বান্দরবানে জমি ইজারা নেয়া হয়েছে এমন দাবিতে ৪০০ একর পাহাড়ি ভূমি পুড়িয়ে দিয়েছে লামা রাবার কোম্পানি নামে একটি প্রতিষ্ঠান। যেখানে জুম চাষ করে জীবন ধারণ করত তিনটি পাড়ার শতাধিক মানুষ। জুমের জমির সঙ্গে আগুনে পুড়েছে স্থানীয় অধিবাসীদের ফলদ বাগান, বনজ গাছ, বাঁশবাগান। শুকিয়ে গেছে লাংকমপাড়ার ঝিরির পানি। ফলে ভয়াবহ খাদ্য ও পানীয় সংকটে পড়েছে স্থানীয়রা। অন্যদিকে রাবার কোম্পানির হুমকির কারণে পাড়া থেকে বেরিয়ে কাজের সন্ধানে যেতে পারছে না পুরুষরা। এ অবস্থায় কোনোমতে অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাচ্ছে ডলুছড়ি মৌজার লাংকমপাড়া, রেংয়ানপাড়া ও জয়চন্দ্র ত্রিপুরা পাড়ার মানুষ।
এদিকে বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই ইউনিয়ন থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রেং ইয়ান পাড়ায় খাদ্য ও পানির তীব্র সংকট—এমন খবর পেয়ে লামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সেখানে ত্রাণ সহায়তা দিতে ছুটে যান। প্রথমে এলাকাবাসীরা সেই ত্রাণ নিয়ে নিজ নিজ বাড়িতে যান।
কিন্তু পরে তারা লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের পক্ষ থেকে এই ত্রাণ দেওয়া হয়েছে সন্দেহ করে তা ফেরত দেন। রোববার (৮ মে) বেলা ১১টার দিকে এই ঘটনা ঘটে।
লামার ইউএনও মো. মোস্তফা জাবেদ কায়সার গণমাধ্যমকে বলেন, বান্দরবান জেলা প্রশাসকের নির্দেশে সকালে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত পাড়ায় ত্রাণ নিয়ে গেলে বাসিন্দারা প্রথমে ত্রাণ গ্রহণ করেন। কিন্তু, পরে সেখানে রাবার কোম্পানির কর্মীদের উপস্থিতির অভিযোগে সেই ত্রাণ আমাদের ফিরিয়ে দিয়েছে। আমরা ৩৬ পরিবারের জন্য চাল, মসুরের ডাল, মুড়ি, চিড়া, লবণ এবং পানি নিয়ে গিয়েছিলাম। প্রথমে তারা সাদরে গ্রহণ করলেও পরে তা আমাদের ফেরত দেওয়ায় আমরা তা নিয়ে চলে আসি।
লাংকম ম্রো পাড়ার বাসিন্দা যোহন ম্রো বলেন, ‘রোববার সকালে উপজেলা প্রশাসন প্রথমে জয়চন্দ্র ত্রিপুরা পাড়ার সবাইকে ত্রাণ বিতরণ করে। সেখানে মহসিন নামে লামা রাবার কোম্পানির একজন কর্মী ছিল। ত্রাণ বিতরণ করার সময়ও সে বারবার সহযোগিতা করছিল। পরে পাড়াবাসীরা জানার পর সবাই ত্রাণগুলো ফেরত দিয়ে দিই।’
‘যারা এত বিশাল এলাকা আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে তারাই আবার ত্রাণসামগ্রী বিতরণের সময় উপস্থিত থাকবে! এই রাগে ও ক্ষোভে কিভাবে ত্রাণসামগ্রী গ্রহণ করব আমরা! ত্রাণসামগ্রীর মধ্যে চাল, মসুরি ডাল, মুড়ি ও দুই লিটার মিনারেল ওয়াটার ছিল’, বলেন তিনি।
লাংকম পাড়ার বাসিন্দা জহন ম্রো জানান, ২৬ এপ্রিল ম্রো ও ত্রিপুরাদের দীর্ঘদিন ধরে ভোগ দখলে থাকা জুম ফসলসহ আবাদি প্রায় ৩০০ একর জমিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে একমাত্র আয়ের উৎস জুম চাষের সব ফসল পুড়ে খাদ্য সংকটে পড়ে তিন পাড়ার বাসিন্দারা। পরে খাদ্য সহায়তা নিয়ে আসেন লামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। কিন্তু যে রাবার কোম্পানি আমাদের জুম ফসল পুড়িয়ে দিয়ে সবাইকে নিঃস্ব করেছে ওই কোম্পানির একজন কর্মকর্তা হেসে হেসে (উপহাস পূর্বক) ক্ষতিগ্রস্তদের কয়েক জনকে ত্রাণ সহায়তা দেন।
পাড়া প্রধান লাংকন ম্রো জানান, আশপাশের সব পাড়ার লোকজন খাদ্য সংকটে আছেন। প্রসাশনের পক্ষ থেকে সহায়তা দিলে আমরা মাথা নত করে নিবো। কিন্তু যারা আমাদের সবকিছু পুড়িয়ে নিঃস্ব করে দিয়েছে সে কোম্পানির কাছ থেকে মরে গেলেও কিছু নিবো না।
বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের ডলুছড়ি মৌজার জমিতে মূলত ম্রো ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর সদস্যরা জুম চাষ করে। জানা গিয়েছে, ২০১৬ সালে ডলুছড়ি মৌজার প্রায় ৪০০ একর জমি ইজারা নেয়া হয়েছে বলে দাবি জানায় লামা রাবার কোম্পানি। সে সময় কোম্পানির প্রকল্প পরিচালক (পিডি) পরিচয় দেয়া কামাল উদ্দিন ও তার লোকজন স্থানীয়দের নানা ভয়ভীতি দেখায় ও মিথ্যা মামলা দেয়। সর্বশেষ গত ২৬ এপ্রিল বেলা ১১টার দিকে ১৫-২০ জন লোক লামা রাবার কোম্পানির পরিচয়ে প্রায় ৪০০ একর ভূমি আগুনে পুড়িয়ে দেয়। আগুন ধরাতে কোরোসিন, রাবার ও চপ্পল ব্যবহার করা হয়। আগুনে তিন পাড়াবাসীর কবরস্থানসহ জুম ভূমিতে চাষ করা ফলের বাগান, বিভিন্ন গাছ, বাঁশবাগান পুরোপুরি পুড়ে গেছে।
এছাড়া বুনো মুরগি, সাপ, কাঁকড়া, নানা প্রজাতির পাখির ছানা, মুরগি ও পাখির ডিম, ছোট-বড় নানা প্রজাতির অগণিত বন্যপ্রাণীরও মৃত্যু হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়ে সেদিন দুপুরেই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন উপজেলা সহকারী কমিশনারসহ (ভূমি) আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। জুম ভূমিকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় একটি মামলাও হয়েছে। লাংকমপাড়ার কারবারি লাংকম ম্রো বাদী হয়ে আটজনের নাম উল্লেখ করে এ মামলা করেন।
রেংয়ানপাড়ার কারবারি (পাড়াপ্রধান) রেংয়ান ম্রো বণিক বার্তাকে বলেন, লামা রাবার কোম্পানি জুম ভূমি পুড়িয়ে দেয়ার পর থেকে ১১টি পরিবার দিনে একবেলা খেয়ে কোনোভাবে দিন কাটাচ্ছে। বিশেষ করে শিশুদের নিয়ে পরিবারগুলো বিপাকে পড়েছে। পাড়ার সবাই সম্মিলিতভাবে খুঁজে যে জংলি আলু পাচ্ছে, তা-ই ভাগ করে খাওয়া হচ্ছে। কোনো রকমে শাকপাতা সেদ্ধ করে খেয়ে দিন কাটছে। এ কষ্টকে সীমাহীন উল্লেখ করে তিনি বলেন, এমন কষ্টে আগে কখনো পড়তে হয়নি।
ইংচং ম্রো বলেন, অগ্নিকাণ্ডের পর লামা রাবার কোম্পানির লোকজন নানা হুমকি দিচ্ছে। এমনকি হত্যার হুমকিও দেয়া হচ্ছে। পাড়া থেকে ক্যজু বাজার সড়কের জনশূন্য এলাকায় লামা রাবার কোম্পানির লোকজন দলবদ্ধ হয়ে পাহারা দিচ্ছে। এজন্য প্রাণভয়ে কেউ পাড়ার বাইরে বের হয়ে কাজ করতে যাওয়ার সাহস করছেন।
না খেয়ে মরতেও রাজি আছি কিন্তু কোম্পানির লোকের হাতে ত্রাণ গ্রহণ করব না। রাবার কোম্পানির লোকদের হাত থেকে এক গ্লাস পানিও নেবো না। জঙ্গলের লতাপাতা খেয়েই থাকব।’
পাড়াগুলোর কারবারি ও অধিবাসীদের অভিযোগ, লামা রাবার কোম্পানির লোকজন লাঠি, দাসহ নানা ধরনের দেশী অস্ত্র নিয়ে দলবদ্ধ হয়ে এলাকার বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ায়। এজন্য পাড়াবাসী পাড়ার বাইরে যেতে সাহস পাচ্ছে না। লামা রাবার কোম্পানির নানা হুমকির ভয়ে গত দুই বছরের নানা সময়ে রেংয়ানপাড়ার লাঙান ম্রো, প্রচ্যং ম্রো, রেংয়ুং ম্রো, রেংনত ম্রো, সিংচং ম্রো, লাংকমপাড়ার পারিং ম্রো, মেনরুম ম্রো ও জয়চন্দ্র পাড়ার যোগেশ ত্রিপুরা, দুনিজন ত্রিপুরা, যোগেন ত্রিপুরা, পিতর ত্রিপুরা পরিবার নিয়ে পাড়া ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন।
লাংকম ম্রো পাড়া কারবারি (পাড়াপ্রধান) লাংকম ম্রো সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘না খেয়ে মরতেও রাজি আছি কিন্তু কোম্পানির লোকের হাতে ত্রাণ গ্রহণ করব না। রাবার কোম্পানির লোকদের হাত থেকে এক গ্লাস পানিও নেবো না। জঙ্গলের লতাপাতা খেয়েই থাকব।’
রেংয়াং ম্রো পাড়ার কারবারি রেংয়াং ম্রো বলেন, ‘রাবার কোম্পানির লোকজনের উপস্থিতিতে আমরা কোন ত্রাণসামগ্রী নেবো না। তারা ব্যতীত অন্য যে কেউ আসলে এক পোয়া চাল হলেও নেব। কোম্পানির লোকজন এক পরিবারকে দশ বস্তা চাল দিলেও গ্রহণ করতে পারব না। আগুন জ্বালিয়ে যে ভোগান্তি ও কষ্ট দিয়েছে এত সহজে তা কিভাবে ভুলব!’
ত্রাণ বিতরণকালে রাবার কোম্পানির কর্মী হিসেবে তাকে কিভাবে চিহ্নিত করলেন প্রশ্নের জবাবে রেংয়াং ম্রো কারবারি অভিযোগ করে বলেন, ‘আগুন লাগিয়ে দেওয়ার সময় তিনিও উপস্থিত ছিলেন। এর আগে বিভিন্ন সময় এলাকায় লামা রাবার কোম্পানির লোকজনের সাথে তাকে বারবার দেখা গেছে।’
রেংয়াং ম্রো আরও বলেন, ‘রোববার সকালে পাড়ায় লামা থানা থেকেও তদন্তের কাজে দুজন পুলিশ সদস্য আসেন। সবার ঘরে উঠে খাবার আছে কিনা ছবি তুলে নিয়ে যায়।’
শনিবার কক্সবাজারের রামু থেকে রাজেন্দ্র দেবনাথ ও শিপ্তা বড়ুয়া নামে দুই ব্যক্তির বিকাশে পাঠানো টাকায় সবাই দুই কেজি চাল পেয়েছিল। সে চাল রান্না করে খেয়ে রোববার দিন পার করেছেন বলে জানিয়েছে খাদ্য সংকটে পড়া এই তিন পাড়াবাসী।
এর আগে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিঃ স্থানীয় ভূমিদস্যূদের সহায়তায় বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের লাংকম ম্রো কারবারি পাড়া, জয়চন্দ্র ত্রিপুরা কারবারি পাড়া এবং রেংয়েন ম্রো কারবারি পাড়ার আদিবাসীদের প্রায় ৩০০ একর জুম ভূমি দখল করেছে। এর প্রতিবাদ করলে বিভিন্ন সময় আদিবাসীদের বিরুদ্ধে এই কোম্পানি মিথ্যা মামলা করেছে।
সমতলের আদিবাসীদের ভূমির মালিকানা দেশের প্রচলিত আইনে নির্ধারণ করা হলেও তিন পার্বত্য জেলায় আদিবাসীদের ভূমি মালিকানা সামাজিক। ‘সার্বজনীন সম্পদ-সম্পত্তি মালিকানা অধিকার’ নীতিই হলো তাদের ভূমি মালিকানার ভিত্তি। ফলে এই মালিকানা বংশ পরম্পরায় মৌখিক। তিনটি সার্কেলের আওতায় পার্বত্য পাড়ার হেডম্যান এবং কারবারিরা এর ব্যবস্থাপনা করে থাকেন। কিন্তু গত ৩০ বছরে এই পার্বত্য পাড়ার নিয়ন্ত্রণাধীন ভূমির পরিমাণ শতকরা ৫১ ভাগ কমে গেছে। আরেক কথায় বলা যায়, পাহাড়িদের সামাজিক মালিকানার অর্ধেকেরও বেশি ভূমি ও ভূসম্পদ হাতছাড়া হয়ে গেছে।
সম্প্রতি এক বিবৃতিতে বিশিষ্ট নাগরিকরা জানিয়েছেন, বান্দরবানের লামা উপজেলার লাংকম ম্রো পাড়ায় জুমের বাগান আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনায় প্রশাসনের দৃশ্যমান পদক্ষেপ না থাকার বিষয়টি আমাদের গভীরভাবে হতাশ করেছে; আমরা উদ্বিগ্ন। বাগান পুড়ে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত আদিবাসী পরিবারগুলোর শিগগিরই খাদ্য সংকটে পরার আশংকা রয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ন্যায় বিচারের লক্ষ্যে কোনো প্রকার ব্যবস্থা কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পাশে থেকে তাদের আশ্বস্ত করা হয়নি, যা আমাদের বিক্ষুব্ধ করেছে।
এমতাবস্থায় আমরা অনতিবিলম্বে জুমের বাগান আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনায় আইনানুগ প্রতিকারের লক্ষ্যে ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত সম্পন্ন করা, দায়ীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার, ক্ষতিগ্রস্তদের নিরাপত্তা ও উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ এবং পাড়াগুলোতে ম্রো জনগোষ্ঠীর মানুষের দখলসত্ব নিশ্চিত করার জানাচ্ছি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭০৬
আপনার মতামত জানানঃ