কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার ভারতীয় সীমান্তের হায়দারাবাদ এলাকায় মহিউদ্দিন সরকার নামে এক সাংবাদিক গুলিতে নিহত হয়েছেন। বুধবার(১৩ এপ্রিল) রাত সাড়ে ৯টার দিকে এই ঘটনা ঘটে।
তিনি কুমিল্লার স্থানীয় পত্রিকা দৈনিক কুমিল্লার ডাক এর স্টাফ রিপোর্টার ও আনন্দ টিভি সাবেক বি-পাড়া প্রতিনিধি। মহিউদ্দিন সরকার বি-পাড়া উপজেলার মালাপাড়া ইউনিয়নের অলুয়া গ্রামের মোশাররফ সরকার এর ছেলে।
মহিউদ্দিন দুই ভাই আর এক বোনের মধ্যে বড় ছিলেন। ছোট ভাই হৃদয় সরকার সৌদি আরবে থাকেন। একমাত্র বোন শারমিন আক্তার কুমিল্লা শহরে স্বামীর বাড়িতে থাকেন। তার বাবা মোশাররফ হোসেন বাংলাদেশ পুলিশে দীর্ঘ ৩৪ বছর চাকরি শেষে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি অবসরে যান। তিনি পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক ছিলেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বুধবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে মহিউদ্দিন এক সহযোগীসহ মোটরসাইকেলে করে পাচোরা এলাকায় গেলে দুর্বৃত্তরা তাকে গুলি করে। সেখান থেকে আহত অবস্থায় বিজিবি সদস্যরা মহিউদ্দিনকে উদ্ধার করে স্থানীয় রাব্বী ও রুবেল নামে দুই যুবকের মাধ্যমে বুড়িচং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রেরণ করে। রাত সাড়ে ১০টায় তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে আসা হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, মাদক ও মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় তাকে হত্যা করা হয়েছে। তার বাড়ি জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলায় হলেও বুড়িচং উপজেলা পর্যায়েও মাদকবিরোধী কর্মকাণ্ডে বেশ তৎপর ছিলেন। পুলিশ, র্যাব, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও উপজেলা প্রশাসনকেও মাদকবিরোধী অভিযানে সাহায্য করতেন। মাদকের চোরাচালান ধরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে অন্যরকম গুণ ছিল। সে কারণে তাকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরে নিয়োগ করারও চেষ্টা ছিল বিভিন্ন সংস্থার।
জানা গেছে, বুড়িচং উপজেলার শীর্ষ মাদক কারবারি রাজুর বিরুদ্ধে যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পরপর তিনটি স্ট্যাটাস দেওয়া এবং সীমান্ত এলাকায় বেশ কিছু মাদকের চালান ধরিয়ে দিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সাহায্য করাই তার প্রাণনাশের মূল কারণ। সম্প্রতি মাদকের বিরুদ্ধে শক্তিশালী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা প্রশাসন। সীমান্তে কড়া নজরদারি বাড়ায়। গেলো কয়েক মাসে ওই উপজেলায় মাদকের বেশ কিছু বড় চালান ধরা পড়ে। ওইসব অভিযানে মহিউদ্দিন অংশগ্রহণ করতেন। তাছাড়াও ওইসব অভিযানের অন্যতম সোর্স ছিলেন। বুড়িচং উপজেলার মাদক সংশ্লিষ্ট সব সংবাদও প্রচার করতেন। মাদক ব্যবসায়ী রাজুর সঙ্গে কয়েকদিন পূর্বেও বুড়িচং এলাকায় এই সাংবাদিকের সঙ্গে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। রাজুর বাড়ি বাংলাদেশে হলেও ভারতে তার বহু আত্মীয়স্বজন রয়েছে। অনেকেই ধারণা করছেন, তার দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে।
মাদকের চোরাচালান ধরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে অন্যরকম গুণ ছিল। সে কারণে তাকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরে নিয়োগ করারও চেষ্টা ছিল বিভিন্ন সংস্থার।
ধারণা করা হচ্ছে, ভারতের মাদক কারবারিরা সীমান্তে মাদক, চোরাচালান ও অস্ত্র চালানের বিষয়ে বেশ তৎপর হয়ে উঠেছিল। সবমিলিয়ে মহিউদ্দিন দুই দেশের সীমান্ত সন্ত্রাসীদের জন্য আতঙ্কের কারণ হয়ে ওঠে। আতঙ্কের কারণ হয়ে ওঠা ও উপজেলা প্রশাসনের মাদকবিরোধী কড়া অবস্থানের কারণে পাল্টা চ্যালেঞ্জ হিসেবে মহিউদ্দিনকে হত্যা করা হতে পারে।
পরিবারের সদস্য ও স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুলিশ ও র্যাবকে তথ্য দিয়ে মাদকদ্রব্য জব্দ করতে সহায়তা করায় এবং মাদক ব্যবসা নিয়ে প্রতিবেদন করায় মাদক ব্যবসায়ীরা মহিউদ্দিনের ওপর ক্ষিপ্ত ছিল। এ কারণেই মাদক ব্যবসায়ীরা গতকাল বুধবার রাত নয়টার দিকে বুড়িচং উপজেলার সংকুচাইল হায়দারাবাদ ভারতীয় সীমান্ত এলাকায় গুলি করে নির্মমভাবে মহিউদ্দিনকে হত্যা করেছে।
মহিউদ্দিনের বাবা মোশাররফ হোসেন সরকার সংবাদমাধ্যমকে বলেন, সব সময় তিনি তার ছেলেকে ন্যায়ের পথে থাকার কথা বলেছেন এবং ভালো কাজ করা শিখিয়েছেন। তার ছেলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের গুলিতে মারা গেছেন। তিনি তারা ছেলের খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
নিহত সাংবাদিক মহিউদ্দিনের দীর্ঘদিনের বন্ধু স্থানীয় সাংবাদিক মাহফুজ বাবু বলেন, মহিউদ্দিন দীর্ঘদিন ধরে সাংবাদিকতা করছেন। সব সময় মাদক ও মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন করেছেন। এসব কারণে মাদক ব্যবসায়ীরা তার ওপর ক্ষিপ্ত ছিলেন।
জানা গেছে, সাংবাদিক মহিউদ্দিন বেশ কয়েকবার পুলিশকে তথ্য দিয়ে বুড়িচং উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের সংকুচাইল এলাকার মাদক ব্যবসায়ী রাজু মিয়ার বিভিন্ন মাদকদ্রব্য জব্দ করতে সহায়তা করেছিলেন। এ নিয়ে রাজুর সঙ্গে মহিউদ্দিনের দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব রয়েছে। গত ২৬ মার্চ মহিউদ্দিন পেশাগত কাজে সংকুচাইল যান। ওই সময় সংকুচাইল বাজারে পুলিশ মহিউদ্দিনের মোটরসাইকেলের গতিরোধ করে। এ সময় তিনি পুলিশকে বলেন, ‘মাদক ব্যবসায়ীর মালামাল না ধরে আমাকে আটকালেন কেন।’
পরে মাদক ব্যবসায়ী রাজু এ কথা শোনার পর মহিউদ্দিনের সঙ্গে এ নিয়ে তার বাগ্বিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে রাজু তাকে চড় মারেন। পরে মহিউদ্দিন রাজুকে গ্রেপ্তার এবং তার মাদকদ্রব্য ধরিয়ে দিতে তৎপর হয়ে ওঠেন।
গত বুধবার স্থানীয় দুই ব্যক্তি মহিউদ্দিনকে ওই দিন রাতে রাজুর মাদকের চালান পাচার হবে বলে জানান।
সাংবাদিক মহিউদ্দিন সরকারের এক বন্ধু বলেন, গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় মুঠোফোনে মহিউদ্দিন সরকার নাঈমকে ভারতীয় সীমান্তবর্তী কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের শংকুচাইলসংলগ্ন হায়দ্রাবাদ নগর এলাকায় ডেকে নেন জনৈক ব্যক্তি। এরপর মহিউদ্দিন রাতে সেখানে যান। এরপর মাদক কারবারিদের সঙ্গে তার কথা–কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে মাদক কারবারি মো. রাজু ও মো. জুয়েল পিস্তল দিয়ে মহিউদ্দিনকে গুলি করেন। এ সময় আরও কয়েকজন সঙ্গী তাকে লোহার রড দিয়ে মারধর করে পালিয়ে যান।
পরে বিজিবির শংকুচাইল ক্যাম্পের সদস্যরা স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় তাকে বুড়িচং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেন। সেখানে নেওয়ার আগেই মহিউদ্দিন মারা যান। খবর পেয়ে বুড়িচং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যান কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান ও জেলা পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ।
বুড়িচং থানার ওসি আলমগীর হোসেন জানান, মহিউদ্দিনের শরীরে পাঁচটি আঘাতের চিহ্ন আছে। তার লাশ ময়নাতদন্ত শেষে কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে বাড়িতে নেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় এখনও কোনও মামলা হয়নি। তবে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে রাজু নামক এক মাদক কারবারির সংশ্লিষ্টতার কথা উঠে আসছে। তাকে ধরতে অভিযান অব্যাহত আছে।’
মহিউদ্দিনের বাবা ও অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা মোশারফ সরকার বলেন, ‘আমার ছেলে মাদকের বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থানে ছিল, তাই তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। তারা পরিকল্পিতভাবে এই হত্যাকাণ্ড করেছে। এখন আমরাও আতঙ্কিত। তারা কখন আমাদের মেরে ফেলে কে জানে।’
ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সোহেল রানা জানান, মাদকের বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণপাড়া এলাকায় অভিযান আরও জোরালো করা হবে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, সারা বিশ্ব দেখছে, এই দেশটি সাংবাদিক নিপীড়নকারী দেশ এবং গণমাধ্যমের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করে এমন একটি দেশ। সাংবাদিকদের স্বাধীনতা চাই, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা চাই। সাংবাদিকতার স্বাধীনতা রাষ্ট্রের জন্য, সরকারের জন্য এবং সুশাসনের জন্য দরকার।’
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মফস্বলের প্রত্যেকটা সাংবাদিক পরিচিত। সবাই সবাইকে চেনে। ওখানে কোন সংবাদ হলে তাকে টার্গেট করা সহজ। ঢাকায় সেটা সম্ভব না। মফস্বলের সাংবাদিক প্রতি মুহুর্তে, প্রতিদিনই ঝুঁকির মধ্যে থাকে।মফস্বল সাংবাদিকদের কোনো ধরনেরই নিরাপত্তা নেই৷ আর্থিক বা শারীরিক কেনোটাই না৷ অধিকাংশ সাংবাদিক বেতন পান না আবার প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও দুর্বৃত্তদের চাপের মুখে থাকতে হয়। শীঘ্রই পরিস্থিতির কোন পরিবর্তন হবে—এমন আশাও করেছন না বিশেষজ্ঞরা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২১৩৪
আপনার মতামত জানানঃ