অন্ধকার গলিতে লাইন করে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় তিনশ’ মানুষ। তার মধ্যে যেমন পক্ষাঘাতগ্রস্ত বয়স্করা আছেন, তেমনই আছেন অন্তঃসত্ত্বা নারী, শিশুরাও। প্রত্যেককেই টেনে-হিঁচড়ে বের করে আনা হয়েছে বাড়ি থেকে। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই গোটা অঞ্চল কেঁপে উঠল আগ্নেয়াস্ত্রের ঝলকানিতে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ল অজস্র শরীর। মুহূর্তে শেষ হয়ে গেল ৩২৩টি প্রাণ।
বলার প্রয়োজন পড়ে না, এই গণহত্যার প্রেক্ষাপট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তবে পোল্যান্ড, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া কিংবা নেদারল্যান্ডস নয়; নাৎসিদের এই নৃশংসতার সাক্ষী হয়েছিল ইতালি।
অবাক হচ্ছেন? সেটাই স্বাভাবিক। বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল মুসোলিনির ইতালি। লড়াই করেছিল মিত্রপক্ষের বিরুদ্ধে। তারপরও ইতালিতে নাৎসি সর্বাধিনায়কের এমন নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালানোর কারণ কী? শুরু থেকেই বলা যাক এই গল্প।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ৯০ শতাংশের বেশি অ-ইহুদি জার্মানরা হিটলারকে সমর্থন করলেও, যুদ্ধের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন অনেকেই। অবশ্য প্রকাশ্য বিরোধিতার সুযোগ ছিল না কোনো।
তবে জার্মানি জুড়ে গড়ে উঠেছিল ‘এডেলভিস পাইরেটস’, ‘রেড অর্কেস্ট্রা’, ‘হোয়াইট রোজ’, ‘দ্য ওলিম্প’-এর মতো একাধিক গুপ্ত সংগঠন। ইতালিতেও ঠিক সেইভাবেই জন্ম নিয়েছিল সশস্ত্র গুপ্ত আন্দোলন।
পার্টিজান আন্দোলন। যারা সামগ্রিকভাবে বিরোধিতা করতেন হিটলার এবং মুসোলিনির এই দ্বৈরথের। পার্টিজান আন্দোলনকারীদের ওপর প্রতিশোধস্পৃহা থেকেই, ১৯৪৪ সালে ইতালির রাসেলা স্ট্রিটে গণহত্যা ঘটিয়েছিল জার্মানি।
সে সময় আস্তে আস্তে মোড় ঘুরছে যুদ্ধের। যুদ্ধের চালকের আসন থেকে ক্রমশ একটু একটু করে সরে যাচ্ছেন হিটলার। এই সময়টাতেই জার্মান সেনাদের ওপর আঘাত হানার সিদ্ধান্ত নেন পার্টিজান আন্দোলনকারীরা। দিনটা ছিল ২৩ মার্চ। আবর্জনা সংগ্রহকারীর ছদ্মবেশে ডাস্টবিনে বোমা রেখে আসেন তিন ইতালীয় বিপ্লবী; কারলা ক্যাপোনি, রাউল ফ্যালসিওনি এবং ফার্নান্দো ভিটাগলিয়ানো।
না, ব্যর্থ হয়নি তাদের লক্ষ্য। জায়গাটা ছিল জার্মান সেনানিবাস ‘বোজেন’-এর একদম কাছেই। সব মিলিয়ে সেখানে তখন ১১ কোম্পানি সেনা। নাৎসি সেনাদের ঢল রাস্তায় নামার পরেই, মর্টারের সাহায্য দূর থেকে ঘটানো হয় বিস্ফোরণ।
ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান ‘অর্ডার পুলিশ’ রেজিমেন্টের ৩২ জন জার্মান সেনা। আহত হন কমপক্ষে ১১০ জন। সঙ্গে প্রাণ হারিয়েছিলেন আরও ২ সাধারণ নাগরিক।
এমন অতর্কিত আক্রমণের কোনো পূর্ব-প্রস্তুতি ছিল না নাৎসি সেনাদের। এমনকি কোথা থেকে আক্রমণ হয়েছে, তাও বুঝতে পারেননি তারা। অধিকাংশ সেনাই ভেবেছিলেন হয়তো, আকাশপথে হানা দিয়েছে কোনো বিমান। ত্রস্ত হয়ে এলোপাথারি গুলি চালিয়েছিলেন জার্মানরা। যার ক্ষতদাগ আজও ধরে রেখেছে রাসেলা স্ট্রিটের শতাব্দীপ্রাচীন বাড়িগুলি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই খবর পৌঁছে যায় হিটলারের কাছে। ঘটনার আকস্মিকতায় উত্তেজিত হয়ে পড়েন হিটলার। তৎক্ষণাৎ হুকুম দিয়েছিলেন প্রতিটি মৃত জার্মান সেনার মৃত্যুর জন্য শাস্তি পাবেন ৩০-৫০ জন ইতালীয় নাগরিক। তবে ঘণ্টা চারেক বাদে খানিকটা বদলায় সিদ্ধান্ত। ঠিক হয়, প্রতি সেনা পিছু মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে ১০ জন ইতালীয়কে।
তবে ক্ষমা নয়। আগ্নেয়াস্ত্র গোলা-বারুদের সংকটের কারণেই এই সিদ্ধান্তবদল হয়েছিল নাৎসিদের।
সেই দিনই সন্ধে ৮টার দিকে রাসেলা স্ট্রিটে দেখা গিয়েছিল সেই বীভৎস দৃশ্য। বাড়ি থেকে টেনে হিঁচড়ে বার করে আনা হয়েছিল মানুষদের। তারপর আগ্নেয়াস্ত্রের ঝলকানি, বন্দুকের গর্জন আর জার্মান সেনাদের উল্লাস। মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল ৩২৩টি জলজ্যান্ত প্রাণ।
রাসেলা স্ট্রিটের এই গণহত্যা ইতালির ইতিহাসের অন্যতম এক অন্ধকার অধ্যায়। সম্প্রতি, বিশ্বযুদ্ধের ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত দ্বন্দ্বে আবার নতুন করে সামনে এসেছে এই নৃশংসতার স্মৃতি।
এসডব্লিউ/এসএস/২০০৫
আপনার মতামত জানানঃ