেষণ তৈরি করার তাগিদ দেন সম্পাদক পরিষদসহ দেশের সাংবাদিক ইউনিয়নগুলোকে। পরে তা প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট জায়গাগুলোতে পৌঁছানোর প্রস্তাব রাখেন।
এ ছাড়া অল্পতেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খড়গ নেমে আসার পাশাপাশি ঢাকা ও ঢাকার বাইরে কাজ করা অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের ওপর বিভিন্ন সংস্থার তীক্ষ্ণ নজরদারি জারি আছে বলে মন্তব্য করেন বিএফইউজের একাংশের সভাপতি এম আবদুল্লাহ। এটাকেও স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে একটি গুরুতর সমস্যা বলে মনে করেন তিনি।
আর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে বাংলাদেশের মানুষের কণ্ঠরোধের ‘সবচেয়ে বড় হাতিয়ার’ হিসেবে অভিহিত করেন ডিইউজের একাংশের সভাপতি কাদের গণি চৌধুরী।
তা বাদে বাংলাদেশের সাংবাদিকতা আইনগতভাবেই একটি নজরদারির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন ডিআরইউ’র সভাপতি নজরুল ইসলাম মিঠু।
সমাপনী বক্তব্যে সম্পাদক পরিষদের সভাপতি মাহফুজ আনাম বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের ৪ বছরে আমরা সুস্পষ্টভাবে দেখেছি যে, এই আইনের প্রয়োগ কীভাবে হয়েছে? এটার প্রয়োগ হয়েছে মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে, এটার প্রয়োগ হচ্ছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে, এটার প্রয়োগ হচ্ছে রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে। অথচ এর আসল উদ্দেশ্য ছিল ডিজিটাল অপরাধ প্রতিরোধ।’
দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক আরও বলেন, ‘আমরা মনে করি ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট আমাদের সাংবাদিকতার, আমাদের মত প্রকাশের, আমাদের পেশার বিকশিত হওয়ার ক্ষেত্রে সাংঘাতিক অন্তরায়।’
এ ছাড়া প্রস্তাবিত গণমাধ্যমকর্মী আইন নিয়েও কথা বলেন মাহফুজ আনাম। এ ব্যাপারে তার পর্যবেক্ষণ হলো, ‘আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, এটা গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য একটি আইন। কিন্তু আইনের ভেতরে ঢুকে দেখা যায়, এখানে এমন আইনি জটিলতা সৃষ্টি করা আছে…গণমাধ্যম আদালত, গণমাধ্যম আপিল আদালত যেগুলো আমাদের দেশে এখনও নাই। সেগুলো সৃষ্টি করে আরও বেশি গণমাধ্যমের হাত পা বেঁধে দেওয়ার অপপ্রয়াস চলছে।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬০১
আপনার মতামত জানানঃ