দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এখন অর্থনীতিতে সবচেয়ে বিপর্যস্ত সময় পার করছে দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা। বিদেশি মুদ্রার অভাবে গুরুত্বপূর্ণ পণ্য আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। দাম পরিশোধ করতে না পারায় জীবন রক্ষাকারী ওষুধ থেকে শুরু করে সিমেন্ট পর্যন্ত সব গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের ভয়াবহ সংকট তৈরি হয়েছে। প্রতিদিন লোডশেডিং হচ্ছে ১৩ ঘণ্টা। বিদ্যুৎ সংকটের কারণে সড়কবাতিও বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
কাগজের অভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরীক্ষা ও দৈনিক পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেছে। মার্চ মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ১৮.৭ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৩০.২ শতাংশ। ফাস্টক্যাপিটাল রিসার্চের গবেষণা প্রধান দিমান্থা ম্যাথিউ বলেন গত কয়েক দশকের মধ্যে মুল্যস্ফীতির সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বিরাজ করছে শ্রীলঙ্কায়। সীমাহীন দুর্ভোগ সহ্য করতে না পেরে ৩১ মার্চ রাতে প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ শ্রীলঙ্কান জনসাধারণ।
শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতি থেকে অনেকেই বাংলাদেশকে শিক্ষা নিতে বলছে। এখানে প্রশ্ন, বাংলাদেশের জন্য কি একই পরিণতি অপেক্ষা করছে। কিন্তু কেন! উন্নয়নের ঘোড়ায় সওয়ার বাংলাদেশকে কেন শ্রীলঙ্কার পরিণতি নিয়ে শঙ্কিত হতে হবে?
এই শঙ্কাকে স্ট্যাব্লিশ করতে একটা পরিসংখ্যান দেখা যাক। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে, ২০১৭ থেকে ২০২১ এই চার বছরে মূল্যস্ফ্রীতির হার ২৮ দশমিক ৭ শতাংশ৷ অর্থাৎ ২০১৭ সালে ১০০ টাকা দিয়ে যে পণ্য কেনা যেত ২০২১ সালে এসে সেটি কিনতে খরচ করতে হচ্ছে প্রায় ১৩১ টাকা৷ আরও কিছু প্রসঙ্গ নিয়ে এখানে আলোচনা করা হলো।
মাথাপিছু আয়
বাংলাদেশ সরকার মাথাপিছু আয় আর জিডিপি দিয়ে দেশের অবস্থা ব্যাখ্যা করে আসছে বহুদিন ধরেই। তবে এখানে যে আছে তথ্যের ঘাটতি, তা নিয়ে কথা হচ্ছে না তেমন একটা। উন্নয়নের চাদর গায় চাপিয়ে ময়ূর সাজা আমরা কি আসলে ময়ূর নাকি কাক, সেটা এখন বড় প্রশ্ন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৫৯১ ডলার। এক সময় শ্রীলঙ্কার মাথাপিছু আয় এর থেকে বেশি ছিল। ২০০৬ সালে গৃহযুদ্ধের সমাপ্তির পরে শ্রীলঙ্কার মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ২০১২ সাল পর্যন্ত ঠিকঠাকই ছিল। সে সময় মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৪৩৬ ডলার থেকে বেড়ে হয় ৩ হাজার ৮১৯ ডলার, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ। দেশটি ২০১৯ সালে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশেও পরিণত হয়েছিল।
ঋণের বোঝা
শ্রীলঙ্কার ঋণের হার এখন জিডিপির ১১৯ শতাংশ। অর্থাৎ দেশটি সব মিলিয়ে এক বছরে যে পণ্য ও সেবা উৎপাদন করে, তার তুলনায় ঋণ বেশি। শ্রীলঙ্কার ঋণের ৩৬ দশমিক ৪ শতাংশ হচ্ছে আন্তর্জাতিক সার্বভৌম বন্ডে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কাছে ঋণ ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ, জাপানের কাছে ১০ দশমিক ৯ শতাংশ এবং চীনের কাছে ১০ দশমিক ৮ শতাংশ।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্য বলছে, ঋণের দায় পরিশোধ হিসেবে চলতি বছর শ্রীলঙ্কাকে সব মিলিয়ে ৫০০ কোটি ডলার পরিশোধ দেওয়া কথা। অথচ এখন শ্রীলঙ্কার হাতেই আছে মাত্র ২৩১ কোটি ডলারের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার মজুত। সুতরাং ঋণ পরিশোধ তো দূরের কথা, দৈনন্দিন কাজ চালাতেই নতুন করে আরও ঋণ নিতে হচ্ছে। অন্যদিকে বৈদেশিক বিনিয়োগও কমেছে গত দুই বছরে।
বলা হয়, চীনের ঋণের ফাঁদে বন্দি শ্রীলঙ্কা। এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মত থাকলেও বৃহৎ একাধিক অবকাঠামো প্রকল্পের জন্য চীন থেকে ঋণ নিয়েই বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
যেমন, গভীর সমুদ্রবন্দর হাম্বানটোটা নির্মাণের জন্য চীন থেকে ১৫ বছরের জন্য বাণিজ্যিক ভিত্তিতে, ৬ দশমিক ৩ শতাংশ সুদহারে ঋণ নিয়েছিল ৩০ কোটি ৭০ লাখ ডলার। কিন্তু এই সমুদ্রবন্দর থেকে আয় হয় সামান্য, যা ঋণ পরিশোধের জন্য যথেষ্ট ছিল না। ফলে পরিচালনার জন্য চীন থেকে নেওয়া হয় আরও ৭৫ কোটি ৭০ লাখ ডলার— ২ শতাংশ সুদ হারে। তাতেও কাজ হয়নি। পরে চীনের কাছেই বন্দরটি ৯৯ বছরের জন্য লিজ দেওয়া হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের ঋণের হার এখন জিডিপির ৩৮ শতাংশ। গত জুন পর্যন্ত হিসাবে বাংলাদেশের মোট দেনার পরিমাণ ছিল ১১ লাখ ৪৪ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা। এর প্রায় ৩৭ শতাংশ এসেছে বিদেশি উৎস থেকে, পরিমাণ ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা। বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের হার জিডিপির ১৩ শতাংশ।
সুতরাং আপাতত চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই বলেই মনে করা হলেও, বিভীষণ এখানে ঘরের মধ্যেই লুকিয়ে আছে। আর এই বিভীষণ বর্তমান সরকারের মেগা প্রকল্পগুলো। আইএমএফের হিসাবে এই হার আর ১৭ শতাংশ বেশি হলেই বিপদে পড়বে বাংলাদেশ। আর একবার বিপদে পড়লে, সেখান থেকে উত্তর যে চারদিক থেকে সমস্যা জর্জরিত এই দেশের জন্য একপ্রকার অসম্ভব তা কববেশি সবাই আন্দাজ করতে পারবে।
পাশাপাশি অর্থনৈতিক চাপ বাড়ছে বাংলাদেশের। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে দেশে কেবল বাণিজ্য ঘাটতিই হয়ে আছে ১ হাজার ৫৬২ কোটি ডলার। আবার আগের অর্থবছরেও যেখানে চলতি হিসাবের ভারসাম্য ছিল বাংলাদেশের অনুকূলে, এবার তা ঋণাত্মক। অন্যদিকে আগের অর্থবছরেও প্রথম সাত মাসে প্রবাসী আয়ে ছিল বড় প্রবৃদ্ধি, এবার সেটিও ঋণাত্মক।
বাংলাদেশেও এখন বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে ব্যয় অনেক বেশি। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। আমদানি ব্যয় আরও বাড়লে রিজার্ভেও টান পড়বে। এতে রিজার্ভের অর্থ অবকাঠামো প্রকল্পে খরচ করার সুযোগ কমে আসবে।
বড় প্রকল্পের ফাঁদ
শ্রীলঙ্কা বড় বড় প্রজেক্টে প্রচুর পরিমাণে বিদেশি ঋণ নিয়েছে যা শোধ করার মতো অর্থনৈতি ভিত্তি তাদের ছিল। ফলে মারাত্মক সমস্যায় পড়ে গেছে দেশটি। আমরাও বড় বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছি বৈদেশিক ঋণ ওপর।
আমাদের বড় প্রকল্পের সংখ্যা বাড়ছে, যার প্রায় সব কটিই অবকাঠামো প্রকল্প। এসব ঋণের মধ্যে সরবরাহ ঋণও (সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট) আছে। এর সুদহার বেশি, ঋণ সরবরাহকারীরাই প্রকল্প তৈরি করে দিচ্ছে। এ ধরনের ঋণে বাস্তবায়িত প্রকল্পের মান নিয়ে প্রশ্ন থাকে, অর্থ খরচের জবাবদিহি কম এবং সময়মতো প্রকল্পের কাজও শেষ হয় না।
উল্লেখ্য বর্তমানে ১০টি বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এর একটির কাজও সময়মতো শেষ হয়নি। সময় বেড়েছে, ব্যয়ও বেড়েছে। এতে এর অর্থনৈতিক মূল্যও কমে যাচ্ছে। ফলে সব কটি প্রকল্প থেকে বিনিয়োগ কতটা সময়ে ফেরত আসবে, সেটিও এখন বড় প্রশ্ন।
বড় প্রকল্পের কারণে এখন বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের দায় বাড়ছে আগের চেয়ে দ্রুতগতিতে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্র বলছে, ২০০৯-১০ অর্থবছরেও বাংলাদেশকে পরিশোধ করতে হয়েছিল ৮৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার। আর ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯১ কোটি ডলার। সূত্রগুলো জানাচ্ছে, রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বড় প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ হলেই এই ঋণ পরিশোধের দায় অনেক বেড়ে যাবে। ফলে চাপ তৈরি হবে।
প্রধান আয়ের উৎস
শ্রীলঙ্কার প্রধান উপার্জন হচ্ছে পর্যটন ও চা থেকে। কিন্তু সকালের চিন্তার বাইরে ঘটে গেল করোনা মহামারি যা পর্যটন শিল্পকে ধ্বংস করে দিয়েছে। সেই ধাক্কাই শ্রীলঙ্কা কাটিয়ে উঠতে পারেনি কোনোভাবে। আমাদের অর্থনীতি নির্ভর করছে বিদেশ থেকে পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর। এ প্রবাসীদের রেমিট্যান্স কদিন থাকবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই।
তাছাড়া তাদের পাঠানো অর্থ সঠিকভাবে এবং সাসটেনঅ্যাবল কোনো প্রকল্পে খাটানো হচ্ছে না। এই অর্থ কোনো কারণে যদি আসা কমে যায়, তখন অর্থনীতি কীভাবে সামাল দেওয়া হবে-তার কোনো ব্যবস্থা কিন্তু আমাদের নেই।
আমাদের আর একটি শক্তিশালী উৎস হচ্ছে জাতিসংঘ বাহিনীতে সামরিক বাহিনীর অংশগ্রহণ, এটিও স্থায়ী কোনো উপার্জন নয়। এসব অস্থায়ী উৎসগুলোর কোনোটিতে যদি হঠাৎ ভাটা পড়ে যায়, তাহলে আমাদের অর্থনীতের কি হবে, তা নিয়ে হয়তো ভাববার সময় এসে গেছে।
পরিবার শাসিত রাজনীতি
এশিয়ার রাজনীতিতে বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে পরিবারতন্ত্র একটি ট্রাডিশনে পরিণত হয়েছে। শ্রীলঙ্কায়ও এর ব্যতিক্রম নেই। পারিবারিক শাসনের প্রধান মুখ হলেন ৭৬ বছর বয়সি মাহিন্দা রাজাপাকসে। তিনি বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী। ২০০৪ সালেও তিনি এ পদে আসীন ছিলেন। এরপর ২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তিনি দেশের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিন বছর আগে তার ভাই বর্তমান প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া ফের তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন।
২০০৯ সালের মে মাসে তামিল বিদ্রোহীদের দমনের মধ্য দিয়ে কয়েক দশকের গৃহযুদ্ধ সমাপ্তির কৃতিত্ব দাবি করেন মাহিন্দা। মাহিন্দা রাষ্ট্রপতি থাকাকালে ৭২ বছর বয়সি গোটাবায়া রাজাপাকসে ছিল তার প্রধান অনুগত সেনা কর্মকর্তা। সে সময় সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশ বিভাগে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ক্রমান্বয়ে তিনি প্রভাবশালী প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্বে উঠে আসেন।
এ পরিবারের আরেক ভাই ৭০ বছর বয়সি বাসিল রাজাপাকসে একজন কৌশলবিদ হিসেবে মাহিন্দা সরকারের অর্থনীতি সামলেছেন এবং তিনি এখন অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। তাকে ‘মিষ্টার টেন পার্সেন্ট’ বলে অখ্যায়িত করা হয়, কারণ তিনি সরকারের চুক্তিগুলো থেকে ওই হারে কমিশন নেন। গোটাবায়া প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে সব মামলা প্রত্যাহার করা হয়।
৩৫ বছর বয়সি নামাল রাজাপাকসে মাহিন্দার বড় ছেলে। মাত্র ২৪ বছর বয়সে ২০১০ সালে তিনি আইনসভায় প্রবেশ করেন এবং বর্তমানে তিনি ক্রীড়ামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। তার বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এ চিত্রগুলোও যেন সব গরিব দেশের একই। দেশ আর দেশের মানুষের যাই হোক, শত শত নয়, হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করার ঐতিহ্য এসব গরিব দেশগুলোই লালন করে আসছে।
২০০৯ সাল থেকে টানা ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগও দুর্নীতি আর স্বৈরতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষক হয়ে উঠছে। এবার দেশের রাজনীতি বা গণতান্ত্রিক অবস্থা নিয়ে এখানে আলোচনা করবো না। তবে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ ১৩তম অবস্থানে এসেছে দেশ। ১০০–এর মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর ২৬, গতবারও একই ছিল৷ চার বছর ধরেই একই স্কোর রয়েছে৷ এমন কোন ক্ষেত্র নেই, যেখানে অনিয়ম আর দুর্নীতি নেই।
চলতি বছর প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে গত ১০ বছরে দেশের বাইরে পাচার হয়েছে সাড়ে ছয় লাখ কোটি টাকা৷ এই অর্থ বাংলাদেশের দু’টি বাজেটের সমান৷ স্বল্পোন্নত (এলডিসি) দেশগুলোর মধ্যে অর্থ পাচার সবচেয়ে বেশি হয়েছে বাংলাদেশ থেকেই৷
এসডব্লিউ/এসএস/২০৩৫
আপনার মতামত জানানঃ