জাকির হোসেন
মাদ্রাসাগুলিতে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান এবং সামাজিক বিজ্ঞান পড়ানো হয় না বলে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা আধুনিক উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত হয় এবং আধুনিক বিষয়গুলির প্রতি একটি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বের হয়।
মাদ্রাসা শিক্ষা কোন কর্মমুখী শিক্ষা দেয়না। এর মাধ্যমে ওষুধ এবং প্রযুক্তিগত জিনিসের মতো গুরুত্বপূর্ণ কোনও শিক্ষা দেওয়া হয় না। ফলে এই মাদ্রাসাগুলো দ্বারা উৎপাদিত হয় বেকার ও কর্মহীন জাতি।
হেফজ মাদ্রাসা এতিম, অসহায়, সর্বহারা শ্রেণীর শিক্ষা দেয়, যাদের জন্য এই শিক্ষা হল পরকালের মুক্তির সংক্ষিপ্ত এবং নিশ্চিত রাস্তা।
বেশিরভাগ মাদ্রাসার নামকরণের বেলায় এতিমখানা লেখা হয়। সাইনবোর্ডেও এ কথাটি লেখা থাকে। যদিও বাস্তবে একজন আসল এতিম খুঁজে পাওয়া যায় না। “এতিমখানা” এই লেখাটির মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ এবং শিক্ষক সম্প্রদায় বিরাট অংকের দান, সদকা, যাকাত, ফেতরা গ্রহণ করে এবং পুরো টাকাই আত্মসাৎ করে।
এছাড়া আছে, সিনিয়র, জুনিয়র একসাথে থাকার সমস্যা। এতে সিনিয়ররা জুনিয়রদের বলাৎকার করে এবং লম্পট শিক্ষকরা তো আছেই। একসময় খ্রিস্টান পুরোহিতরা বলাৎকারের যে বিশ্বরেকর্ড গড়েছিল, বর্তমানে মাদ্রাসার শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীরা সেই স্থান দখল করে আছে।
এসব প্রতিষ্ঠানে কুরআন মুখস্থ করার কারণে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক বিভিন্ন ধরনের ক্ষতি হয়। সেগুলো হলো –
এক তরফা কুরআন মুখস্থ করার ফলে শিশু শিক্ষার্থীর মাতৃভাষার বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে শিশুটির পারিবারিক এবং সামাজিক দূরত্ব তৈরি হয়।
মাদরাসা একটি বিদেশি ভাষার বই কোরআনকে জোরপূর্বক মুখস্থ করার জন্য শিশুর উপর চাপ প্রয়োগ করে। যা শিক্ষার নামে নির্যাতন। এর ফলে তার সুস্থ মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।
এ ধরনের মুখস্থবিদ্যা শিক্ষার্থীর সার্বিক আচরণে অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। তার প্রতিদিনকার অভ্যাস, পরিবেশ থেকে তার উদ্দীপনা ও প্রতিক্রিয়া তার আচরণে অস্বাভাবিক ভাবে উঠানামা করে। এসব ভাষা না বুঝে মুখস্থ করার কারণে শিক্ষার্থীর মানসিক চাপ বৃদ্ধি পায় এবং শিক্ষার প্রতি তার উৎসাহ ও আনন্দ কমে যায়।
কুরআন মুখস্থ করতে গেলে অত্যাধিক পড়তে হয় এবং বারবার রিপিট করতে হয়। ফলে মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ তৈরি হয়। ফলে বিষন্নতা এবং থাইরয়েডের সমস্যা দেখা দেয়।
এ ধরনের মুখস্থ বিদ্যায় অত্যাধিক চোখের ব্যবহার করতে হয়। ফলে চোখের দৃষ্টিশক্তি ক্ষতি হয় এবং ঘন ঘন পড়ার কারণে তার কথা বলার স্বাভাবিক শৈলী নষ্ট হয়। এতে শিক্ষার্থীর জ্ঞান, প্রজ্ঞা, দৃষ্টিভঙ্গি এবং স্বাভাবিক আচরণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
কুরআন মুখস্থ শিক্ষার্থীর বিদ্যা ঘুম কেড়ে নেয়। পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়ায় স্মৃতিশক্তি হ্রাস পায় এবং ভুলে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ে। তাই বারবার এটি পুনরাবৃত্তি করতে হয়। ফলে কথা বলার সাধারণ শৈলী এবং শরীরের ছন্দ নষ্ট হয়।
কুরআনের ভাষা বিদেশী ভাষা। এটি অজানা সংস্কৃতির সাথে সংযোগ তৈরি করে। ফলে স্বদেশী সংস্কৃতির সাথে শিক্ষার্থী অভ্যস্ত হতে ব্যর্থ হয়। আর এটি না বুঝে মুখস্থ করায় শিক্ষার্থীর মানসিক শক্তির উপর প্রতিনিয়ত আঘাতপ্রাপ্ত হয়। যা মানসিক যন্ত্রণা ও চাপ তৈরী করে।
এ ধরনের মুখস্থবিদ্যা শিক্ষার্থীর কল্পনা শক্তি, সৃষ্টিশীল চিন্তাভাবনা ও সত্য জানার মাঝে একটি দেয়াল তৈরি করে। ফলে সে স্বাধীন চিন্তার অধিকারী হতে পারেনা।
মস্তিষ্কের ক্ষতি, মুখস্থবিদ্যা একজন শিক্ষার্থীর স্মৃতিকে পাথর বানিয়ে ফেলে। ফলে দ্বিতীয় বার শিখতে গেলে প্রথম মুখস্থ বিষয়গুলি আত্মরক্ষার জন্য মস্তিষ্কে লকডাউন তৈরী করে।
এতে এনকোডিং প্রক্রিয়ার ঘাটতি দীর্ঘমেয়াদী মেমরিতে তথ্য একত্রীকরণ বা সঞ্চয় করতে সমস্যা সৃষ্টি করে। যেসব ছাত্রদের দীর্ঘমেয়াদী মেমরি স্টোরেজের ঘাটতি রয়েছে তারা প্রায়শই রোট মেমোরাইজেশনের উপর খুব বেশি নির্ভর করতে হয়। ফলে তার স্বাভাবিক আচরণ নষ্ট হয়।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সমস্যা
মুখস্থবিদ্যায় পারদর্শী শিক্ষার্থীরা আধুনিক চিন্তাভাবনা, শিক্ষা ও জ্ঞান বিজ্ঞানের সাথে পরিচিত নয় বলে এরা একটি রক্ষনশীল সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে। তারা সমাজে গোঁড়ামি ও কূপমন্ডুকতা প্রচলন করে।
বিদেশি বই মুখস্ত করা এতোটাই ভয়ানক যে এটি আমাদের চিন্তা শক্তি ও ভাবনা শক্তিকে গলা চেপে ধরে।
বিদেশি ভাষায় লেখা আস্ত একটা কোরআন মুখস্থ করতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের নিজের সংস্কৃতিতে নিজের বৃদ্ধি ও বিকাশ হারিয়ে ফেলে। এতে সৃষ্টি হয় সাংস্কৃতিক পার্থক্য। এই সাংস্কৃতিক পার্থক্য জাতির ভেতরে বিভ্রান্তি ও সাংস্কৃতিক ভুল বোঝাবুঝির তৈরি করে।
সাংস্কৃতিক পার্থক্যের কারণে শিক্ষার্থীদের স্থানীয় ভাষাভাষীদের সাথে যোগাযোগ করতেও সমস্যা হয়। ফলে সে নিজেকে একাকী মনে করে।
একজন মুখস্থকারী হাফেজ এর কাছে কোনো মুখস্থবিদ্যা ছাড়া কোন জ্ঞান থাকেনা। শ্রোতাদের চাহিদামাফিক সে কোন সঠিক উত্তর দিতে পারে না। উত্তর দিতে গেলে যুগের সাথে সমসাময়িক তথ্যের রেফারেন্স দিতে পারেনা। এখানে বক্তা এবং শ্রোতার মাঝে প্রয়োজনীয় তথ্যের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। ফলে সে সাধারণ মানুষকে প্রশ্ন করতে নিষেধ করে।
এ ধরনের মুখস্থবিদ্যা সৃষ্টিশীল নয় বলে এটি জ্ঞানের অতীত এবং ভবিষ্যৎ সেতু তৈরি করে না। মুখস্থবিদ্যা কোন বুদ্ধিমত্তার সূচক নয়। বুদ্ধিমত্তা নির্ভর করে সৃষ্টিশীল কাজের উপর। যা বাস্তব প্রয়োগ ক্ষেত্রে হাতে কলমের জ্ঞান থেকে আসে। মুখস্থবিদ্যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা একটি লেখার মূলভাব, লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছুই বুঝতে পারেনা।
প্রায়শই গানিতিক সমস্যাগুলো মুখস্ত করা যায় না। মুখস্থ করলে যদি সমস্যার ভেরিয়েন্ট পরিবর্তন করে দেয়া হয় তাহলে সেই অংক সে সমাধান করতে পারেনা। মুখস্ত বিদ্যা এক্ষেত্রে সৃষ্টিশীল কোন কাজে লাগে না।
অর্থনৈতিক ক্ষতি
কুরআন মুখস্থ করা আসলে কোন জ্ঞান নয়, এটি একটি বিশ্বাস। এই বিশ্বাস ধর্মীয় মর্যাদা দিতে পারলেও সমাজের উৎপাদন খাতে কোন কাজে লাগে না।
তাছাড়া, আরবি ভাষা কোন আন্তর্জাতিক ভাষাও নয়। অথচ, এই ভাষাটি শিখতে গিয়ে জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিপুল অংকের টাকা খরচ হয়। যদিও এর কার্যকরীতা নামাজ এবং দোয়া কালাম পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। এ দিয়ে যে রোজগার হয় তা দিয়ে চলা যায় না।
এর অর্থনৈতিক কোন গুরুত্ব শূন্য। কেননা, এটি উৎপাদক শ্রেণী তৈরি করে না। ফলে এটি উৎপাদনশীল খাতে কোন কাজে লাগে না।
এ ধরনের মুখস্থবিদ্যা আমাদেরকে উদ্যোক্তা কিংবা উদ্ভাবক হিসেবে গড়ে তুলেনা। মুখস্থবিদ্যায় পারদর্শীরা সাধারণ জ্ঞানে অপারগ হয়। ফলে চাকরি ক্ষেত্রে ভাইবা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় না। ফলে যেকোনো বৃত্তিমূলক কাজ নিতে গেলে দুর্নীতির আশ্রয় নিতে হয়। ধর্মগ্রন্থ মুখস্থ করা ব্যক্তিদের চিন্তা শক্তি মৃত থাকে। তার জীবনের ক্যারিয়ার গঠনে তাদের কোন ইচ্ছা শক্তি থাকেনা। কোরআন মুখস্থকারীরা চাকরির নির্ভর জীবিকা ছাড়া আপন মেধা ও বুদ্ধিমত্তার দ্বারা নিজেরা উদ্যোক্তা হতে পারেনা।
কুরআন মুখস্থ করতে পারলে বেহেশতে যাবে, এটি কোরআনে নাই। তবে কুরআন মুখস্থ করলে বেহেশতে যাওয়া যাবে এই বিশ্বাস মুসলমানদেরকে অনেক বেশি মানসিক উৎসাহ দেয়, যার মধ্যে রয়েছে সুখ, তৃপ্তি এবং ইতিবাচক মনোভাব।
কোরআন মুখস্থের এতএত সমস্যা থাকার পরেও অভিভাবকরা তার সন্তানকে কুরআন মুখস্থ করাতে চায়। অন্যান্য কারণের মধ্যে আরো একটি কারণ হলো, নিজেদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি। যদিও সমাজ সেবার মাধ্যমে নিজেদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করা যেত। কিন্তু কোরআনে হাফেজ বানালে পরকালে সুখ নিশ্চিত হবে এই আশায় আরো বেশি আগ্রহ হয়।
কোরাআন মুখস্থ করার ঝুকি!
বিভিন্ন কারণে মুখস্থবিদ্যা নষ্ট হতে পারে। এটা একটা ঝুকিও বটে। যেমন, ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় একজন হাফিজের স্মৃতিশক্তি নষ্ট হতে পারে। মস্তিষ্কে প্রদাহ কিংবা আঘাতজনিত কারণে তার মুখস্থকরা সবটুকু জ্ঞান নষ্ট হয়ে যেতে পারে। কিন্তু যে ব্যক্তি বাস্তব ক্ষেত্রে, হাতে-কলমে শিক্ষা পায় তার ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা ঘটে না।
যেহেতু, মাদ্রাসা শিক্ষা প্রধানত ধর্মীয় শিক্ষার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, এটি আসলে কোন নির্দিষ্ট ক্যারিয়ার দক্ষতা প্রদান করে না।
প্রধান চাকরির বিকল্পগুলি হল একজন মাওলানা (একটি মাদ্রাসায় শিক্ষক) বা ইমাম (যিনি একটি মসজিদে বক্তৃতা দেন বা ইমামতি করেন)। এই দুটি বিকল্প খুব লাভজনক নয়। একটি আন-সহায়তাবিহীন মাদ্রাসায় একজন মাওলানা প্রতি মাসে মাত্র 5000/ থেকে 10,000/ টাকা আয় করতে পারে। যা তার নিশ্চিত সুখি জীবন গড়ে না।
তাছাড়া বর্তমানে বিভিন্ন স্কলার একটি বিষয়ে নিশ্চিত যে, এ পর্যন্ত প্রায় ২৬টি আলাদা আলাদা কোরানের ভার্সন পাওয়া গেছে। যা উচ্চারণ জনিত কারণে ভিন্নঅর্থ প্রকাশ করে। সবগুলোকে একসাথে করলে পার্থক্যের পরিমাণ প্রায় ৯৩০০০ দেখা যায়। এতে আদি কোরানের মূল বক্তব্য না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। এমতবস্থায়, একটি নির্ভূল কোরআন কেউ মুখস্ত করেছে- সেটা কেউ বলতে পারবেনা।
তাছাড়া, নবীর কাছে যেসব ওহি নাযিল হয়েছিল, আবুবকর যখন সেগুলো লিপিবদ্ধ করেছিলো তারপর উসমান সেগুলো ধ্বংস করে দেয়। এখন আর অরিজিনাল কোরআনের কোন অস্তিত্ব নাই। যা আছে সেগুলো এখন ” উসমানি কোডেক্স” নামে পরিচিত।
অতএব, যুগের সাথে তালমিলিয়ে এখন দরকার হাতে, কলমে, আধুনিক ও কারিগরী জীবনমুখী শিক্ষা। যা জীবন বাঁচাতে এবং সাঁজাতে কাজে লাগবে।
আপনার মতামত জানানঃ