ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এএফ রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রিয়াজুল ইসলাম এবং ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়কে নিয়ে ‘ইতিবাচক’ সংবাদ না করায় সাংবাদিককে মারধর করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের এক কর্মীর বিরুদ্ধে। বৃহস্পতিবার (১৪ এপ্রিল) হলের ১১৫ নম্বর কক্ষে এ ঘটনা ঘটে।
অভিযোগকারী রিফাত হক একটি অনলাইন পোর্টালের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। তাকে মারধরে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ কর্মী ফারহান তানভীর ওরফে নাসিফ ভাষাবিজ্ঞান বিভাগে একই বর্ষে অধ্যয়নরত।
এ ঘটনায় হল প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন সাংবাদিক রিফাত হক।
তিনি বলেন, ‘গত ১১ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারে অনশনরত মহিউদ্দিন রনির অনশন ভাঙাতে যান ঢাবি ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান। ওই সময় ছাত্রলীগ সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়ও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আমি যে অনলাইন পোর্টালে কাজ করি সেই অনলাইন পোর্টালে ’রনির অনশন ভাঙালেন ঢাবি ভিসি’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। সংবাদে জয়ের নাম হাইলাইট না হওয়ায় নাসিফ আমার সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়ায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘গতকাল এফআর হল ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক মুনেম শাহরিয়ার মুনের একটি লেখা আমার নিউজ পোর্টাল করে। মুনেম শাহরিয়ার ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেনের অনুসারী। মুনের লেখা প্রকাশ হওয়ায় সেটি নিয়ে আজ আমাকে আবারও জিজ্ঞাসাবাদ করে নাসিফ।’
‘তুই যদি আমার জুনিয়র হইতি তাহলে তোরে লাথি মেরে হল থেকে বের করে দিতাম।’ আমি এ কথার প্রতিবাদ করলে নাসিফ আমার তলপেটে লাথি মারে, বুকে ও মুখে উপর্যুপরি ঘুষি মারে,’
তিনি বলেন, ‘তুই রিয়াজুল ইসলাম ভাইয়ের (এফ আর হল ছাত্রলীগ সভাপতি) গ্রুপে থাকিস আর নিউজ করিস অন্য গ্রুপের নেতার, নিজের গ্রুপের নেতাদের নিউজ করিস না!’ এক পর্যায়ে তিনি বলেন, ‘তুই যদি আমার জুনিয়র হইতি তাহলে তোরে লাথি মেরে হল থেকে বের করে দিতাম।’ আমি এ কথার প্রতিবাদ করলে নাসিফ আমার তলপেটে লাথি মারে, বুকে ও মুখে উপর্যুপরি ঘুষি মারে,’ যোগ করেন তিনি।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত ফারহান তানভীর নাসিফ বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ওই সাংবাদিক অভিযোগ এনেছেন৷ তিনি আমার বন্ধু, নিজেদের মধ্যে একটু খুনসুটি হয়েছে৷’
হল ছাত্রলীগ সভাপতি রিয়াজুল ইসলাম বলেন, ‘তাদের ২ জনের মধ্যে আগে থেকে কোনো ঝামেলা ছিল৷ এর জের ধরে কথা কাটাকাটি হয়েছে৷ এর সঙ্গে ছাত্রলীগ জড়িত না৷’
অভিযুক্ত ছাত্রলীগ কর্মী ও ওই সাংবাদিক একই সঙ্গে এ এফ রহমান হলের ১১৫ নম্বর কক্ষে থাকেন। কক্ষটি হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রিয়াজুল ইসলামের নিয়ন্ত্রণে। এই হলের ১০৪টি কক্ষের প্রায় সবই হল শাখা ছাত্রলীগের দুই পক্ষের নিয়ন্ত্রণে। মূলত এসব কক্ষে কারা থাকতে পারবেন, তা ঠিক করেন ছাত্রলীগের নেতারাই। ওই সাংবাদিকও ‘বাধ্য হয়েই’ রিয়াজুলের পক্ষের মাধ্যমে কক্ষটিতে থাকেন। রিয়াজুল ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খানের অনুসারী।
অভিযুক্ত ফারহান তানভীর বলেন, ‘রিফাতের সঙ্গে আমার রাজনীতি নিয়ে টুকটাক কথা হয়েছে। তাকে কোনো মারধর করিনি। অনেক কিছু অতিরঞ্জিত করে বলা হচ্ছে। এসব বলার পেছনে হয়তো রিফাতের কোনো রাজনৈতিক প্রতিহিংসা আছে।’
হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রিয়াজুল ইসলামও দাবি করেন, রিফাতের সঙ্গে ফারহানের তর্কাতর্কি হলেও কোনো মারধরের ঘটনা ঘটেনি। তিনি বলেন, ‘রিফাত ও ফারহান- দুজনকেই ডেকে কথা বলেছি। আমি জানতে পেরেছি, তর্কাতর্কি হলেও রিফাতকে কোনো মারধর করা হয়নি। রিফাত ও ফারহানকে আমি মিলিয়ে দিয়েছি।’
এ ঘটনায় বিচার চেয়ে বৃহস্পতিবার রাতে স্যার এ এফ রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ কে এম সাইফুল ইসলাম খানের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন রিফাত হক। প্রাধ্যক্ষ বলেন, তিনি লিখিত অভিযোগটি পেয়েছেন। অবিলম্বে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে মানবাধিকারবিষয়ক শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্ম ‘স্টুডেন্টস অ্যাগেইনস্ট টর্চার (এসএটি)এর তথ্যমতে, গত ৫ অক্টোবর থেকে শুরু করে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ মাসে ছয়টি হলে ১৮ জন শিক্ষার্থী শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এছাড়া ৩ জন সাংবাদিক ও দুইজন ফটো সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এসব ঘটনায় নির্যাতকের ভূমিকা পালন করেছে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দিন দিন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগ। বিতর্ক যেন কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের পাশাপাশি ভিন্নমতের ছাত্র সংগঠন ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে তারা। ছাত্রলীগ নেতাদের বেপরোয়া হয়ে ওঠার কারণেই সাংবাদিক থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের কেউ তাদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। দলীয় প্রভাব খাটিয়েই ছাত্রলীগ নেতারা এ ধরনের কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। সরকার দলীয় বিধায় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলতে কেউ সাহস করে না। এমনকি প্রশাসনও কোনো ভূমিকা নিতে পারে না। এসবের শাস্তি নিরূপণ নয়, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও দাবি করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিগত কয়েক দশকে বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন, হয়রানি ও আক্রমণের বেড়ে যাওয়ায় পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন এ পেশার অনেকেই। আইনের দীর্ঘসূত্রিতা, জটিল বিচারিক প্রক্রিয়া সেইসঙ্গে রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠান পক্ষ থেকে কোন ধরণের সহযোগিতা না থাকার কারণে সাংবাদিক নির্যাতন ও সহিংসতা থামানো যাচ্ছেনা। সাংবাদিকদের স্বার্থ রক্ষায় সক্রিয় কোন প্ল্যাটফর্ম না থাকায় এই পেশা দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে বলেও মন্তব্য করেন তারা।
তারা বলেন, সাংবাদিকরা নির্যাতনের শিকার হলেও সেগুলো আদালতে নিতে চান না। কেননা মামলা করতে গেলে প্রতিষ্ঠান থেকে যে সাপোর্ট লাগে বা অর্থনৈতিকভাবে যে সাপোর্ট লাগে, সেটা তাদের সবার থাকেনা। এ অবস্থায় বিচার নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে যায়। বাংলাদেশের সংবিধানে মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলা হলেও রাষ্ট্রীয় সামাজিকভাবে সেই স্বাধীনতা নিশ্চিত করা যায়নি বলে জানান তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৩৪
আপনার মতামত জানানঃ