মসজিদে মাইক বাজানোর মৌলিক অধিকারের কথা লেখা নেই ভারতীয় সংবিধানে। দেশজুড়ে যখন মসজিদে মাইক বাজানো নিয়ে নানান বিতর্ক শুরু হয়েছে, সেই সময়ই এমন রায় দিল এলাহাবাদ হাইকোর্ট। এর পাশাপাশি মসজিদে মাইক বসানো নিয়ে এক ব্যক্তির আবেদনও খারিজ করে দেওয়া হয়েছে।
উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথ সরকারের ধর্মস্থান থেকে লাউডস্পিকার খোলার সিদ্ধান্ত, মধ্যপ্রদেশে রাজ ঠাকরের দলের মসজিদে আজানের পালটা হনুমান চালিশা পাঠের ডাককে কেন্দ্র করে বিতর্কের মধ্যেই এ গুরুত্বপূর্ণ রায় দিল এলাহাবাদ হাইকোর্ট। ভারতের আরও অনেক রাজ্যেও ধর্মস্থানে লাউডস্পিকার বাজানো নিয়ে বিতর্ক চলছে।
গত বছরের ৩ ডিসেম্বর বদায়ুঁর বিসাউলি সাব ডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেটের জারি করা আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে ইরফান নামে এক ব্যক্তি মসজিদে লাউডস্পিকার লাগানোর অনুমতি চেয়েছিলেন। আজানের প্রার্থনা শোনানোর জন্য ধোরানপুর গ্রামের নুরি মসজিদে লাউডস্পিকার বসানোর অনুমতি দেননি সাব ডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট। ইরফান সেই পদক্ষেপের পালটা লাউডস্পিকার লাগানোর অধিকার চান।
আবেদনে ইরফান ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশকে ‘বেআইনি’ ও ‘মৌলিক, আইনি অধিকারের পরিপন্থী’ আখ্যাও দেন। কিন্তু বিচারপতি বিবেক কুমার বিড়লা ও বিচারপতি বিকাশের ডিভিশন বেঞ্চের স্পষ্ট মত, আইন বলে যে মসজিদে লাউডস্পিকার বাজানোর সাংবিধানিক অধিকার নেই।
সম্প্রতি যোগী আদিত্যনাথ বলেছিলেন, মন্দির, মসজিদে লাউডস্পিকারের শব্দ যেন বাইরে না আসে। মন্দির, মসজিদের প্রার্থনার শব্দ তার ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকা কাম্য।
তিনি বলেন, ধর্মস্থানে প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে মাইক, লাউডস্পিকার বাজতেই পারে, কিন্তু তার শব্দ মন্দির, মসজিদের বাইরে আসা চলবে না। মুখ্যমন্ত্রী এ কথা বলার পরই রাজ্যে মন্দির, মসজিদ মিলিয়ে ১৭ হাজার ধর্মস্থানে লাউডস্পিকারের শব্দের মাত্রা কমিয়ে অনুমোদিত সীমার মধ্যে বেঁধে রাখা হয়।
মসজিদে মাইক বাজানো নিয়ে সম্প্রতি বিরোধিতা করা হয়েছে মহারাষ্ট্রে। মসজিদে মাইক বন্ধ করার দাবী তোলেন মহারাষ্ট্রের নবনির্মাণ সেনার প্রধান রাজ ঠাকরে। তিনি হুঁশিয়ারিও শানিয়েছিলেন যে মসজিদে যদি মাইক বাজানো হয়, তাহলে মসজিদের বাইরে পাল্টা হনুমান চল্লিশা বাজানো হবে। তার সমর্থকরা তা শুরুও করেছেন। এ নিয়েও ফের দায়ের করা হয়েছে মামলা। কর্ণাটকেও লাউডস্পিকার নিয়ে বিতর্ক বাড়ছে।
আইন বলে যে মসজিদে লাউডস্পিকার বাজানোর সাংবিধানিক অধিকার নেই।
হিজাব ব্যান ও মন্দির চত্ত্বরে মুসলিমদের ব্যবসা করতে না দেওয়া নিয়ে এমনিতেই বিতর্কের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে কর্ণাটক। এবার সেখানে মসজিদে আজানের সময় তারস্বরে মাইক বাজানোর বন্ধের দাবি করল হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো।
হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো প্রশাসনের কাছে দাবী তুলেছে যে, মসজিদ থেকে মাইক বাজিয়ে আজান দেওয়া বন্ধ করতে হবে। শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধি ভেঙ্গে বিনা অনুমতিতে মাইক বাজিয়ে আজান দেওয়া হচ্ছে।
এর আগে হিজাব, হালাল ইত্যাদির মতো মুসলমানদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক ইস্যুতে সরব হয়েছে এই সংগঠনগুলো। এসবই করা হচ্ছে আগামী বিধানসভা ভোটের আগে ধর্মীয় মেরুকরণের জন্য, মত বিশ্লেষকদের।
কর্ণাটকে উগ্র হিন্দুত্ববাদ প্রচারের জন্য পরিচিত সংগঠন শ্রীরাম সেনে বলছে মসজিদগুলি থেকে মাইক বাজিয়ে যে আজান দেওয়া হয়, তাতে রাজ্যের শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ আইন ভঙ্গ করা হচ্ছে।
আজানের সময় মাইক যাতে ব্যবহার না করা হয়, সেটা পুলিশ প্রশাসনকে সুনিশ্চিত করার দাবীও তোলা হয়েছে।
পুরো বিষয় নিয়ে কর্ণাটক বিজেপির বরিষ্ঠ নেতা ও রাজ্যের মন্ত্রী কেএস এসরাপ্পা বলেছেন যে, আজানের সময় মন্দির থেকে হনুমান চালিশা চালিয়া প্রতিযোগীতা করতে হবে এমনটা নয়৷ কিন্তু প্রতিদিন আজানে যে তারস্বরে মাইক বাজানো হয় শিশু, রোগী এবং ছাত্রছাত্রীদের অসুবিধা হতে পারে৷ মুসলিম ধর্মের মানুষের ধর্মীয় অভ্যাসের প্রতি আমার কোনও বিরোধিতা নেই কিন্তু তাদেরও ভাবতে হবে যে এভাবে যদি হিন্দু, খ্রীস্টানরাও প্রতিদিন মাইকে তারস্বরে তাদের ধর্মীয় সঙ্গীত পাঠ করে তাহলে বিষয়টি কোথায় পৌঁছবে! এবং এরকম হলে তা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে বিভেদ বাড়াবে৷ যদিও আমাদের সরকার কোনও সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নয়। এবং আমাদের সরকার আজান নিয়ে কোনও নতুন নির্দেশও আনছে না৷
এর আগে কন্নড় নববর্ষের সময়ে গৌডার সংগঠনই দাবি তুলেছিল যে হালাল মাংস বিক্রি বন্ধ করতে হবে। তারও আগে বড় ধরনের বিতর্ক বেঁধেছিল মুসলমান ছাত্রীদের হিজাব পরে ক্লাস করা নিয়ে। ওই মামলা এখন সুপ্রীম কোর্টে পৌঁছিয়েছে। তারই মধ্যে হিন্দুত্ববাদীদের নতুন দাবি মাইকে আজান দেয়া বন্ধ হোক।
তবে কংগ্রেস বলছে শুধু মসজিদে নয়, মন্দির বা চার্চেও তো মাইক থাকে।
হিন্দুত্ববাদীদের নতুন দাবি মাইকে আজান দেয়া বন্ধ করার বিষয়ে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সিদ্দারামাইয়া সাংবাদিকদের জানান, মাইক তো শুধু মসজিদে থাকে না, মন্দির বা চার্চেও থাকে। কিন্তু এতে কাদের অসুবিধা হচ্ছে?
তিনি বলেন, ‘এ ধরনের ক্যাম্পেনগুলো চলতে পারছে কারণ সরকারটা দুর্বল। মুখ্যমন্ত্রী সবই জানেন। আরএসএসের সংগঠনগুলো কী কী করছে তিনি কি জানেন না? সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার যেকোনো প্রচেষ্টা অবিলম্বে থামাতে হবে, না হলে গোটা রাজ্যের ক্ষতি হবে।
কর্নাটকের বিধানসভা নির্বাচনের বাকি আছে এক বছরেরও কম সময়। এর আগের ভোটে বিজেপি পরাজিত হলেও কংগ্রেস আর জেডি এস বিধায়কদের দল বদল করিয়ে তাদের সমর্থন নিয়ে সরকার গড়েছিল বিজেপি। ওই ঘটনাটি অপারেশন কমল নামে পরিচিত। কিন্তু এবার কংগ্রেস আর বিজেপির মধ্যে সমানে সমানে টক্কর হতে পারে, তাই সতর্কতা হিসাবে ধর্মীয় মেরুকরণ করিয়ে কিছু বাড়তি সিট নিশ্চিত করতে চাইছে বিজেপি, এমনটাই মনে করেন সাংবাদিক ইমরান কুরেশি।
ইমরান কুরেশি বলেন, ‘কর্ণাটকের যা রাজনৈতিক পরিস্থিতি, তাতে মূল লড়াইটা হবে বিজেপি আর কংগ্রেসের মধ্যে। যদিও জে ডি এসের কিছু জনসমর্থন আছে, তবে তা সীমিত। বিজেপি আর কংগ্রেস দু’দলেরই ৯০ থেকে ১০০র কাছাকাছি আসন পাওয়ার একটা সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য যে সংখ্যাটা দরকার, ওই ১১২টি আসন কে পাবে, তা নিশ্চিত নয়। তাই বিজেপি এ ধর্মীয় মেরুকরণের কৌশলটা নিয়েছে যাতে নিজেদের আসনসংখ্যাটা যতটা সম্ভব বাড়িয়ে নেয়া যায়।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৩৮
আপনার মতামত জানানঃ