রাশিয়ার আসন্ন আগ্রাসী হামলার আতঙ্কে হাজার হাজার লোক পালিয়ে যাওয়ায় ইউক্রেন দেশটির পূর্বাঞ্চলে মস্কোর বিরুদ্ধে ‘বড় যুদ্ধের’ প্রস্তুতি নিচ্ছে। শনিবার (৯ এপ্রিল) পূর্ব ইউক্রেনের ক্রামাটরস্ক থেকে পুনরায় লোকদের সরিয়ে নেয়া শুরু হয়েছে, সেখানে একদিন আগে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ৫২ জন নিহত হয়েছে। এছাড়া দুই পক্ষই একে অন্যের উপর যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনছে। যা মূলত প্রতিনিয়ত জটিল করে তুলছে পরিস্থিতি।
মারিউপোলে পাঁচ হাজার মানুষ হত্যা
ইউক্রেনের বন্দরনগরী মারিউপোলে পাঁচ হাজার বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছে রুশ বাহিনী। এমনটি দাবি করেছেন রুশ সমর্থিত শহরের নতুন মেয়র কনস্ট্যান্টিন ইভাশচেঙ্কো।
ইভাশচেঙ্কো ঘোষণা করেছেন, ইউক্রেনের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবরুদ্ধ এই নগরীতে প্রায় ৫ হাজার বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে।
বিচ্ছিন্ন ডোনেৎস্ক অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নেতা ডেনিস পুশিলিন গত বুধবার কনস্ট্যান্টিন ইভাশচেঙ্কোকে মারিউপোল নগরীর মেয়রের নাম ঘোষণা করেছেন।
রুশ বার্তা সংস্থা তাস পরিবেশিত খবরে ইভাশচেঙ্কো বলেছেন, ২ লাখ ৫০ হাজার বাসিন্দা মারিউপোল নগরী ছেড়ে চলে গেছে।
ইউক্রেনীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, কমপক্ষে ৫ হাজার লোক নিহত হয়েছে। নগরীতে হাজার হাজার লোক হতাহত হয়েছে এবং নগরীর প্রায় ৯০ শতাংশ ধ্বংস হয়ে গেছে।
রুশ সেনাবাহিনী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীরা কয়েক সপ্তাহ ধরে মারিউপোল অবরোধ করে রেখেছে কিন্তু তারা ইউক্রেনের প্রচন্ড প্রতিরোধের মুখোমুখি হচ্ছে।
এদিকে, রাশিয়ার বাহিনীর সঙ্গে দেশের পূর্বে ‘ভয়াবহ’ যুদ্ধের জন্য প্রস্তত হচ্ছে ইউক্রেন। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি গতকাল শনিবার (৯ এপ্রিল) এই মন্তব্য করেছেন। রয়টার্সের প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে।
খবরে বলা হয়েছে, পূর্ব ইউক্রেনের শহরগুলো বিমান হামলার সাইরেন বেজে উঠেছে। রুশ বাহিনী জানিয়েছে, তারা পুর্ব ইউক্রেনে হামলার মনোনিবেশ ঘটিয়েছে।
গত শুক্রবার ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে বেসামরিক লোকজনে ঠাসা একটি রেল স্টেশনে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ঘটনা ঘটে। এতে নিহত হয়েছে ৫২ জন। এই হামলার জন্য রাশিয়াকে দায়ী করেছে ইউক্রেন। এর প্রেক্ষিতে কর্মকর্তারা লুহানস্কের নাগরিকদের পালিয়ে যেতে বলেছেন।
কিয়েভে অস্ট্রেলিয়ার চ্যান্সেলর কার্ল নেহামমের সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে জেলেনস্কি বলেন, হ্যাঁ, রুশ বাহিনী ইউক্রেনের পূর্ব দিকে সংগঠিত হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, এটি কঠিন লড়াই হবে এবং আমরা বিশ্বাস করি আমাদের জয় হবে। আমরা একইসঙ্গে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত এবং যুদ্ধ বন্ধে কূটনৈতিক উপায়ও খুঁজতে চাই।
ইউক্রেন যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতি
পুতিনের লক্ষ্য ছিল বিপুল শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে কয়েক দিনের মধ্যেই কিয়েভ দখল করে অবাধ্য জেলেনস্কি সরকারকে হটিয়ে সেখানে একটি ‘রাশিয়ার প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন’ (অর্থাৎ তাঁবেদার) সরকার বসিয়ে দিয়ে অভিযানের সমাপ্তি ঘটানো। তার পরিকল্পনা সফল হয়নি।
ছয় সপ্তাহের যুদ্ধে, ইউক্রেনে ব্যাপক আক্রমণ চালিয়েছে রাশিয়া, বেশ কিছু শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ৪০ লাখ মানুষ শরণার্থী হয়ে দেশ ত্যাগ করেছে, যার বড় অংশ নারী ও শিশু। কিন্তু তাতে প্রতিরোধ ভেঙে পড়েনি।
জাতিসংঘের হিসাবে কমপক্ষে ১ হাজার ৪১৭ জন ইউক্রেনীয় বেসামরিক নাগরিক যুদ্ধে নিহত হয়েছে, যার মধ্যে শতাধিক শিশু রয়েছে। ইউক্রেনের দক্ষিণ-পূর্বাংশে, বিশেষত মারিউপোল শহরে সংঘাত ও মানবিক সমস্যা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
রাশিয়ার তথ্যানুযায়ী গত ১৫ মার্চ পর্যন্ত তাদের ১ হাজার ৩৫০ জন সেনা নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ৩ হাজার ৮২৫ জন। তবে গার্ডিয়ান পত্রিকা জানায়, রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ৯ হাজার ৮৬১ জন রুশ সেনা প্রাণ হারিয়েছেন বলে স্বীকার করেছে। যুদ্ধে ইউক্রেনীয় সৈন্যদের প্রাণহানির সংখ্যা বিভিন্ন তথ্যমতে দুই সহস্রাধিক।
বিপুল রক্তপাতের পর পুতিন এখন পরিকল্পনা পরিবর্তন করে শুধু পূর্ব ইউক্রেনের দনবাস এলাকা দখলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মারিউপোলসহ আশপাশের এলাকা অধিকারের ফলে আজভ সাগরের উপকূল থেকে ইউক্রেন সম্পূর্ণ বিতাড়িত হবে এবং তাদের একমাত্র বন্দর থাকবে ওদেসা। ওদেসা দখলের জন্যও ব্যাপক বোমা ও গোলাবর্ষণ করছে রুশ বিমান ও নৌবাহিনী।
রুশ যুদ্ধবন্দিদের ওপর ইউক্রেনের অত্যাচার
ইউক্রেনের সৈন্যরা রাশিয়ার যুদ্ধবন্দিদের পায়ে গুলি করেছে দাবি করে একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। ইউক্রেন কর্তৃপক্ষ বলছে তারা এই দাবি তদন্ত করে দেখছে।
সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া অস্পষ্ট এই ভিডিওটি প্রথম প্রকাশ হয় ২৭শে মার্চ, রবিবার খুব ভোরে। এর পর থেকে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে রুশ সমর্থকদের অ্যাকাউন্ট থেকে এই ভিডিওটি বহুবার পোস্ট করা হয়।
ইউক্রেন সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ ভ্যালেরি জালুঝনি বলেছেন রাশিয়ান যুদ্ধবন্দিদের প্রতি ইউক্রেন দুর্ব্যবহার করছে বলে ইউক্রেনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে রাশিয়া “এই সাজানো ভিডিও তুলেছে এবং তা ছড়িয়ে দিচ্ছে।”
তবে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির একজন উপদেষ্টা অলেক্সি আরেস্তোভিচ বলেছেন বিষয়টি নিয়ে অবিলম্বে তদন্ত করা হবে এবং তিনি আরও বলেছেন, “আমি আমাদের সেনাবাহিনী, নাগরিক এবং প্রতিরক্ষা বাহিনীকে মনে করিয়ে দেব যে যুদ্ধবন্দিদের ওপর অত্যাচার ও নিপীড়ন একটা যুদ্ধাপরাধ।”
ইউক্রেনে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক পর্যবেক্ষণ মিশনের প্রধান, মাটিলডা বগনার বলেছেন তিনি “গভীরভাবে উদ্বিগ্ন” এবং তিনি নিশ্চিত করেছেন এই ভিডিও তদন্ত করে দেখা হবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭৫০
আপনার মতামত জানানঃ