ঈদের আগে হঠাৎ করেই বাজারে তেলের সংকট দেখা দেয়। ক্রেতারা দোকান ঘুরেও পাচ্ছিলেন না সয়াবিন তেল। ঈদের পর গত বৃহস্পতিবার বাণিজ্য সচিবের সঙ্গে মিলমালিকদের বৈঠকের পর সয়াবিন ও পাম অয়েলের নতুন দাম নির্ধারণ করে সরকার।
নির্ধারিত দাম অনুযায়ী, ভোক্তাপর্যায়ে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ১৯৮ ও খোলা সয়াবিনের প্রতি লিটার ১৮০ টাকায় বিক্রি হবে।
এর আগে বোতলজাত এক লিটার সয়াবিনের দর ছিল ১৬০ টাকা। খোলা তেল ছিল ১৩৬ টাকা লিটার।
অর্থাৎ আগের চেয়ে বোতলজাত সয়াবিন তেলে লিটারপ্রতি ৩৮ টাকা ও খোলা তেলে লিটারপ্রতি ৪৪ টাকা বেড়েছে।
পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৯৮৫ টাকা। আগে পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৭৬০ টাকা। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রতি লিটার পাম অয়েল বিক্রি হবে ১৭২ টাকায়।
ক্রেতাদের ভোগান্তি
আন্তর্জাতিক বাজারে দামের ঊর্ধ্বগতিতে এক বছরের বেশি সময় ধরেই দেশের বাজারে সয়াবিন ও পাম তেলের দাম বেড়েই চলেছে। এর মধ্যে মার্চ থেকে দাম বাড়ানোর আবেদন সরকার ফিরিয়ে দেয়ার পর বাজারে সরবরাহ কমিয়ে দেয় কোম্পানিগুলো। তখন থেকেই তেল কিনতে গিয়ে তেলেসমাতির শিকার হতে হয়।
অন্য পণ্য কিনলেও তেল কিনতে পারছে না মানুষ- এমন পরিস্থিতিতে রোজার আগে আগে সরকার ভোজ্যতেলের আমদানিতে ভ্যাট ও ট্যাক্স অনেকটাই কমিয়ে আনে। তখন তেলের দাম লিটারে ৮ টাকা করে কমানো হয়। বাজারে সরবরাহ পরিস্থিতিও স্বাভাবিক হয়ে ওঠে।
এর মধ্যে আবার অস্থির হয়ে উঠেছে বিশ্ববাজার। তেলের দাম তেতে ওঠার পাশাপাশি পাম তেলের বড় সরবরাহকারী দেশ ইন্দোনেশিয়া তেল রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দিয়ে বসে। এতে আবার দেশের বাজারে তেলের হাহাকার তৈরি হয়েছে।
আমদানিকারকদের দাবি, তাদের আনা নতুন তেলের যে দাম পড়েছে, বর্তমান বাজার দরে সেটি ছাড়লে লিটারপ্রতি লোকসান হচ্ছে ৫০ টাকার মতো। কিন্তু সরকার এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে মূল্য সমন্বয়ের কোনো উদ্যোগ এখনও নেয়নি। এই পরিস্থিতিতে খোলাবাজারে মিলগুলো তেলের সরবরাহ একেবারেই কমিয়ে দিয়েছে।
আগের সরবরাহ করা তেলের সবগুলোও যে স্বাভাবিকভাবে বিক্রি হচ্ছে- এমন নয়। সুযোগ বুঝে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা ভোক্তাদের জিম্মি করছেন- এটিও স্পষ্ট। ভোগান্তি বাড়ছে ক্রেতাদের।
কিনতে গেছেন সয়াবিন তেল, ১০ দোকান ঘুরেও পাবেন না, আবার কোথাও যদি কপালগুণে পেয়েও যান, কিনতে পারবেন না।
সেখানে দেয়া হবে নানা ধরনের শর্ত। যেমন তেল নিতে হলে আপনাকে নিতে হবে পোলাওয়ের চাল অথবা অন্য কিছু। একটি দোকানে গিয়ে দেখা গেল, ৩৬০ টাকা লিটারের সরিষার তেল কিনলেই ক্রেতাকে সয়াবিন তেল দিতে রাজি হচ্ছেন বিক্রেতা।
ঈদের আগে ময়মনসিংহ ও বাগেরহাটের বাজারগুলোতে আবারও ভোজ্যতেলের সংকট দেখা দিয়েছে। প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ২০০ টাকায় বিক্রি হলেও বোতলজাত সয়াবিন উধাও হয়ে যায়।
অতিরিক্ত দামে খুচরা তেল কিনতেও ভোক্তাদের দোকানে দোকানে ঘুরতে হচ্ছে। এতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যটি কিনতে ভোগান্তিতে পড়েছেন ক্রেতারা।
সূত্র মতে, মিলমালিকরা সরবরাহ বন্ধ করায় বাজারে ভোজ্যতেলের এ সংকট দেখা দিয়েছে। ক্রেতারা বলছেন, অসাধু ব্যবসায়ীরা তেলের সরবরাহ কমিয়ে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছেন। আর ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, অগ্রিম টাকা দিয়েও মিলছে না সয়াবিন তেল।
আগে মজুত করা তেল ২০০ টাকায় বিক্রি
মূল্যবৃদ্ধির পর নতুন দামে শনিবার থেকে বোতলজাত সয়াবিন তেল বাজারে ছাড়তে শুরু করেছেন মিলমালিকেরা। পাশাপাশি পুরোনো দামের বোতলও মিলছে বাজারে, তবে সেগুলোর গায়ে লেখা দাম মুছে দেওয়া।
ক্রেতারা বলছেন, দাম বাড়ার আশায় যে তেল গুদাম বা দোকানে মজুত করা হয়েছিল, মূল্যবৃদ্ধির পর সেগুলো এখন বাজারে ছাড়া হচ্ছে। কিন্তু গায়ে পুরোনো দাম লেখা থাকলেও বিক্রি হচ্ছে নতুন দামে।
গতকাল ঢাকার মিরপুর, কারওয়ান বাজার ও পশ্চিম তেজতুরী বাজার এলাকার ১৮টি দোকানর ৮টি দোকানে তেল নেই। বাকি ১০টি দোকানে তেল আছে। এর মধ্যে ৫টি দোকানে গতকাল তেল সরবরাহ করেছেন পরিবেশকেরা। এসব দোকানে নির্ধারিত দরের চেয়েও বাড়তি দামে তেল বিক্রি করা হচ্ছে। ১ লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৯৮ টাকা নির্ধারণ করা হলেও তাঁরা ২০০ টাকায় বিক্রি করছেন।
কারওয়ান বাজারে গতকাল দুপুরে বোতলজাত সয়াবিন তেল সরবরাহ করেন সিটি গ্রুপের একজন পরিবেশক। এসব তেল মোড়কজাত করা হয় গত ২০ এপ্রিল। বাড়তি দাম কার্যকর হওয়ার পর মজুত রাখা এসব তেল সরবরাহ করেছেন পরিবেশক। আর দোকানিরা ২০০ টাকা লিটার দরে সেই তেল বিক্রি করেন।
মিরপুর–২ নম্বরের বড়বাগ বাজারে বেশির ভাগ মুদিদোকানে সয়াবিন তেল নেই। একইভাবে পশ্চিম তেজতুরী বাজারের বেশির ভাগ দোকানে সয়াবিন তেল ছিল না। হাতে গোনা যে কয়েকটি দোকানে সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছিল, তাঁরাও ২০০ টাকা লিটারে তেল বিক্রি করছিলেন। আবার এই তেলের বোতলের মোড়কে পুরোনো দাম লেখা ছিল।
সরকার খোলা সয়াবিন তেলের দাম প্রতি লিটার ১৮০ টাকা নির্ধারণ করলেও বাজারে ২১০ থেকে ২২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মিরপুর–২ নম্বরের বড়বাগ বাজারের চারটি দোকানে গতকাল খোলা সয়াবিন তেল পাওয়া যায়। এই বাজারের ‘ভাই ভাই শরীয়তপুর’ দোকানের কর্মীরা বলেন, খোলা সয়াবিনের দাম কেজিপ্রতি ২২০ টাকা। লিটারে নয়, কেজিতে তেল বিক্রি করেন তাঁরা।
অবশ্য মিরপুর-২ নম্বরের বড়বাগ বাজারের চাঁদপুর বাণিজ্যালয়, ইসলাম ট্রেডার্স ও এমরান স্টোরে খোলা সয়াবিন তেল ২১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছিল। কেন নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি টাকা রাখা হচ্ছে জানতে চাইলে ইসলাম ট্রেডার্সের বিক্রেতা মো. নাঈম বলেন, ‘বেশি দামে কিনি, বেশি দামে বেচি।’
চট্টগ্রামেও খুচরা পর্যায়ে বোতলজাত তেল ২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে গতকাল। শহরের জামালখান এলাকার ওয়ার্ল্ড স্টোরে গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় তেল আছে কি না জানতে চাইলে দোকানি বলেন, প্রতি লিটার ২০০ টাকা দাম দিতে হবে।
‘সরকারের আর দরকার নেই’
ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে ৬৪ জেলাতেই বিক্ষোভ সমাবেশ আয়োজন করে সিপিবি।
ভোজ্যতেলের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতির লাগাম টেনে ধরে দাম কমাতে না পারলে এই সরকারের আর দরকার নেই বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স।
ভোজ্য তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ, দাম কমানো এবং ভোজ্যতেল নিয়ে কারসাজি সৃষ্টিকারী, সিন্ডিকেট ও মজুতদারদের শাস্তির আওতায় আনার দাবিতে আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশে তিনি এ কথা বলেন।
শনিবার বিকেল সাড়ে ৪টায় রাজধানীর পল্টন মোড়ে বিক্ষোভ-সমাবেশ করে বামপন্থি দলটি।
সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকতে জনগণের উপর শোষণ চালিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে সমাবেশে খাদ্যদ্রব্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি রুখতে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে নিত্যপণ্যের মজুদ গড়ে তোলে রেশনিং ব্যবস্থা ও ন্যায্যমূল্যের দোকানের মধ্য দিয়ে তা বিক্রি করতে আহ্বান জানান বক্তারা।
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা যেসব পণ্য আমদানি করে সেগুলো রাষ্ট্রীয়ভাবে আমদানি করেন। মজুদ গড়ে তোলেন। ব্যবসায়ীরা ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রি না করলে ন্যায্যমূল্যের দোকান খুলে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিক্রি করেন। তারপরেও যদি তেলের দাম এই সরকার কমাতে না পারে তাহলে এই সরকারের আর দরকার নাই।’
সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘দাম বাড়ানোর আগে দুই পক্ষের সঙ্গে আলাপ করা হয়নি কেন? কম দামে বিক্রি করলে ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হবে এটা ব্যবসায়ীদের কাছে শুনল, কিন্তু যারা আমরা কিনে খাই, কত দামে কিনলে আমাদের পোষাবে তা কেন শোনা হলো না? সিন্ডিকেট আর ব্যবসায়ীদের স্বার্থে যে সরকার চলে সেটা সিন্ডিকেটের সরকার।’
তিনি আরও বলেন, ‘এমন একটা সময়ে দাম বাড়ানো হলো যখন চিটাগাংয়ে তেলের জাহাজ নোঙ্গর করেছে। প্রধানমন্ত্রীকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, হয় ব্যবসায়ীদের পক্ষে থাকবেন নয়তো জনগণের পক্ষে থাকবেন।’
সমাবেশ শেষে একটি বিক্ষোভ মিছিল গুলিস্তানের জিরো পয়েন্ট ঘুরে পল্টন মোড়ে এসে শেষ হয়।
‘রান্নাঘর থেকেই আন্দোলনের সূচনা’
সয়াবিন তেলের মূল্যবৃদ্ধির জন্য দেশবাসীকে রান্নাঘর থেকেই আন্দোলনের সূচনা করার আহ্বান জানিয়েছেন আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি) সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু।
তিনি বলেন, ‘রান্নাঘর থেকে আন্দোলনের সূচনা করতে হবে। জনবিচ্ছিন্ন এই সরকারকে বুঝিয়ে দিতে হবে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা কতটা ভয়াবহ হতে পারে।’
ভোজ্যতেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এবি পার্টি ঢাকা মহানগর দক্ষিণের উদ্যোগে মানববন্ধনে এসব কথা বলেন।
মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, “দেশের মানুষের কাছে আমি অভিনব প্রতিবাদের আহ্বান জানাচ্ছি। দেশের মা, বোন, ভাই, জনতার কাছে অনুরোধ করব, যত দিন পর্যন্ত সয়াবিন তেলের মূল্য কমানো হবে না, তত দিন পর্যন্ত চুলায় তেল ঢালার সময় ‘এই জালিম সরকারের পতন চাই, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ বলে তেল ঢালবেন।”
তিনি বলেন, ‘মা-বোনকে বলব, এই শব্দটা উচ্চারণ করে আপনারা চুলায় তেল চাপাবেন। আর ভিডিও করে ফেসবুকে আপলোড দেবেন। এটাই আমাদের প্রতিবাদ৷’
দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজপথে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘রাজপথে আসুন, ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন গড়ে তুলুন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে, জুলুমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেই বিজয়ী হতে হবে।’
মানববন্ধনে এবি পার্টির যুগ্ম আহ্বায়ক তাজুল ইসলাম বলেন, ‘গণতন্ত্রের অনুপস্থিতির কারণে মানুষ স্বৈরশাসনের যাতাকলে পিষ্ট। এত বড় জুলুমের পরও মানুষ রাজপথে আসতে পারেনি।’
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৪৫
আপনার মতামত জানানঃ