আরব বসন্তের ঢেউ তিউনিসিয়া থেকে সিরিয়ায় পৌঁছাতে বেশি সময় লাগেনি। গণতন্ত্রের দাবিতে শুরুতে সিরিয়ায় ছোটখাটো বিক্ষোভ হয়। দ্রুতই এই বিক্ষোভ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভ দমনে নৃশংস পথ বেছে নেন দেশটির প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদ। এতে এক দীর্ঘমেয়াদি গৃহযুদ্ধের চক্করে পড়ে যায় সিরিয়া।
বুলেটের মুহুর্মুহু গুলি, বাবা-মা হারানো শিশুদের চিৎকার আর বাস্তুচ্যুত মানুষের ছোটাছুটি- এ যেন সিরিয়ার নিত্যদিনের চিত্র। দেশটিতে ২০১১ সালের মার্চে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর কেবলই বেড়েছে লাশের সারি। দেখা দিয়েছে ইতিহাসের ভয়াবহতম মানবিক সংকটের।
একসময়ের সমৃদ্ধ দেশটি এখন রীতিমতো ধ্বংসস্তূপ, যুদ্ধের ভারে শ্রান্ত। ২০১১ সালের মধ্য মার্চে দেশটিতে যে সংকটের সূচনা, তার আজও সমাধান হয়নি। এর মধ্যে পেরিয়ে গেছে ১১ বছর। দেশটিতে শান্তি ফেরেনি। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা ও যুদ্ধ নিয়ে যখন বিশ্ববাসী সরব, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ভুগছে; তখন ১৫ মার্চ অনেকটা নীরবে কেটে গেল সিরিয়া যুদ্ধের বছরপূর্তি।
২০১১ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত এক দশকে যুদ্ধকবলিত সিরিয়ায় সামরিক-বেসামরিক মিলিয়ে নারী, শিশুসহ ৩ লাখ ৫০ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণ গেছে। এ হিসাব জাতিসংঘের। তবে সংস্থাটি বলছে, প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার পর্যবেক্ষক সংস্থা সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটসের হিসাবে, ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত সিরিয়া যুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ৪ লাখ ৯৪ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। অন্যদিকে অধিকার সংগঠন ভায়োলেশনস ডকুমেন্টেশন সেন্টার বলছে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সিরিয়ায় নিহতের এ সংখ্যা ২ লাখ ৩৮ হাজার। এর মধ্যে ১ লাখ ৪৪ হাজারের বেশি বেসামরিক মানুষ।
বাশার আল-আসাদ সরকারকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া ও ইরান। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ পশ্চিমা দেশগুলো বাশার আল-আসাদবিরোধী। তাদের সঙ্গে রয়েছে তুরস্ক, সৌদি আরবসহ আরব দেশগুলোর অনেকেই।
২০১৫ সালে বাশার আল-আসাদ সরকারের সমর্থনে বিমান হামলার মধ্য দিয়ে সিরিয়া যুদ্ধে প্রকাশ্যে জড়িয়ে পড়ে রাশিয়া। মস্কোর দাবি, তারা সিরিয়ায় শুধু ‘সন্ত্রাসীদের’ স্থাপনায় হামলা চালায়। তবে পশ্চিমারা বলে থাকে, রুশ হামলায় সশস্ত্র বিদ্রোহী ও বেসামরিক মানুষজনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
বাশার আল-আসাদকে অস্ত্র, অর্থ, যোদ্ধা দিয়ে সহায়তা করছে ইরান। তেহরানের অর্থায়নে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ পাওয়া হাজারো শিয়া মিলিশিয়া সিরিয়াজুড়ে লড়াই করছে। তাদের বেশির ভাগ লেবাননের হিজবুল্লাহর সঙ্গে সম্পৃক্ত। ইরাক, আফগানিস্তান, ইয়েমেনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে অনেকেই সিরিয়ায় গিয়ে বাশার আল-আসাদের হয়ে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে।
অন্যদিকে বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না পশ্চিমারা। তাই তারা আসাদবিরোধী সশস্ত্র মিলিশিয়াদের অস্ত্র ও অর্থ জোগান দিয়েছে, দিচ্ছে। কুর্দি ও বাশার আল-আসাদবিরোধী সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সের (এসডিএফ) সহায়তার জন্য ২০১৪ সাল থেকেই দেশটিতে বিমান হামলা অব্যাহত রেখেছে পশ্চিমারা। তুরস্ক পশ্চিমা জোটের সঙ্গে থাকলেও কুর্দিদের ক্রম উত্থানে ভীত। কেননা, দেশটির সীমান্ত এলাকায় অনেক কুর্দির আবাস। ইরানের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইসরায়েল ও সৌদি আরবও সংগত কারণে পশ্চিমা জোটের সঙ্গে রয়েছে। দেশটিতে নিয়মিত হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলও।
যুদ্ধ শুরুর আগে সিরিয়ার জনসংখ্যা ছিল ২ কোটি ২০ লাখ। তাদের অর্ধেকের বেশি যুদ্ধের কারণে উদ্বাস্তু হয়েছে। প্রায় ৭০ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে প্রাণ বাঁচাতে সিরিয়ার এক শহর থেকে অন্যত্র চলে গেছেন। প্রায় ২০ লাখ অসহায় মানুষ বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে জায়গা জুটিয়েছে। ন্যূনতম মৌলিক সেবা ছাড়া সেসব শিবিরে তাদের মানবেতর জীবন কাটছে। আরও প্রায় ৬৮ লাখ সিরিয়াবাসী প্রতিবেশী লেবানন, জর্ডান, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশে পালিয়ে গেছে। অনেকে শরণার্থী হিসেবে ইউরোপে আশ্রয় নিয়েছে। সিরীয়দের দেশ ছাড়ার এসব ঘটনাকে সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকট বলে মত বিশ্লেষকদের।
জাতিসংঘ বলছে, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিরিয়ায় ১ কোটি ৪৬ লাখের বেশি মানুষের মানবিক সহায়তা প্রয়োজন ছিল। তাদের মধ্যে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ চরম সংকটে ভুগছে। দেশটিতে প্রতিদিন ১ কোটি ২০ লাখের বেশি মানুষ পর্যাপ্ত খাবার পায় না। প্রায় ৫ লাখ সিরীয় শিশু ভয়াবহ অপুষ্টিতে ভুগছে।
বুলেটের মুহুর্মুহু গুলি, বাবা-মা হারানো শিশুদের চিৎকার আর বাস্তুচ্যুত মানুষের ছোটাছুটি- এ যেন সিরিয়ার নিত্যদিনের চিত্র। দেশটিতে ২০১১ সালের মার্চে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর কেবলই বেড়েছে লাশের সারি। দেখা দিয়েছে ইতিহাসের ভয়াবহতম মানবিক সংকটের।
মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে করোনা মহামারি। এ ছাড়া বাশার আল-আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা। সিরীয় শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া লেবানন চরম অর্থনৈতিক সংকটে ভুগছে। ২০২১ সালে সিরিয়ার মুদ্রার বিনিময় হারে ৮০ শতাংশ পতন দেখা গেছে। চলতি বছরের শুরুতে তা ১৪০ শতাংশে পৌঁছে গেছে। এসব কারণে যুদ্ধকবলিত সিরিয়া মানবিক সংকট সামাল দিতে পারছে না। করোনা মোকাবিলায় সিরিয়ায় মাত্র ৭ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষকে টিকার পূর্ণাঙ্গ ডোজের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে।
২০১১ সালের মার্চে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ শুরু হয় দক্ষিণের শহর ডেরায়। তবে বিক্ষোভ শুরুর অনেক আগে থেকেই দেশটিতে কর্মসংস্থানের অভাব আর দুর্নীতির মত নানা কারণে অস্থিরতা বিরাজ করছিল। স্বতস্ফূর্ত এই বিক্ষোভকে বিদেশি মদদপুষ্ট সন্ত্রাসবাদ আখ্যা দেন প্রেসিডেন্ট আসাদ।
বিক্ষোভকারীদের ওপর চড়াও হয় সরকারি বাহিনী। প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের দাবি ওঠে দেশজুড়ে। সরকারের অভিযানও জোরদার হলে বিদ্রোহীরা শুরুতে নিজেদের জীবন রক্ষার্থে অস্ত্রধারণ করে। পরে তারা একত্রিত হয়ে নিজ এলাকার সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। সহিংসতা ছড়িয়ে পড়লে গৃহযুদ্ধ শুরু হয় দেশটিতে।
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ ভয়ংকর জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) উত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তারা ইরাক ও সিরিয়ার একটা বড় অংশ দখল করে ২০১৪ সালের জুনে কথিত ‘খেলাফত’ ঘোষণা করে। আইএসের কথিত এই খেলাফতের রাজধানী করা হয় সিরিয়ার রাক্কা। আইএস বর্বরতা-নৃশংসতা দিয়ে আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদের কেন্দ্রে চলে আসে। সারা বিশ্বে তারা ত্রাস সৃষ্টি করে। পরে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়ার পাশাপাশি সিরিয়ার সরকারি বাহিনী, নানান বিদ্রোহী গোষ্ঠীর অভিযানে ২০১৭ সালে আইএসের কথিত খেলাফতের পতন হয়।
দীর্ঘ এই যুদ্ধের কারণে মানুষ সিরিয়া ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর হিসাবে আনুমানিক ১০ মিলিয়ন মানুষ সিরিয়া ছেড়ে গেছে। লেবানন, জার্মানি, ইরান ও তুরস্ক সিরিয়ার শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়। তাদের অনেকে ইউরোপে পাড়ি জমাচ্ছে আরও ভালো সুবিধা পাওয়ার জন্য।
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকটেরও জন্ম দিয়েছে। কারণ, সিরিয়ায় বাস্তুচ্যুতদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক মানুষ সে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে বলে দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়। সিরীয় শরণার্থীরা তুরস্ক, লেবানন, জর্ডানসহ প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে।
যুদ্ধে সিরিয়ার শহর-নগর-জনপদ বিধ্বস্ত। যেসব বেসামরিক মানুষ এখনো সিরিয়ায় আছে, তাদের জীবন নানাভাবে বিপন্ন-বিপদগ্রস্ত-ঝুঁকিপূর্ণ। জাতিসংঘের তথ্যমতে, সিরিয়ায় এখন যারা অবস্থান করছে, তাদের মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় আছে।
গৃহযুদ্ধ দেশটির জীবনব্যবস্থা, কর্মসংস্থান, অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এএফপি বলছে, সিরিয়ার পাউন্ড এক দশকে ৯৮ শতাংশ পর্যন্ত মূল্য হারিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক মানবিক সহায়তা সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশন ইন্টারন্যাশনালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সিরিয়া যুদ্ধের আর্থিক ক্ষতি ১ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি। এই যুদ্ধ যদি এখনই শেষ হয়, তাহলেও ২০৩৫ সাল নাগাদ তার ক্ষতির মূল্য আরও ১ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার হবে।
যুদ্ধের কারণে সিরিয়ার শিশুদের স্বাস্থ্য-শিক্ষা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই দুটি বিষয় যুক্ত করলে সিরীয় যুদ্ধের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে। শুধু, তা-ই নয়, যুদ্ধের কারণে সিরিয়ার শিশুদের আয়ুষ্কাল ১৩ বছর কমেছে।
সিরিয়ায় ১১ বছরের গৃহযুদ্ধে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তা বিবেচনায় নিয়ে তাকে মানবতার জন্য এক লজ্জার দশক হিসেবে অভিহিত করেছেন নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিলের (এনআরসি) মহাসচিব জ্যান এজল্যান্ড।
বর্তমান বিশ্বে শরণার্থী সমস্যার সবচেয়ে দুঃখজনক চিত্র সিরিয়ায়। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের ফলে এই শরণার্থীদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। উন্নত দেশগুলো যে অর্থ ও ত্রাণ সহায়তা করছে তা খুব সামান্য। যে কারণে সিরিয়ান শরণার্থীদের দুর্দশা চরমে পৌঁছেছে। আন্তর্জাতিকভাবেও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করেছে সিরিয়ান শরণার্থীরা।
সিরিয়ার শরণার্থীদের শিশু ও নারীরা পড়েছে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। ইউরোপের কয়েকটি দেশ সিরিয়া শরণার্থীদের জন্য মানবতার হাত বাড়িয়ে দিলেও আর্থিকভাবে সচ্ছল, উন্নত ও সামরিক শক্তিধর দেশগুলো সিরিয়া শরণার্থীদের ব্যাপারে নিয়েছে কৌশলী ভূমিকা। তাদের আশ্রয় দিতে চাচ্ছে না সব সময় মানবতার বুলি আওড়ানো বেশির ভাগ দেশের রাষ্ট্রনেতারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৪৫
আপনার মতামত জানানঃ