বর্তমানে ইউরোপীয় দেশগুলো অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি অন্য আর এক সংকটের মুখে আছে, সেটা হচ্ছে মানবিক মূল্যবোধের সংকট এবং এই সংকটের প্রকাশ দেখা যাচ্ছে মুসলিমদের প্রতি তাদের অসহিষ্ণু আচরণে। অ্যামনেস্টিসহ অন্যান্য মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পর্যবেক্ষণেও দেখা যাচ্ছে যে ইউরোপের মুসলিমদের বিরুদ্ধে বৈষম্য দিনে দিনে বাড়ছে। এবার ইউক্রেন যুদ্ধে এই বিদ্বেষ হয়ে উঠল আরও স্পষ্ট।
হাজার হাজার হতাহত, প্রত্যাখ্যাত বা আটকা পড়া শরণার্থীর বদৌলতে ইউক্রেনে চলমান রাশিয়ান আগ্রাসন পশ্চিমা গণমাধ্যম ও নীতিনির্ধারকদের আরববিরোধী এবং মুসলিমবিরোধী মনোভাবকে আবারও প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পক্ষপাত বের হয়ে আসাটা অবশ্য অবাক হওয়ার মতো কিছু না।
শরণার্থীদের সম্পদ নিয়ে ডেনমার্ক
সম্প্রতি দ্বিমুখিতার সবচেয়ে বড় উদাহরণটি দেখা গেছে ডেনমার্কে। দেশটির পার্লামেন্টে একজন রাজনীতিবিদ সুপারিশ করেছেন, যে আইন কর্তৃপক্ষকে সিরিয়া এবং ইরানের শরণার্থীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার অনুমতি দেয় সেই আইন থেকে যেন ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের অব্যাহতি দেওয়া হয়।
ডেনমার্ক সরকারের অভিবাসন মুখপাত্র রাসমুস স্টকলুন্ড গত সপ্তাহে এক সংবাদপত্রকে বলেন, আরোপিত গহনা আইনটি সংঘাত থেকে পালিয়ে আসা ইউক্রেনীয়দের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা উচিত না। কারণ তারা ‘আশেপাশের অঞ্চল’ থেকে এসেছে।
বিতর্কিত এই আইনের মাধ্যমে আগত শরণার্থীদের মাত্র ১০ হাজার ডেনিশ ক্রোন (১,৪৬৮ ডলার) পরিমাণ সম্পদ রাখার অনুমতি দেওয়া হয়। সম্পদের পরিমাণ এরচেয়ে বাড়লে বাড়তি অংশ বাজেয়াপ্ত করতে পারবে রাষ্ট্র।
যুদ্ধ ও আগ্রাসন ছেড়ে পালিয়ে আসা ইউক্রেনীয়দের ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের মনোভাব ও আচরণ কতটা আলাদা, তা এই এক উদাহরণ দিয়েই বোঝানো যায়। সিরিয়া এবং অন্যান্য দেশের শরণার্থীরাও প্রায় একইরকম সংকটের কারণে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ইউরোপ ও মধ্য এশিয়া বিভাগের সহযোগী পরিচালক জুডিথ সান্ডারল্যান্ড বলেন, “২০১৬ সালের এই আইনটি মূলত প্রতীকী। এর উদ্দেশ্য ছিল, ডেনমার্কে আশ্রয়প্রার্থীদের একটি অপ্রীতিকর, প্রতিকূল বার্তা পাঠানো।
যদিও এখন বিপরীত বার্তা পাঠাতে চাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের স্বাগত জানাতে চায় তারা।
জুডিথ সান্ডারল্যান্ড বলেন, ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের ছাড় দেওয়াটা স্পষ্টতই বৈষম্যমূলক। তাদের মূল্যবান জিনিসপত্র যদি রাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তর করতে না হয়, তাহলে অন্য শরণার্থীদেরটা কেন হবে?
প্রস্তাবিত পরিবর্তন “ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের প্রতি এবং সিরীয়, আফগান, ইরাকি, ইরিত্রিয়ানদের প্রতি ইইউর প্রতিক্রিয়া কতটা বিপরীত তা খুব ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলেছে।
তিনি বলেন, ইউক্রেনীয়দের যেমন সহানুভূতি দেখানো হচ্ছে, তা গায়ের রঙ, ধর্ম, জাতীয়তা নির্বিশেষে সব শরণার্থীদের জন্যই দেখানো উচিত।
আরব-ব্রিটিশ আন্ডারস্ট্যান্ডিং কাউন্সিলের পরিচালক ক্রিস ডয়েলও একইরকম উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তার মতে, ডেনমার্কের আইনটি গোড়াতেই ভুল ছিল। কারো ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করা উচিত না এমন আইন।
সিরীয় উদ্বাস্তুদের প্রতি পোল্যান্ডের অনীহা
যুদ্ধপূর্ব ৪ কোটি জনসংখ্যার দেশ ইউক্রেন থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত ২০ লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। রুশ আগ্রাসনের ফলে বাস্তুচ্যুত হওয়া জনসংখ্যার বেশিরভাগই ইইউতে প্রবেশ করেছে।
সংকটের মাঝে ইউক্রেনের প্রতিবেশী দেশ পোল্যান্ড সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। দুই সপ্তাহের মধ্যে ১০ লাখেরও বেশি শরণার্থী গ্রহণ করেছে তারা।
জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুসারে, সোমবার পর্যন্ত হাঙ্গেরি, চেক প্রজাতন্ত্র এবং স্লোভাকিয়া যথাক্রমে ১ লাখ ৮০ হাজার, ১ লাখ ও ১ লাখ ২৩ হাজার শরণার্থী গ্রহণ করেছে।
পোল্যান্ডের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মারিউস কামিনস্কি গত সপ্তাহে বলেছেন, “যাদের প্রয়োজন তাদেরকে পোল্যান্ডে নিরাপদ আশ্রয় দেওয়ার জন্য আমরা সবকিছু করব।”
সিরিয়া যুদ্ধের সময় পোল্যান্ডের পাশাপাশি হাঙ্গেরি এবং চেক রিপাবলিকও সিরীয় উদ্বাস্তুদের গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল।
শরণার্থী গ্রহণে ইইউ-এর নীতি অনুসরণ না করে সিরীয়দের আশ্রয় দিতে সরাসরি অস্বীকৃতি জানানোর জন্য এই দেশগুলোকে ইউরোপীয় বিচার আদালত থেকে তিরস্কারও জানানো হয়েছিল।
ডয়েল বলেন, “একটি যুক্তি হচ্ছে, ভৌগলিক নৈকট্যের জন্য একটি দেশ বেশি সংখ্যক শরণার্থী নিতে পারে। সেটা হতে পারে, কিন্তু তার জন্য জাতি ও অন্যান্য বিষয়াদির উপর ভিত্তি করে বৈষম্যমূলক নীতি তৈরি করাটা মোটেও গ্রহণযোগ্য না।
“পুরো বিশ্ব দেখছে। এখন সবাই দেখছে, উন্নয়নশীল বিশ্বের সংঘাত এবং ইউক্রেন সংকটের ক্ষেত্রে একেবারেই ভিন্ন মানদণ্ড প্রয়োগ করা হচ্ছে।”
সরাসরি বর্ণবাদমূলক মন্তব্য
ডেনিশ আইনে প্রস্তাবিত পরিবর্তনের খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। টুইটার ও অন্যান্য মাধ্যমে প্রকাশিত অনেক ভিডিওতে যুদ্ধের কভারেজের ক্ষেত্রে পশ্চিমা সাংবাদিকদের নৈমিত্তিক বর্ণবাদের দৃষ্টান্ত উঠে আসছে।
উদাহরণস্বরূপ, এই আগ্রাসনের শুরুর দিকে কিয়েভ থেকে লাইভ চলাকালে সিবিএস নিউজের সিনিয়র বিদেশী সংবাদদাতা শার্লি ডি’অগাতা বলেন, “রাশিয়ানদের অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে হিসাব-নিকাশ পুরোপুরি বদলে যাচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ শহর ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করছে।
“কিন্তু সম্মান রেখেই বলছি, এটা কিন্তু ইরাক বা আফগানিস্তানের মতো কোনো দেশ না যেখানে কয়েক দশক ধরে সংঘাত চলছে। ইউক্রেন অপেক্ষাকৃত সভ্য, তুলনামূলকভাবে ইউরোপীয় একটি অঞ্চল। আমি বেশ ভেবেচিন্তেই শব্দগুলো বলছি। এটা এমন একটি অঞ্চল যেখানে এসব ঘটতে পারে বলে আপনি আশা করেন না।”
এই ‘অপেক্ষাকৃত সভ্য, তুলনামূলকভাবে ইউরোপীয়’ মন্তব্যের জন্য পরবর্তীতে ব্যাপক নিন্দিত হয়েছেন এই সাংবাদিক। আরব সাংবাদিকরা তার বিরুদ্ধে বর্ণবাদের অভিযোগও এনেছেন।
আরেক জায়গায়, বিবিসিতে আমন্ত্রিত একজন অতিথি বলেন, ‘ইউক্রেনের যুদ্ধ আমাকে বেশ আবেগাক্রান্ত করে তুলছে। কারণ সোনালী চুল, নীল চোখের ইউরোপীয়দের মারা যেতে দেখছি আমি।’
কিন্তু ডয়েলের মতে, এই ধরনের মিডিয়া ডিসকোর্স আরববিরোধী বা মধ্যপ্রাচ্যবিরোধী পক্ষপাত ঘটাচ্ছে না। বরং, এটি অন্তর্নিহিত বর্ণবাদেরই প্রতিফলন।
“আমি মনে করি, এখানে জনমতের পরিবর্তন দেখতে পাই আমরা। আগে আমরা দেখেছি, অভিবাসীদের ব্যাপারে সবাই বেশ ডানপন্থী। কেউ শরণার্থীদের জায়গা দিতে চায় না।
“এখন আমরা বুঝতে পারছি, অ-ইউরোপীয়, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ থেকে আসা শরণার্থীদের ক্ষেত্রেই কেবল তারা অভিবাসনবিরোধী। ইউক্রেনের মতো ইউরোপীয় দেশ থেকে আসা শরণার্থীদের বেলায় তাদের কোনো বিরোধ নেই।
এসডব্লিউ/এসএস/১২২০
আপনার মতামত জানানঃ