বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে শিশুদের মধ্যে দেরিতে কথা বলতে শেখার প্রবণতা বাড়ছে৷ এমনকি এটা এখন কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভয়ের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে৷
শিশু চিকিৎসক ও মনোচিকিৎসকরা বলছেন, নানা কারণে শিশুরা দেরিতে কথা বলতে পারে৷ এটা বংশগত বা মস্তিষ্কে কোনো সমস্যার কারণেও হতে পারে৷ তবে এই সময়ে বিশেষ করে শহর এলাকায় শিশুদের বাবা-মা সময় না দেয়ায় তারা দেরিতে কথা বলছে৷ তারা যে কথা শিখবে তার আগে তাদের কথা শুনতে হবে৷ আর এটার ‘ইন্টারঅ্যাকশন’ না হলে তারা কথা বলা শিখবে না৷
যদি একক পরিবার হয় এবং বাবা-মা দুইজনই কর্মজীবী হন তাহলে শিশুদের এই সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি বলে মনে করেছেন তারা৷ অনেক বাসায় গৃহকর্মীরা শিশুদের মোবাইল ফোন দিয়ে বা টিভি ছেড়ে বসিয়ে রাখে৷ তখন যোগাযোগ হয় এক পাক্ষিক৷ শিশুটি শুধু শোনে৷ বলতে শেখে না৷ এটা হলো ‘কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডার’৷
বিষয়টি নিয়ে কিছুদিন আগে কানাডায় একটি গবেষণা পরিচালিত হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, শিশুদের খাওয়ানোর কাজটা সহজ করতে অনেক পিতা-মাতা এসব স্ক্রিনের সাহায্য নিয়ে থাকেন। বাচ্চাদের হাতে তুলে দেন মোবাইল, ট্যাব বা স্ক্রিনযুক্ত ডিভাইস। এতে শিশুরা ওই ডিভাইসের স্কিনে বুধ হয়ে থাকে।
কিন্তু এর পরিণতি যে মারাত্মক ক্ষতিকর তা হয়তো তারা জানেনই না। ফলে শিশুদের দক্ষতার বিকাশে বিলম্ব ঘটে। এর মধ্যে কথা বলতে এবং অন্যান্যদের সাথে মেলামেশা শিখতে দেরি হয়।
কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাচ্চার বয়স দেড় বছর হওয়ার আগ পর্যন্ত তাদেরকে স্ক্রিন ব্যবহার করতে দেওয়া ঠিক নয়। তবে এজন্যে সুনির্দিষ্টভাবে কোন বয়সসীমা বেঁধে দেওয়া খুব কঠিন বলে মনে করছেন অনেক বিশেষজ্ঞ।
গবেষণায় দেখা গেছে, দুই বছর বয়সী বাচ্চারা প্রতি সপ্তাহে গড়ে ১৭ ঘণ্টা করে স্ক্রিনের সামনে কাটায়। কিন্তু তাদের বয়স যখন তিনে পৌঁছায় তখন তাদের স্ক্রিন টাইমও বেড়ে দাঁড়ায় সপ্তাহে ২৫ ঘণ্টা। আবার যখন পাঁচ বছর হয় তখন সেটা কমে হয় ১১ ঘণ্টা। সাধারণত শিশুরা এই সময়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু করে।
গবেষণার ফলাফলে বলা হয়েছে, স্ক্রিন টাইম বেড়ে যাওয়ার কারণে শিশুদের বিকাশে যে দেরি হয় সেটা খুব সহজেই চোখে পড়ে। দেখা গেছে, ঠিক তখনই স্ক্রিন টাইম আরো বেড়ে গেছে।
গবেষকরা বলছেন, বাচ্চারা স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে যে সময়টা পার করছে, এই সময়ে তারা গুরুত্বপূর্ণ আরো অনেক কিছু শিখতে পারতো। এই সময়ে আরেকজনের সাথে কথা বলা ও শোনার দক্ষতা তৈরি হতে পারে। দৌড়ানো, কোন কিছু বেয়ে উপরে ওঠার মতো শারীরিক দক্ষতাও সে অর্জন করতে পারতো।
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আব্দুল্লাহ শাহরিয়ার বলেন, ‘‘এটার কোনো জরিপ নেই৷ তবে আমরা এখন শিশুদের এই ধরনের সমস্যা বেশি পাচ্ছি৷”
তিনি বলেন, ‘‘শিশুরা যদি আট বছর বয়সেও কথা বলতে না পারে তাহলে সেটা ভয়ের৷ তখন তাদের আর স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় কথা বলানো সম্ভব নয়৷ তাদের জন্য বিশেষ চিকিৎসা ও কেয়ার প্রয়োজন হয়৷”
তিনি জানান, শিশুদের যদি বাবা-মা সময় না দেয়, সে যদি ডিভাইস নির্ভর হয়ে পড়ে তাহলে যে তার পরিবেশের কারণেই ঠিক সময়ে কথা বলতে পারবে না৷
সাধারণত একটি শিশু এক বছর বয়স থেকে কথা বলা শুরু করে বলে জানান শিশু হাসপাতালের চিকিৎসক ও শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. নাজমুল আলম৷
তিনি বলেন, ‘‘যাদের কথা বলতে দেরি হয় তাদের মানসিক বৃদ্ধি দেরিতে হয়৷ দুই বছরে শিশু দুই-চারটি শব্দ বলবে৷ সেটা যদি সে আট বছরে বলে তাহলে তার মানসিক বয়স দুই বছর, যদিও ফিজিক্যাল বয়স আট বছর৷”
তিনি জানান, এই সমস্যা শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারাবিশ্বে এখন দেখা যাচ্ছে৷ কারণ শিশুদের বাবা- মা সময় না দিয়ে ইলেকট্রনিক ডিভাইস নির্ভর করে তুলছে৷ মোবাইল ফোন হলো ওয়ান ওয়ে৷ এদিয়ে শিশু কথা শেখে না৷ ফোনের ডিসপ্লেই হয়ে যায় তার পৃথিবী৷ কোনো কিছু শেয়ার করা, কথা বলা তার চিন্তার বাইরে থেকে যায়৷
তাই শিশুদের সময় দিতে হবে৷ তাদের কাছ থেকে ডিভাইস দূরে রাখতে হবে বলে পরামর্শ দেন তিনি৷
তিনি জানান, কথা বলতে দেরি হলে স্পিচ থেরাপিসহ নানা চিকিৎসা আছে৷ শিশুর ফিজিকাল বয়স ও মানসিক বয়স পরিমাপ করে ব্যবস্থা নেয়া হয়৷
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের শিশু মনোচিকিৎসক অধ্যাপক ড. হেলালউদ্দিন জানান, ‘‘এটা আসলে শিশুদের কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডার৷ আমরা জরিপে দেখেছি শিশুদের শতকরা ১৩ ভাগ নানা ধরনের মানসিক সমস্যায় ভোগে৷ তাদের মধ্যে শতকরা ছয় ভাগ অটিজমসহ কম্যুনিকেশন ডিজঅর্ডারের সমস্যায় ভোগে৷”
তিনি বলেন, ‘‘শিশু তার প্রথম বছরেই মানে ১২ মাসের মধ্যে বাবলিং করবে৷ আর ছয় বছরের মধ্যে পুরো কথা বলা শিখে যাবে৷ এরচেয়ে দেরি হলে চিন্তার কারণ আছে৷”
শিশু ঠিক সময়ে কথা না বললে সাধারণভাবে অভিভাবকরাই এর জন্য দায়ী বলে উল্লেখ করেন তিনি৷
তিনি বলেন, ‘‘শিশুর সাথে কথা বলতে হয়৷ তাকে কথা বলতে উৎসাহিত করতে হয়৷ এটা তো যন্ত্র করবে না৷ আর শিশুদের অনেক সময় চুপ করিয়ে দেয়া হয়৷ কথা বলতে বারণ করা হয়৷ এটাও ক্ষতিকর৷”
তিনি শিশুদের সঙ্গে বাবা-মার কোয়ালিটি সময় কাটানোর সঙ্গে সঙ্গে তাদের সামাজিক করার পরমর্শ দেন৷
এসডব্লিউ/এসএস/১৪১৫
আপনার মতামত জানানঃ