সম্প্রতি ভারতের কর্ণাটকের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিজাব নিষিদ্ধের পর এক ছাত্রী প্রতিবাদ করলে তা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে টুপি, হিজাব পরার বিষয়টিও সামনে আসছে।
এদিকে নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার সেবারহাটের শের-ই-বাংলা উচ্চবিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ছাত্রীদের বোরকা নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদে মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল ও সড়ক অবরোধ করা হয়েছে। আজ সোমবার(২১ মার্চ) সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত বিদ্যালয়সংলগ্ন সেবারহাট বাজারে এ কর্মসূচি পালন করা হয়।
শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ কর্মসূচিতে ওই বিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মারধর করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এরপর শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হয়ে কয়েক দফা বিদ্যালয়ে হামলার চেষ্টা চালায়। খবর পেয়ে সেনবাগ থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
জানা গেছে, ৭ মার্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোজাম্মেল হোসেন বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্রীদের বোরকা পরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একটি বিজ্ঞপ্তি দেন। ওই বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, কোনো ছাত্রী বোরকা পরে বিদ্যালয়ে এলেও ক্যাম্পাসে ঢোকার পর বোরকা খুলে ফেলতে হবে। তবে পরদিন ৮ মার্চ প্রধান শিক্ষক ওই নোটিশ স্থগিত ঘোষণা করেন।
সূত্র জানায়, ওই বিজ্ঞপ্তির প্রতিবাদে আজ সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা বিদ্যালয়সংলগ্ন ফেনী-নোয়াখালী জাতীয় মহাসড়কের পাশে মানববন্ধন করেন। মানববন্ধনের সময় বিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক হারাধন চন্দ্র দাশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে মারধর করে তাদের কাছ থেকে ব্যানার ছিনিয়ে নেন। এতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা ক্ষুব্ধ হয়ে বিক্ষোভ মিছিল করে বিদ্যালয়ে হামলার চেষ্টা চালান। এ সময় তারা প্রায় আধা ঘণ্টা ফেনী-নোয়াখালী মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন।
খবর পেয়ে সেনবাগ থানা–পুলিশ ও বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক ফরিদ উদ্দিন ভূঁইয়া ঘটনাস্থলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করেন।
জানতে চাইলে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নাজিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, প্রধান শিক্ষককে তিনি তার কার্যালয়ে ডেকেছেন এবং ওই বিজ্ঞপ্তি নিয়ে আসতে বলেছেন। প্রধান শিক্ষকের বক্তব্য শোনার পর এ বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আপাতত শিক্ষার্থীরা শান্ত আছে।
বিপরীত চিত্র যেখানে
এদিকে যশোরের আদ্-দ্বীন সকিনা মেডিকেল কলেজে সব ধর্মের শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলকভাবে ‘হিজাব’ পরতে হয়। ভর্তির সময়ই নারী শিক্ষার্থীদের এ বিষয়ে লিখিত সম্মতি দিতে হয়। এই মেডিকেল কলেজের মতো দেশের বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মেয়েদের হিজাব, ছেলেদের টুপি পরা বাধ্যতামূলক।
আদ্-দ্বীন ফাউন্ডেশন পরিচালিত যশোরের পুলের হাটের আদ-দ্বীন সখিনা মেডিকেল কলেজের কয়েকজন নারী শিক্ষার্থী জানান, মুসলিম-অমুসলিক সবাইকে মাথায় হিজাব পরেই ক্লাসে যেতে হয়।
তাদের ভাষ্য, ‘ড্রেস কোড’ মেনে চলতে ভর্তির সময় স্বাক্ষর করে নেওয়া হয়েছিল। এ কারণে যারা হিজাব পরতে চান না, তাদের তা এড়ানোর সুযোগ থাকে না।
প্রতিষ্ঠানটির নোটিস বোর্ডে সচিত্র পোশাকবিধি রয়েছে, তাতে কালো মোজাকেও ড্রেস কোডের অংশ করা হয়েছে। সেখানে ‘ড্রেস কোড’ উল্লেখ করে পঞ্চম বর্ষ পর্যন্ত ছাত্রীদের বিভিন্ন রঙের পোশাক পরা ছবি দেওয়া আছে, যা মেনে চলতে বলা হয়েছে। প্রতিটি ছবিতে ভিন্ন ভিন্ন রঙের সালোয়ার-কামিজের সঙ্গে মিলিয়ে মাথায় কাপড় পরা রয়েছে, যা দেখতে হিজাবের মতো।
তবে অধ্যক্ষ কামাল উদ্দিন আহমেদের দাবি, এটি হিজাব নয়, ওড়না।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘ড্রেস কোডে আছে সালোয়ার, কামিজ ও ওড়না ব্যবহার করতে হবে; সেগুলো প্রতি বর্ষে ভিন্ন ভিন্ন রঙের হবে। যাতে সহজে বোঝা যায় কোন ছাত্রী কোন বর্ষের।
আদ্-দ্বীন ফাউন্ডেশন পরিচালিত যশোরের পুলের হাটের আদ-দ্বীন সখিনা মেডিকেল কলেজের কয়েকজন নারী শিক্ষার্থী জানান, মুসলিম-অমুসলিক সবাইকে মাথায় হিজাব পরেই ক্লাসে যেতে হয়।
এই মেডিকেল কলেজের ৩৩০ জন শিক্ষার্থীর ৫৮ জন মুসলিম নন। বিদেশি শিক্ষার্থী ৮৭ জন, যাদের অধিকাংশই ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের। কয়েকজন রয়েছেন নেপালের।
আদ-দ্বীন ফাউন্ডেশনের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও হিজাব পরার বাধ্যবাধকতা আছে।
একই চিত্র ঢাকার কল্যাণপুরের ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজে, যে প্রতিষ্ঠানেও হিজাব পরে ঢুকতে হয় ছাত্রীদের।
জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ অধ্যাপক মহিবুল আজিজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘আমি তো দেখি অনেকেই পরে। আমি এক্স্যাক্টলি খেয়াল করি নাই। মেয়েরা নিজেরাই পরে’।
রাজধানীর ফয়জুর রহমান আইডিয়াল ইনস্টিটিউটে ছাত্রদের টুপি ও ছাত্রীদের হিজাব পরতে হয়। প্রতিষ্ঠানটির বনশ্রী শাখার একজন ছাত্রী জানান, টুপি ও হিজাব ছাড়া ক্লাসে ঢুকতে দেওয়া হয় না।
আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের মতিঝিল, মুগদা ও বনশ্রী শাখায় ছাত্রদের টুপি ও ছাত্রীদের ওড়নায় মাথা ঢেকে ক্লাসে যেতে হয়।
ঢাকার মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, টুপি বা ওড়না ছাড়া ক্লাসে গেলে শিক্ষকদের ‘বকাঝকা শুনতে হয়’।
আদালত কী বলে?
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে কোনো ব্যক্তিকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধর্মীয় পোশাক পরতে বাধ্য করা যাবে না বলে উচ্চ আদালতের রায় আছে। এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়েরও নির্দেশনা রয়েছে। তবে বাস্তবে এর কার্যকর প্রতিফলন দেখা যায়নি।
২০১০ সালে নাটোরের রানী ভবানী মহিলা কলেজে বোরকা পড়া বাধ্যতামূলক করার প্রতিবেদন গণমাধ্যমে আসার পর বিষয়টি উচ্চ আদালতে যায়।
ওই বছরের অক্টোবরে বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দীন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনের বেঞ্চ রায়ে জানায়, সেকুলার রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশে সবার ধর্মীয় স্বাধীনতা আছে। সে কারণে কাউকে ধর্মীয় পোশাকের ক্ষেত্রে জোর করা যাবে না।
রায়ে বোরকা, টুপি, ধুতির মতো ধর্মীয় পোশাককে বাধ্যতামূলক না করতে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশনা দিতে বলা হয়েছিল।
এর আগেই ২০১০ সালের ২৫ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক পরিপত্রে বলা হয়, সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় পোশাক পরতে বাধ্য করা যাবে না। বোরকা না পরার কারণে কোনো ছাত্রীকে নির্যাতন, হয়রানি করা ও শাস্তি দেওয়া যাবে না।
বোরকা বা ধর্মীয় পোশাক পরতে বাধ্য করা এবং ছাত্রীদের খেলাধুলা ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক কাজকর্মে বাধা দেওয়াকে অসদাচরণ হিসেবে গণ্য করা হবে বলেও জানানো হয়।
পরিপত্রে বলা হয়, নির্দেশনা ভঙ্গের অভিযোগ পাওয়া গেলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা অধিদপ্তর ও শিক্ষাবোর্ড তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে।
বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য
টুপি, হিজাবের মতো পোশাককে কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘ড্রেস কোডে’ আনলেও এর সঙ্গে ধর্মের যোগসূত্র রয়েছে বলে জানাচ্ছেন গবেষক-বিশ্লেষকরা।
তারা বলেন, ধর্ম পোশাকের ব্যাপারে একটা ‘আইডিনটিটি’ তৈরি করেছে। পর্দার ভিত্তিতেই মানুষ হিজাবের মতো পোশাক পরছে। সংস্কৃতির পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই এ পোশাকগুলো এসে গেছে।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেই এ ধরনের ‘ইউনিফর্ম’ করা হয় মন্তব্য করে তারা বলেন, ‘কোন কোন স্কুলে বলে দেওয়া হচ্ছে হিজাব বা টুপি ছাড়া সেই স্কুলের শিক্ষার্থী হতে পারবে না। অন্য ধর্মাবলম্বী মেয়েদেরও মাথায় কাপড় দিয়ে আসতে হচ্ছে, কেননা সেটা ইউনিফর্ম করে দেওয়া হয়েছে’।
আরও বলেন, ‘টুপি বা হিজাব মানেই আমরা বুঝে নিই সে মুসলিম। এটা ধর্মকে উপস্থাপন করে, সাথে সাথে সংস্কৃতিকেও’।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষগুলো ‘ক্ষমতা’ ব্যবহার করে ধর্মীয় পোশাক পরাতে বাধ্য করছে বলে মন্তব্য করেন তারা।
তারা মনে করেন, ইউনিফর্ম এমন হওয়া উচিত, যাতে ধর্মসহ অন্যান্য বিভেদ কাটিয়ে সবাইকে একই রকম মনে হয়। ব্যক্তিগত জীবনে প্রত্যেকের পোশাক, ধর্মাচরণ, রাজনৈতিক বিশ্বাসে নিজ নিজ ধরন থাকবে। কিন্তু যখন দলের কাজে আসবে, তখন সকলে একই ধরনের হলে সেখানে সমতা থাকে। ভিন্নতাগুলো কমে’।
তারা মনে করেন, ধর্মীয় পোশাক পরতে বাধ্য করা আদালতের রায়ের সাথে সাংঘর্ষিক হচ্ছে। সেক্ষেত্রে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা ভুক্তভোগীরা আদালত অবমাননার মামলা করতে পারেন।
‘যেহেতু আদালতের আদেশ রয়েছে, সেটা মানতে সবাই বাধ্য। সুতরাং যারা এটা ভঙ্গ করছে, তাদের সবাইকে জেলখানায় ঢোকানো উচিৎ। কেননা তারা তো শাস্তিযোগ্য অপরাধ করছে’।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০৪০
আপনার মতামত জানানঃ