ঢাকায় গাড়ির গতি হাটার গতির চেয়ে কম। ইদানীং মনে হয় এই শহর যেন নড়ছেই না এবং দিনকে দিন পরিস্থিতি আরো খারাপ হচ্ছে। যানজটের কারণে সময় ও অর্থ নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু সেই সাথে শহরের বাসিন্দারা যানজটে বসে বসেই নানা স্বাস্থ্য সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। এই স্বাস্থ্য সমস্যার বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতিও রয়েছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট রমজানের প্রথম দিন, গত তেসরা এপ্রিল ঢাকার মূল সড়কগুলোতে গাড়ির গতির উপর এক গবেষণা চালিয়েছে। যাতে দেখা গেছে সেদিন ঢাকায় গাড়ির গড় গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় চার দশমিক আট কিলোমিটার।
দুই হাজার পাঁচ সালে একই ইন্সটিটিউটের করা গবেষণায় দেখা গিয়েছিল সেসময় ঢাকা শহরে ঘণ্টায় গাড়ির গড় গতি ছিল প্রায় ২১ কিলোমিটার।
অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের পরিচালক গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোঃ হাদিউজ্জামান বলছেন, ঢাকা শহরের হৃৎস্পন্দন ভয়াবহভাবে কমে গেছে। এই যে গাড়ির ঘণ্টা প্রতি গতি বললাম এটা একজন সুস্থ মানুষের হাঁটার গতির চেয়ে কম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে একজন সুস্থ মানুষ যদি স্বাভাবিক গতিতে হাঁটেন তাহলে তিনি ঘণ্টায় পাঁচ কিলোমিটার বেগে হাঁটতে সক্ষম। জোরে হাঁটতে হবে না, স্বাভাবিক গতিতে হাঁটলেই হবে। ঢাকায় এখন একজন সুস্থ মানুষ হেঁটে গাড়ির আগে যেতে পারবেন।
দুই হাজার সতের সালে যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান যিপজেটের করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, এশিয়ার শহরগুলোর মধ্যে ঢাকাতে বাস করা সবচাইতে স্ট্রেসফুল বা মানসিক চাপের ব্যাপার। এর একটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল ঢাকার যানজট।
বাংলাদেশ লাঙ ফাউন্ডেশনের যুগ্ম সম্পাদক, বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ ড. কাজী সাইফুদ্দিন বেননুর বলছেন, ঢাকার যানজট বেশ কিছু স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ।
তিনি বলছেন, যানবাহন যখন এক যায়গায় অনেক সময় ধরে আটকে থাকে তখন দূষিত ধোঁয়া ওই জায়গাকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে, কারণ আমরা যানজটে গাড়ির ইঞ্জিন চালু রাখি। আপনার নিজের গাড়ি এবং আপনার আশপাশের সবার গাড়ির ধোঁয়া তখন আপনার কাছে আসছে। গাড়ি চলমান অবস্থায় ধোঁয়া বাতাসে উড়ে যায়।
এজন্য ট্রাফিক জ্যামে বসে থাকাকালীন একজন মানুষ দূষণে বেশি এক্সপোজড হচ্ছেন। দূষণের কারণে ফুসফুসের অসুখসহ নানা অসুখ হচ্ছে।
তিনি বলেন, গাড়ির ধোঁয়ায় রয়েছে সীসা। এছাড়া গাড়ি এক যায়গায় আটকে থাকার কারণে যে ধোঁয়া নির্গত হয় সেটিকে বলা হয় ইন-কমপ্লিট কমবাস্টন। এতে কার্বন মনোক্সাইড, ডাইঅক্সিন, নাইট্রিক অক্সাইড, সালফার অক্সাইড এরকম নানা গ্যাস বাতাসের সাথে মানুষের ফুসফুসে চলে যাচ্ছে।
এতে করে সুস্থ ফুসফুসেও শ্বাসকষ্ট হয়। দীর্ঘদিন এই গ্যাস দ্বারা দূষিত বাতাসে নিশ্বাস নিতে থাকলে এসব গ্যাস রক্তে মিশে যায় তখন তা ফুসফুসের স্থায়ী ক্ষতি করে। ফুসফুসের রোগ যেমন হাঁপানি, ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ, ইন্টারস্টিসিয়াল লাঙ ডিজিজের প্রবণতা বেড়ে যায়। এমনকি ফুসফুসে ক্যান্সারও হতে পারে।
যারা ইতিমধ্যেই ফুসফুসের নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত তাদের ক্ষেত্রে রোগটি আরও অনেক খারাপ পর্যায়ে চলে যেতে পারে।
তিনি বলেন, উচ্চ মাত্রায় সীসা মানুষের স্নায়ুতন্ত্রের উপর প্রভাব ফেলে। বহুদিন সীসাযুক্ত বাতাসে নিশ্বাস নিলে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা কমে আসে, কিডনি, হৃদযন্ত্র, প্রজননতন্ত্রের কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হয়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।
সীসা বিশেষ করে শিশুদের বেশি আক্রান্ত করে কেননা প্রাপ্ত বয়স্কদের শরীরে রক্তের সীসা মস্তিষ্কে পর্যন্ত পৌঁছানো প্রতিরোধের ব্যবস্থা শক্তিশালী থাকে। শিশুদের ক্ষেত্রে সেই ব্যবস্থা পুরোপুরি তৈরি হয়নি। এতে শিশুদের বুদ্ধিমত্তা বিকাশে এবং স্নায়ুবিক ক্ষতি হতে পারে।
এতে শিশুদের আই-কিউ কমতে থাকে। তার মানে আমরা কিন্তু কম আই-কিউ, কম বুদ্ধিমত্তার ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।
এছাড়া ট্রাফিক আটকে থাকা অবস্থায় এবং হঠাৎ জট খুলেও গেলে ঢাকার চালকদের গাড়ির হর্ন বাজানোর প্রবণতা বেশি। এতে শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বছর পনের আগে ঢাকার যানজটের কারণে তৈরি স্বাস্থ্যগত সমস্যা নিয়ে গবেষণা করেছিল বাংলাদেশ লাঙ ফাউন্ডেশন এবং সরকারের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ প্রিভেনশন অ্যান্ড সোশাল মেডিসিন। সেই গবেষণা দলে ছিলেন কাজী সাইফুদ্দিন বেননুর।
তিনি বলছেন, ঢাকার যানজটের পরিস্থিতি যে আগের চেয়ে কতটা খারাপ হয়েছে সেটি আমরা রাস্তায় বের হলেই বুঝতে পারি। এবিষয়ে নতুন কোন গবেষণা হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। কিন্তু স্বাস্থ্য সমস্যা যে বাড়ছে তা আমরা অভিজ্ঞতা দিয়েই বলতে পারি। যেমন আমাদের কাছে সম্প্রতি ইন্টারস্টিসিয়াল লাঙ ডিজিজের রোগী অনেক বেশি আসছেন।
ঢাকার রাস্তায় চালকদের নিজেদের মধ্যে অথবা যাত্রীদের সাথে ঝগড়া, হাতাহাতি, মারামারি রোজকার ব্যাপার। এইসব কিছুর একটি বড় উৎস যানজট, বলছিলেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ইশরাত শারমিন রহমান।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলছিলেন, নিয়মিত লম্বা সময় যানজটে বসে থাকার কারণে সময়মত গন্তব্যে পৌঁছাতে না পেরে, কাজের ক্ষতি, সময়মত কাজ জমা দিতে না পারা, আর্থিক ক্ষতি, নষ্ট সময় এসব কারণে উদ্বেগ তৈরি হয়।
যানজটের কারণে মানুষজনের মধ্যে ক্রোধ, আক্রমণাত্মক, মারমুখী, অস্থির, খিটখিটে আচরণ তৈরি হচ্ছে। কারণ সে যেতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না। একটা সময় হাতে নিয়ে সে বের হয়েছে কিন্তু লম্বা সময় বসে আছে। লম্বা সময় আটকে থাকার পর যখনই গাড়ি চলা শুরু হয় তখন মানুষজন অস্থির হয়ে ওঠে।
এবার যেতে না পারলে আবার দশ পনের মিনিটের জন্য আটকে যাবে। এজন্য অন্য আর একজনকে বাধা দিয়ে হলেও সে যেতে চেষ্টা করে। আর যে বাধাগ্রস্ত হয় অথবা কোন গাড়ি আস্তে চললেও রাগ তৈরি হয়।
ঢাকায় প্রতিদিনই যানজটে বসে থাকার অভিজ্ঞতা বাড়ছে। তাই এই রাগ, খিটখিটে মেজাজ ও উদ্বেগ দীর্ঘস্থায়ী মানসিক রোগে পরিণত হতে পারে। যানজটে বসে থাকার কারণে যে শারীরিক মানসিক অভিজ্ঞতা হয় তা দিনভর থাকতে পারে।
কর্মক্ষেত্রে পৌঁছানোর আগেই এত উদ্বেগের কারণে কর্মক্ষমতা, মনোযোগ, কর্মস্পৃহা কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। রাগ, খিটখিটে মেজাজ কর্মক্ষেত্রে, পরিবারে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ক্ষতি করার সম্ভাবনা তৈরি করে।
উদ্বেগ মনের স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলে এবং দীর্ঘস্থায়ী হলে তা শরীরেও প্রভাব ফেলে। উদ্বেগ থেকে মাথাব্যথা, বমি, পেশিতে ব্যথা হতে পারে। দীর্ঘদিন উদ্বেগের কারণে প্রায়শই আমরা দেখি একজন মানুষের কোন অসুখ থাকলে সেটা সহজে সারতে চায় না কারণ উদ্বেগ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।
প্রতিদিন যদি কেউ উদ্বেগে ভোগে তাহলে উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোকের সম্ভাবনা বাড়ে। গাড়ির চালক এবং ট্রাফিক পুলিশদের জন্য এ পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ।
এদিকে, ঢাকার ট্রাফিক সিগনালগুলোতে যে দুর্ঘটনাগুলো হয় সেগুলো সম্পর্কে কাজ করেছে অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট।
তাদের হিসেবে গত বছর ঢাকায় ট্রাফিক সিগনালগুলোতে শুধুমাত্র ‘পিক আওয়ারে’ অর্থাৎ অফিস যাওয়া ও বাড়ি ফেরার সময়গুলোতে ৮১ জন মারা গেছেন, ৪১ জন আহত হয়েছেন।
তবে গত বছর যেহেতু করোনাভাইরাস মহামারির কারণে যানবাহন চলাচলের উপর বিভিন্ন সময় বিধিনিষেধ ছিল তাই এই সংখ্যা সম্ভবত অন্য সময়ের চেয়ে কম হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৩০
আপনার মতামত জানানঃ