মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের বাস্তুচ্যুত হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল দেশটির সেনাবাহিনীর ওপর হামলা। ওই হামলার সঙ্গে জড়িত ছিল আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)। এখন তারা বাংলাদেশেও আধিপত্য বিস্তার করছে। এছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে মাদক বিক্রি, মানবপাচার, অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায়, ডাকাতি ও মাদকের টাকায় আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহের কাজ করছে ‘আল-ইয়াকিন’।
এই বাহিনী বাংলাদেশিদের অপহরণ করে নির্জন পাহাড়ে নিয়ে যায়। এরপর হাত-পা ও চোখ বেঁধে চলে নির্মম নির্যাতন। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দাবিকৃত টাকা পেলে ছেড়ে দেওয়া হয়, না হলে পাহাড়ে গর্ত করে পুঁতে ফেলে। কক্সবাজারে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) নামেও এরা পরিচিত। কক্সবাজারবাসী এদের ‘জঙ্গি বাহিনী’ বলেও আখ্যা দিয়েছেন।
রোহিঙ্গাদের দুর্গতি পুঁজি করে ক্যাম্পগুলোতে শক্ত ঘাঁটি বানিয়েছে জঙ্গিরা। ৩৪ টি ক্যাম্পের সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে লুকিয়ে আছে ১৪টি সশস্ত্র জঙ্গি গোষ্ঠীর প্রায় ৫ হাজার সক্রিয় ক্যাডার।
রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে বাড়ছে অস্ত্রের ঝনঝনানি। সেই সঙ্গে বাড়ছে আতঙ্ক। আরসার সশস্ত্র গ্রুপে এবার যোগ দিয়েছেন বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা নারী। নেপথ্যে এসব নারীদের মদদ দিচ্ছে আরসা বা আল ইয়াকিনের সশস্ত্র গ্রুপ। আরসা সন্ত্রাসীরা রোহিঙ্গা নারীদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছে। অস্ত্র চালনায় তাদের প্রশিক্ষিতও করছে।
ঐ নারীরাই এখন ইয়াবা, মাদক-মানবপাচার, স্বর্ণ চোরাচালান, চাঁদাবাজি, অপহরণের পর মুক্তিপণ বাণিজ্য, রোহিঙ্গা কল্যাণ ফান্ডের নামে মাসিক চাঁদা আদায়, সালিশ বাণিজ্য, বিয়ে-সাদিসহ নানা অনুষ্ঠান থেকে নিদিষ্ট হারে চাঁদা আদায় করছে। অনুসন্ধান ও সাধারণ রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
আরো জানা গেছে, বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত সশস্ত্র রোহিঙ্গারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের (নারী ও পুরুষ) অস্তিত্ব জাহির করতে ছবি দিয়ে প্রচারণাও চালাচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন রোহিঙ্গা জাতীয় দৈনিক ডেইলি বাংলাদেশকে জানান, ক্যাম্প-১৫, ব্লক-জি-২ এর মৌলভী নুরুল আলমের ছেলে মো. নোমান, বান্দরবানের মিয়ানমার সীমান্তের কাঁটা তার লাগোয়া ঘুমধুমের জিরো পয়েন্টের দিল মোহাম্মদ ও মৌলভী আরফাত আহমদ সোর্স হিসেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে তথ্য দিয়ে সম্পর্ক জিইয়ে রেখেছে। তারা জিরো পয়েন্ট কেন্দ্রিক ইয়াবা, মাদক, স্বর্ণ চোরাচালানেরও অন্যতম হোতা। তাদের নিয়ন্ত্রণে জিরো পয়েন্টের সব অপকর্ম চলছে।
বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত সশস্ত্র রোহিঙ্গারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের (নারী ও পুরুষ) অস্তিত্ব জাহির করতে ছবি দিয়ে প্রচারণাও চালাচ্ছে।
ক্যাম্প-৩ ব্লক-এ, এ/৩১, শেড এর মাঝি মো. ছিদ্দিক, হেড মাঝি নুর মোহাম্মদের ব্লকের আব্দুর রহিমের ছেলে হাফেজ মো. আলম, ক্যাম্প-৮ এর হেড মাঝি ইয়াছিন আরসার সক্রিয় সদস্য। তাদের মধ্যে ইয়াছিন অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে জেলে রয়েছেন। কিন্তু তার গ্রুপের সদস্যরা নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন।
কয়েকজন রোহিঙ্গা বলেন, ইয়াবা, মাদক, স্বর্ণ চোরাচালানের ব্যবসা থেকে আয় করা অর্থ এবং সাধারণ রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে গোপনে উত্তোলিত চাঁদার টাকায় ইয়াছিনকে জামিনে মুক্ত করতে মোটা টাকার তহবিল গঠন করছে ক্যাম্পে থাকা আরসা সদস্যরা।
এ ব্যাপারে ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক এসপি মো. নাইমুল হক জানান, রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে কোনো গ্রুপ থাকতে পারবে না। এপিবিএন সদস্যরা ক্যাম্প অভ্যন্তরে বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে ২২০ জন আরসা সদস্যসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত প্রায় ৯’শ রোহিঙ্গা দুস্কৃতকারীকে গ্রেফতার করেছে। পরে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। শরণার্থী ক্যাম্পে অপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে।
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে বেশ কয়েকটি জঙ্গি সংগঠন সক্রিয়। তবে সব চেয়ে বেশি বিচরণ করছে ‘আরসা’। বাংলাদেশের ৩২টি রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের মধ্যে ২৭টিতেই রয়েছে আরসার একক আধিপত্য।
সৌদি আরবে বেড়ে ওঠা পাকিস্তানি নাগরিক আবু আম্মর জুনুনি ওরফে আতাউল্লাহ বর্তমানে আরসার একটি অংশের নেতৃত্বে রয়েছে। আতাউল্লার নেতৃত্বাধীন আরসা পাঁচটি শ্রেণিতে বিভক্ত করে শরণার্থী ক্যাম্পে তৎপরতা চালাচ্ছে। এ শ্রেণিগুলি হচ্ছে- ‘ওলামা কাউন্সিল’, ‘ওলামা বোর্ড’, ‘মজলিসে আম’ এবং ‘আরকান আরমট’। তারা শরণার্থী ক্যাম্পে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি কিশোরী-তরুণী থেকে মাদক ও মানব পাচার, ডাকাতি অস্ত্র ব্যবসা, চাঁদাবাজি-সহ নানান অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছে। পাশাপাশি ক্যাম্পে নিজেদের অবস্থান আরও সুসংহত করতে নিজস্ব মুদ্রা চালু করেছে।
আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) আগে ইংরেজীতে ‘ফেইথ মুভমেন্ট’ নামে তাদের তৎপরতা চালাতো। স্থানীয়ভাবে এটি পরিচিত ছিল ‘হারাকাহ আল ইয়াকিন’ নামে। মিয়ানমারের সরকার রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মিকে একটি সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী বলে ঘোষণা করে।
মিয়ানমারের সূত্র মতে, এই গ্রুপটির নেতৃত্বে রয়েছে রোহিঙ্গা জিহাদীরা, যারা বিদেশে প্রশিক্ষণ পেয়েছে। তবে সংগঠনটি কত বড়, এদের নেটওয়ার্ক কতটা বিস্তৃত, তার কোন পরিস্কার ধারণা তাদের কাছেও নেই।
আরাকানে যারা এই সংগঠনটির সঙ্গে যুক্ত, তাদের আধুনিক গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ আছে বলে মনে করা হয়। স্থানীয় রোহিঙ্গাদের মধ্যে এই সংগঠনটির প্রতি সমর্থন এবং সহানুভূতি আছে।
আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা ‘আরসা’ ২০১৭ সালের মার্চে এক বিবৃতিতে একেবারে খোলাখুলিই জানিয়েছিল, তারা মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের অধিকার রক্ষায় কাজ করছে এবং তাদের ‘আত্মরক্ষা-মূলক’ হামলার মূল টার্গেট হচ্ছে মিয়ানমারের ‘নিপীড়নকারী শাসকগোষ্ঠী’।
আরসার প্রধান দাবি হচ্ছে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের নাগরিকত্ব এবং সমান মর্যাদা দিতে হবে। ‘আরসা’ তাদের এই বিবৃতিতে আরও জানায়, তারা বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে কোন ধরণের সন্ত্রাসবাদী কাজে লিপ্ত নয়। তাদের অধিকার আদায়ের জন্যও তারা সন্ত্রাসবাদে বিশ্বাসী নয়। বিশ্বের কোন সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গেও তাদের কোন সম্পর্ক নেই। এমনকি তারা রাখাইনের বিভিন্ন ধর্মের ও জাতির মানুষকে এবং তাদের ধর্মীয় উপাসনার স্থানের নিরাপত্তার নিশ্চয়তাও দিচ্ছে।
সূত্র মতে, বর্তমানে আল-ইয়াকিনের প্রায় দুই হাজার সদস্য রয়েছে কক্সবাজারে। দেড়শ’র মতো নারী সদস্যও রয়েছে তাদের। কক্সবাজার ও টেকনাফের প্রতিটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তারা। তবে কুতুপালং ও বালুখালিতে তাদের সদস্য সংখ্যা বেশি।
কক্সবাজার পুলিশের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, গত কয়েক বছরে আল-ইয়াকিনের হাতে কমপক্ষে ২৫ রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি নাগরিক খুন হয়েছেন। প্রায়ই স্থানীয়দের (বাংলাদেশি) অপহরণ করে তারা। নির্জন পাহাড়ে নিয়ে মুক্তিপণ আদায়ের সংবাদও শোনা যায়। ভুক্তভোগী এমন বেশ কয়েকটি পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ পাহাড়ে অভিযান চালায়। তবে এখন পর্যন্ত এ চক্রের একজন সদস্যকেও গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
বিশ্লেষকরা বলেন, ‘সরকারের উচিত মাথাচাড়া দেওয়ার আগে রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠনগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা। নইলে এসব সংগঠন বাংলাদেশের জন্য হুমকি হয়ে উঠবে।’
রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ এখনও কঠোর অবস্থান না নিলে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোকে ঘিরে নানা ধরনের সন্ত্রাসী ও জঙ্গি তৎপরতা, দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গোষ্ঠীর উস্কানি ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের খবর ইতোমধ্যেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে আসতে শুরু করেছে। এসব অপতৎপরতা দীর্ঘমেয়াদে এই অঞ্চলের জন্য হুমকি হয়ে উঠবে।
আরও বলেন, এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে আরও বেশি গোয়েন্দা নজরদারির আওতায় আনা এবং তাদের প্রত্যাবাসনে যথাযথ ভূমিকা গ্রহণ করতে সরকারের সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮২৯
আপনার মতামত জানানঃ