যুদ্ধপ্রবণ এই বিশ্বে অস্ত্রের চাহিদা বরাবরই অক্ষুণ্ণ থাকে। অস্ত্র চাহিদার ওপর নির্ভর করে বিশ্বে অস্ত্রেরও বিশাল বাজার রয়েছে। সেখানে বিশ্বজুড়ে অস্ত্র বিক্রির তালিকায় আমেরিকা শীর্ষে রয়েছে। বিশ্বে যত অস্ত্র বিক্রি হয়, তার এক তৃতীয়াংশ হয় আমেরিকা থেকে।
যুক্তরাষ্ট্রে অস্ত্র বিক্রির সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়েছে। আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে খুনের সংখ্যাও বেড়েছে। প্রতিদিনই দেশটির কোনো না কোনো অঙ্গরাজ্যে বন্দুকের গুলিতে প্রাণ হারাচ্ছেন নিরীহ মানুষ। একদিকে বন্দুক হামলা, অন্যদিকে বন্দুকের গুলিতে আত্মহত্যার সংখ্যায়ও রেকর্ড করছে দেশটি।
মানবাধিকার নিয়ে বুলি আওড়ানো যুক্তরাষ্ট্রেই দিন দিন ভয়াবহ হচ্ছে বন্দুক হামলা। করোনা মহামারিতে যুক্তরাষ্ট্রের স্কুলগুলোতে সুনামির মতো বেড়েছে বন্দুক হামলা। স্কুল-কলেজের পাশাপাশি শপিংমলগুলোতেও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে এ নির্মম ঘটনা। প্রতিনিয়তই অকালে প্রাণ হারাচ্ছেন মার্কিনিরা। দেশটিতে এটি স্বাভাবিক ঘটনা হলেও মহামারিতে অস্বাভাবিক আকার ধারণ করেছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যে বন্দুকধারীর গুলিতে অন্তত ১০ জন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরো তিন জন। যুক্তরাষ্ট্রেরে স্থানীয় সময় শনিবার(১৩ মে) অঙ্গরাজ্যের বাফেলো শহরের একটি সুপারমার্কেটে এ হতাহতের ঘটনা ঘটে। ‘জাতিগত বিদ্বেষ থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে অপরাধ’ হিসেবে হামলাটির তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই। খবর বিবিসি।
স্থানীয় সময় শনিবার সন্ধ্যায় নিউ ইয়র্কে কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যুষিত বাফেলো শহরের একটি সুপার মার্কেটে এই ঘটনা ঘটে।
ঘটনাস্থল থেকে আধা-সামরিক পোশাক পরা ১৮ বছর বয়সী এক শ্বেতাঙ্গ যুবককে স্বয়ংক্রিয় রাইফেলসহ আটক করা হয়েছে।
হতাহতদের মধ্যে রয়েছেন ১১ কৃষ্ণাঙ্গ ও দুই শ্বেতাঙ্গ। টপস ফ্রেন্ডলি মার্কেটের এই হামলার পেছনে বর্ণবিদ্বেষী ও সহিংস চরমপন্থী মনোভাবকে দুষছেন স্থানীয় প্রশাসন।
পুলিশ জানায়, গোলাগুলি শুরু করার আগে শনিবার বিকালে বাফেলো শহরের একটি ব্যস্ত সুপারমার্কেটে ঢোকেন সন্দেহভাজন ব্যক্তি। হামলার দৃশ্য অনলাইনে সম্প্রচার করার জন্য তিনি একটি ক্যামেরা ব্যবহার করেছেন।
দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইয়ের বাফেলো ফিল্ড অফিসে দায়িত্বপ্রাপ্ত স্পেশাল এজেন্ট স্টিফেন বেলঙ্গিয়া সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ‘এই গুলির ঘটনাকে ‘ঘৃণাজনিত অপরাধ এবং জাতিগতভাবে সহিংস চরমপন্থী মামলা’ হিসেবে তদন্ত করা হচ্ছে’।
বাফেলোর পুলিশ কমিশনার জোসেফ গ্রামাগলিয়া বলেন, ‘ওই সন্দেহভাজনের হামলায় ৯ ক্রেতা এবং সুপার মার্কেটে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন।
সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষী ওই পুলিশকর্তা বন্দুকধারীকে লক্ষ্য করে একাধিক গুলি চালিয়েছিলেন। তবে বন্দুকধারীর গুলিতে তিনি নিহত হন।’
একটি দোকানের ভেতরে ওই নিরাপত্তারক্ষীর মুখোমুখি অবস্থানে এলে সন্দেহভাজন ব্যক্তি নিজের গলায় বন্দুক তাক করেন। এ সময় পুলিশ তাকে অস্ত্র ফেলে আত্মসমর্পণ করতে বলেছিলেন, পুলিশ কমিশনার যোগ করেন।
সন্দেহভাজন ওই ব্যক্তিকে বাফেলোর প্রায় ২০০ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে কনক্লিন অঞ্চলের বাসিন্দা পেটন গেনড্রন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দুই কর্মকর্তা সংবাদ সংস্থা এপিকে বিষয়টি জানিয়েছেন।
কর্মকর্তাদের এই বিষয়ে প্রকাশ্যে কথা বলার অনুমতি দেয়া হয়নি এবং নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা তা করেন।
হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি কারিন জ্যঁ পিয়েরে বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই ঘটনা ও এর তদন্তের বিষয়ে নিয়মিত খবর নিচ্ছেন। এই ঘটনায় জো বাইডেন ফার্স্ট লেডিকে সঙ্গে নিয়ে নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা ও তাদের প্রিয়জনদের জন্য প্রার্থনা করেছেন।’
গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক সহিংসতায় ৪১ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে এক হাজার চারশোর বেশি শিশু। এক পরিসংখ্যানে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে মার্কিন কর্তৃপক্ষ। নিহতদের মধ্যে বেশ কয়েকজন চীনা নাগরিক রয়েছেন বলেও পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়।
সম্প্রতি ২০২১ সালের বন্দুক সহিংসতার চিত্র তুলে ধরেছে মার্কিন কর্তৃপক্ষ। এতে বলা হয়, ২০২১ সালে দেশটিতে যে পরিমাণে বন্দুক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে তা ২০ বছরের মধ্যে রেকর্ড। এবছর মারা গেছেন ৪১ হাজারের বেশি মানুষ। ২০২০ সালে সংখ্যাটি ছিল ৩৭ হাজার। আর ২০১৯ সালে বন্দুক সহিংসতায় মারা যান ৩৮ হাজারের বেশি।
আমেরিকায় কালোদের সামান্য অপরাধেই বড় সাজা পেতে দেখা যায়। সাদাদের ক্ষেত্রে বড় অপরাধেও তা হয় না।
বড়দের পাশাপাশি দেশটিতে বন্দুক সহিংসতায় প্রাণ হারাচ্ছে শিশুরাও। গত বছর দেশটিতে বন্দুক হামলায় ১৭ বছরের নিচে এক হাজার চারশো ১০ জন শিশু মারা গেছে। ২০২০ সালে সংখ্যাটি ছিলো এক হাজার তিনশো ৭৫। আর ২০১৮ সালে বন্দুক হামলায় মারা গেছে নয়শো ৯১ জন শিশু।
যুক্তরাষ্ট্রে এই বন্দুক সহিংসতার ঘটনায় নিজ দেশের পাশাপাশি অন্যদেশের নাগরিকরাও প্রাণ হারাচ্ছেন। ২০২১ সালেই যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলায় বেশ কয়েকজন চীনা নাগরিক নিহত হয়েছেন। সরকার থেকে নানা পদক্ষেপ নেয়া হলেও দেশটিতে কমছে না এই বন্দুক হামলার ঘটনা।
যুক্তরাষ্ট্রের আইন ব্যবস্থাও হেইট ক্রাইমের পৃষ্ঠপোষকতা করে। আমেরিকার কালো মানুষদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১৩ শতাংশ, অথচ কারাগারে মোট বন্দির ৪০ শতাংশই হলো এ দেশের কালো মানুষ। নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ব্রেনন সেন্টার ফর জাস্টিস-এর এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০-৩৪ বছর বয়সী এমন প্রতি নয়জন আফ্রিকান-আমেরিকানের একজন এখন জেলে।
আরেকটি গবেষণা বলছে, প্রতি তিনজন আফ্রিকান-আমেরিকানের মধ্যে অন্তত একজনকে জীবনে একবার হলেও জেলে যেতে হয়। যে অপরাধে এরা জেলে, একই অপরাধে সাদা বা বাদামি রঙের মানুষেরা সহজেই ছাড়া পেয়ে যায়। আমেরিকায় কালোদের সামান্য অপরাধেই বড় সাজা পেতে দেখা যায়। সাদাদের ক্ষেত্রে বড় অপরাধেও তা হয় না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মানুষের শরীরের চামড়ার রঙের ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র-সমাজে যে বৈষম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যবস্থা সেটার সূত্রপাত ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক দখল ও আধিপত্যের মধ্য দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদী এই দৃষ্টিভঙ্গি এতটাই গভীরে শিকড় গেড়েছে যে, এর বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াই সত্ত্বেও একবিংশ শতাব্দীতেও এর অবসান হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক শ্বেতকায়ই কালো মানুষদের তাদের পূর্ণ নাগরিক অধিকারের স্বীকৃতি দিতে এখনও প্রস্তুত নয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বন্দুক হামলার উদ্দেশ্য খুঁজে বের করা কঠিন এবং কঠোর নীতি প্রণয়ন করাও কঠিন। কিন্তু বন্দুক হামলার সুযোগ বন্ধ করা তেমন কঠিন নয়। শ্বেতাঙ্গদের শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার সারা দুনিয়াতেই আছে এবং আছে তাদের সহিংস ইচ্ছার বাহার। কিন্তু একজন সহিংস মানুষের হাতে রান্না করার ছুরি বা বেসবল খেলার ব্যাট হাতে যতটা না ভয়ংকর তারচেয়ে অনেক বেশি ভয়ংকর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে। কারণ চোখের পলকেই সে ১০০ রাউন্ড গুলি ছুঁড়তে সক্ষম। আর এ পদ্ধতিটি সন্দেহাতীতভাবে লোভনীয়।
তারা বলেন, কথা খুব স্পষ্ট যে, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের মালিকানা নিয়ে ক্রাইস্টচার্চ হামলার পর নিউজিল্যান্ড যে ধরণের নীতি গ্রহণ করেছে, একই রকম নীতি গ্রহণ করলে যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলার ঘটনা কমতে পারে। কিন্তু এভাবে সব বন্দুক হামলায় মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে না। যেমন সম্ভব হবে না সংবিধান সংশোধন করার মাধ্যমেও। যুক্তরাষ্ট্রের বন্দুক হামলার সমস্যা, ব্রাজিলের বন উজাড় হওয়া বা চীনের বায়ু দূষণের মতোই ভয়াবহ। মানবসৃষ্ট পরিবেশ বিপর্যয় বন্ধ করা কঠিন এবং রাতারাতি পরিবর্তন সম্ভবও নয়। তবে তাই বলে সাহসী মানুষের অভিযাত্রা থেমে থাকবে কেন?
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫১৬
আপনার মতামত জানানঃ