মুসলিম বিশ্বের মহিমান্বিত মাস রমজান। এ মাস ঘিরে নানা অনুষ্ঠান আর রীতি-রেওয়াজ আছে। রোজা রাখা, ইফতারের পর তারাবির নামাজ পড়া ইত্যাদি ছাড়াও আনন্দ-উৎসবের মাধ্যমে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয় খুশির আমেজ। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের চেয়েও এসব রীতি সাংস্কৃতিক উদযাপন হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। চীনের ছাংশায় ১৬ থেকে ১৭ ঘণ্টা রোজা।
চীনের উইঘুর মুসলমানদের ওপর রোজা পালনে রয়েছে রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা। দেশটির শিনঝিয়াং প্রদেশে প্রায় এক কোটি মুসলমানের বাস৷ সেখানকার কয়েকটি সরকারি ওয়েবসাইটে রোজা রাখা ও ধর্মীয় রীতি পালনের ওপর নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হয়েছে৷ এ সত্ত্বেও তারা রোজা রাখছেন। কিন্তু কীভাবে?
রাজ্যের করলা শহর কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ‘সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারি, শিক্ষার্থী ও শিশুরা রোজা রাখতে পারবেন না। কোনো ধর্মীয় রীতি পালন করতে পারবেন না৷।’
এ ছাড়া রোজার মাসে খাবার ও পানীয়ের দোকানও বন্ধ রাখা যাবে না বলে জানানো হয়েছে৷ যদিও চীনের মন্ত্রিসভা বলেছে, ‘মুসলমানরা চাইলে রোজার সময় তাদের রেস্তোরাঁ ও ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে পারে৷’
শুইমগু জেলার শিক্ষা বিভাগের ওয়েবসাইটে একটি নোটিশ জারি করা হয়েছে৷ তাতে রোজার মাসে স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মসজিদে যেতে নিষেধ করা হয়েছে৷
উল্লেখ্য, শিনঝিয়াং রাজ্যের মুসলমানরা উইঘুর সম্প্রদায়ের৷ সেখানকার নিরাপত্তা কর্মীদের সঙ্গে উইঘুরদের মাঝেমধ্যেই সংঘাত লেগে থাকে৷ মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, সংখ্যালঘু উইঘুরদের ওপর বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক নিষেধাজ্ঞা শিনচিয়াং রাজ্যে উত্তেজনার কারণ৷
শুয়োরের মাংস খেতে বাধ্য করা
চীনে মুসলমানদের ইসলাম ধর্মের অনুশাসন বা সংস্কৃতি মেনে চলা প্রায় অসম্ভব। দেশটির ক্ষমতাসীন চীনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিসিপি) ইসলাম ধর্মকেই ধ্বংস করতে চায়। এরই প্রেক্ষিতে শিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর সম্প্রদায়ের মুসলমানদের বাধ্য করা হচ্ছে শুয়োরের মাংস খেতে। সেইসঙ্গে উইঘুরদের শুয়োর পালনেও বাধ্য করছে শিনজিয়াং প্রশাসন।
সরকারি নির্দেশ না মানলে জেল, জরিমানা। অভিযোগ, গুম করাও হয়েছে অনেককে। সিসিপির কাছে মুসলিম ধর্মীয় অনুশাসন মানা মানেই সে সন্ত্রাসবাদী। গায়ে লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে ‘ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদী’র তকমা। এমনটাই জানিয়েছে ‘বিটার উন্টার’ নামে চীনের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও মানবাধিকারবিষয়ক ম্যাগাজিন। প্রতিবেদক ইউয়ান ওয়েই-র প্রতিবেদনে উঠে এসেছে উইঘুর মুসলিমদের দুর্দশার ছবি।
ম্যাগাজিনটি শিনজিয়াং-এর সরকারি কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে জানায়, এ বছর রমজানের সময়েই চীন সরকার ‘সন্ত্রাসবিরোধী ও স্থায়িত্ব রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা’র নামে মুসলমানদের ওপর ব্যাপক দমন কর্মসূচি হাতে নেয়। ইসলাম ধর্মের কোনো অনুশাসন বা শিক্ষা মানলেই তার ওপর নেমে এসেছে পুলিশি সন্ত্রাস। রমজান পালন মুসলমানদের জন্য নিষিদ্ধ। তাই পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে উইঘুরদের ওপর কড়া নজরদারির।’
তারাবির নামাজ বা ইফতার—এমনকি জুমার নামাজেও পুলিশের কড়া নজর। সরকারি নথি থেকেই ম্যাগাজিনটি জানতে পেরেছে, সন্দেহজনক কাউকে পেলেই পুলিশ ‘প্রশিক্ষণ শিবির’-এর নামে চলতে থাকা বিভিন্ন কয়েদখানায় চালান করে দিচ্ছে। সেখানে চলছে কমিউনিস্ট ভাবধারায় দীক্ষিত করার প্রশিক্ষণ। সঙ্গে শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার। জেলখানাকেও হার মানাচ্ছে এই তথাকথিত প্রশিক্ষণ শিবির। জিনজিয়াং থেকে কেউ চীনের অন্য শহরে গেলে সেখানেও তাদের নথিপত্র পরীক্ষার নামে চলছে ধর্মচর্চার ওপর নজরদারি।
সিসিপি বলছে, ‘ধর্মীয় সন্ত্রাস প্রতিরোধ’ চালাচ্ছেন তারা। বাস্তবে কিন্তু মানুষের ধর্মাচরণের অধিকার কেড়ে নিতে তারা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস শুরু করেছে শিনজিয়াংয়ে। শিনজিয়াংয়ে লক্ষ লক্ষ মুসলমানকে প্রশিক্ষণ শিবিরের নামে বন্দি করে রাখা হয়েছে। সেখানে তাদের ধর্মত্যাগে বাধ্য করছে চীনা প্রশাসন। ইচ্ছেমতো মুসলমানরা নিজেদের দাড়ি রাখতে বা পোশাক পরতে পারছেন না। ধর্মীয় পোশাক পরাও সিসিপির চোখে অপরাধ।
কেমন যাচ্ছে রোজার দিনগুলো
ইসলাম ধর্মের প্রতি আস্থা ব্যক্ত করলেই উইঘুরদের বলা হচ্ছে ‘ধর্মীয় সন্ত্রাসী’। তারপর শুরু হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। আসলে উইঘুরদের ধর্মীয় পরিচিতিটাকেই মুছে দিতে চাইছে সিসিপি। কেড়ে নিচ্ছে ওদের মানবাধিকার। বন্দুকের নলের সামনে ধর্মান্তকরণ চলছে জিনজিয়াংজুড়ে।
চীনের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের চিংহাই প্রদেশের এক মুসলিম বিটার উইনটার-কে তার নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘সারাদিন রোজা রেখে নামাজের জন্য মসজিদে যাচ্ছিলাম। এমন সময় পুলিশ আমাদের পথ আটকায়। বাধ্য করে রোজার মধ্যেই পানি খেতে। সারাদিনের রোজা এভাবেই নষ্ট হয়। নামাজও পড়তে দেয়নি আমাদের।’
শিনজিয়াংয়ের উইঘুররা চীনের অন্যান্য জায়গাতেও মোটেই শান্তিতে থাকতে পারেন না। রমজান মাসে তাদের ওপর নেমে আসে আরও বেশি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। স্কুলপড়ুয়াদের ওপরও জুলুম চালানো হয় সিসিপির নির্দেশে। পূর্ব সীমান্তের শানডং প্রদেশের একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক তার নিজের অভিজ্ঞতার কথা ব্যক্ত করেছেন।
বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সাধারণ চীনাদের সঙ্গে উইঘুর মুসলিমদেরও রমজানের সময় শুয়োরের মাংস খেতে বাধ্য করে। মুসলিম ছাত্রদের নামাজ পড়া নিষিদ্ধ। যদি কোনো ছাত্রকে নামাজ পড়তে দেখা যায়, তবে তাকে কড়া শাস্তির বিধানও রয়েছে স্কুলে।
চীনা রাশিচক্রে বলা হয়েছে, ‘শুয়োরদের জন্য শুভ বছর। শুয়োরদের জন্য নির্ধারিত বছরটিতে অংশীদার হোন নিজের সৌভাগ্যের।’ শিনজিয়াং-এর গ্রামে গ্রামে উইঘুরদের বাড়ির দরোজায় সরকারি কর্তারা লাগিয়ে দিয়েছেন এই পোস্টার। গৃহকর্তার অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজনও মনে করেননি সরকারি কর্তারা। উইঘুররা চীনের দানবিক আচরণে নিজেদের চোখের পানি ফেলতেও ভয় পান। কারণ, টের পেলেই নেমে আসবে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস।
পুলিশ অত্যাচার তো আছেই। রয়েছে নারী-শিশুদের ধর্ষণ ও নির্যাতন। প্রতিবাদ করার জোঁ নেই। বিন্দুমাত্র মানবাধিকারের বালাই নেই জিনজিয়াং প্রদেশ উইঘুরদের জন্য। নেই নিজেদের ধর্ম বা সংস্কৃতিকে আগলে রাখার অধিকার। ইসলামই এখন চীনের সবচেয়ে বড় শত্রু। তাই নামাজ পড়া, রোজা রাখা বা পবিত্র কোরআনকে আগলে ধরার মতো পবিত্র কাজ সেখানে নিষিদ্ধ। চীনের আর্থিক সুবিধাভোগী পাকিস্তানসহ মুসলিম দুনিয়া যে তাদের পাশে নেই, সেটাও বুঝে গেছে উইঘুররা।
এসডব্লিউ/এসএস/২০৫৭
আপনার মতামত জানানঃ