পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলোর কাছে ভোজ্যতেলের পর্যাপ্ত মজুত থাকার পরও বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় এ পণ্যটির পর্যাপ্ত সরবরাহ নেই। কয়েক দিন ধরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মৌলভীবাজারসহ বড় বাজারগুলোর দোকানে বোতলজাত কিছু তেল পাওয়া গেলেও পাড়া-মহল্লার দোকানগুলোতে তা বিশেষ দেখা যাচ্ছে না।
আর খোলা সয়াবিন তেলের সরবরাহ একেবারেই কমে গেছে। অধিকাংশ দোকানে পণ্যটি নেই। মঙ্গলবার রাজধানীর মগবাজার, হাতিরপুল, কারওয়ান বাজার, তেজকুনিপাড়ার বেশ কয়েকটি দোকানে খোঁজ নিয়ে ভোজ্যতেলের সরবরাহের এই সংকটাপন্ন চিত্র দেখা গেছে।
দেশে ভোজ্যতেলের পর্যাপ্ত মজুত
অথচ ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের এক প্রতিবেদেন দেখা গেছে, সমিতির সদস্য ছয় কোম্পানির কাছে বর্তমানে এক লাখ ৯৫ হাজার ৬৩৬ টন ভোজ্যতেল মজুত রয়েছে।
এর মধ্যে পরিশোধিত ভোজ্যতেল ১৯ হাজার ৭৩৭ টন এবং অপরিশোধিত ভোজ্যতেল এক লাখ ৭৫ হাজার ৮৯৯ টন। আর আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে এক লাখ ৮৩ হাজার ৮০০ টনের।
ওই প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, মজুত তেলের মধ্যে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত মিলিয়ে সিটি গ্রুপের কাছে রয়েছে ৩৯ হাজার ৯৭৮ টন, মেঘনা গ্রুপের ৫০ হাজার, টি কে গ্রুপের ৩৭ হাজার ৪৫৯ টন, এস আলমের ৫২ হাজার ৮১৮ টন, বাংলাদেশ এডিবল অয়েলের রয়েছে ১৫ হাজার ৩০৯ টন এবং গ্লোব এডিবল অয়েলের রয়েছে ৭২ টন।
তবে বসুন্ধরা গ্রুপসহ অন্য যেসব ভোজ্যতেল প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাদের কাছে কত পরিমাণ মজুত রয়েছে সেই বিষয়ে ওই প্রতিবেদনে তথ্য নেই।
বিভিন্ন সময়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দেশে বছরে মোট ২০ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। এতে মাসে গড়ে দেড় লাখ টনের কিছু বেশি ভোজ্যতেল দরকার পড়ে। কিন্তু কোম্পানিগুলোর কাছে প্রায় দুই লাখ টন মজুত রয়েছে। গত বছর আমদানি হয়েছে ২১ লাখ ৭১ হাজার টন।
এদিকে, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক জানান, বন্দরে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল বোঝাই তিনটি জাহাজ রয়েছে। এর মধ্যে সুমাত্রা পাম জাহাজে ১১ হাজার ৯৯৯ টন, সান জিনে ১২ হাজার টন ও পিভিটি নেপচুনে ১২ হাজার টন ভোজ্যতেল রয়েছে। বন্দর সূত্র জানায়, এক সপ্তাহের মধ্যে আরও কয়েকটি জাহাজভোজ্য তেল নিয়ে ভিড়তে পারে।
দাম বৃদ্ধি
দেশে ভোজ্যতেলের সরবরাহ সংকট না থাকলেও দাম বাড়ছে দফায় দফায়। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়তি। এর প্রভাবে দেশে দাম বাড়ছে। কিন্তু দেশে এ মুহূর্তে পর্যাপ্ত তেলের মজুত আছে। অন্তত রমজান মাস পর্যন্ত সংকট তৈরি হওয়ার তেমন কোনো আশঙ্কাও নেই।
এখানে অভিযোগ কোম্পানি ও পরিবেশকরা মিলে বাজারে কৃত্রিমভাবে সয়াবিন তেলের সংকট তৈরি করেছে। যদিও চট্টগ্রাম বন্দরে প্রায় ৩৬ হাজার টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেল নিয়ে তিনটি জাহাজ অবস্থান করছে। এছাড়া পাইপলাইনে রয়েছে ভোজ্যতেল বোঝাই আরও কয়েকটি জাহাজ।
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন কারণে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে। গত ৭ ফেব্রুয়ারি বাড়তি দাম সমন্বয় করে অভ্যন্তরীণ বাজারের জন্য ৮ টাকা বাড়িয়ে দাম নির্ধারণ করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
এরপর পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলো ২৭ ফেব্রুয়ারি পুনরায় লিটারে ১২ টাকা দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করে। কিন্তু বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তাতে সায় দেয়নি। তারপর থেকে বাজারে পণ্যটির সরবরাহ ক্রমেই দাম বাড়ছে।
টিসিবির তথ্যমতে, গত ৭ ফেব্রুয়ারি খোলা সয়াবিনের দর ছিল ১৪৫ থেকে ১৫০, আর পাম তেলের দর ছিল ১৩৪ থেকে ১৩৬ টাকা।
এরপর ব্যবসায়ীরা গত ২৭ ফেব্রুয়ারি লিটারে ১২ টাকা দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়ার পরই ১ মার্চ এক লাফে খোলা সয়াবিনের দর ওঠে ১৬০ থেকে ১৭৫ টাকা এবং পাম তেলের দর উঠেছে ১৫৩ থেকে ১৫৮ টাকায়।
গতকাল মঙ্গলবার সয়াবিন তেল ১৬০ থেকে ১৭২ টাকা এবং পাম তেল ১৫০ থেকে ১৫৮ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের মতামত
দোকানদাররা জানিয়েছেন, বেশ কিছুদিন ধরে কোম্পানিগুলো সরবরাহ কমিয়েছে। কোম্পানির গাড়ি আসছে ঠিকই, কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী তেল দিচ্ছে না। ৫০ বোতল চাইলে দিচ্ছে ১০ বোতল।
অন্যদিকে, পাইকারি বাজারে গিয়েও চাহিদা অনুযায়ী খোলা তেল মানে ড্রাম পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে প্রত্যেক দিন তেল কেনা লাগছে।
এদিকে, মিল মালিকরা বলছেন, প্রতিদিন তেল সরবরাহ করা হচ্ছে। ডিলার ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, দু-একটি কোম্পানি তেল সরবরাহ করলেও বাকিরা দিচ্ছে না।
গতকাল ভোজ্যতেল পাইকারি ব্যবসায়ীদের নিয়ে সচেতনতামূলক এক সভায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য) এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, ভোজ্যতেল নিয়ে সব স্তরে কারসাজি হচ্ছে।
গতকাল রাজধানীর বড় মগবাজারের হাবিব জেনারেলের স্টোরের মালিক হাবিবুর রহমান জানান, বেশ কয়েক দিন ধরে খোলা সয়াবিন তেল নেই। বিভিন্ন কোম্পানির গাড়িগুলো আগে দোকানে এসে বোতলজাত তেল দিয়ে যেত। কিন্তু এখন দিচ্ছে না। কারওয়ান বাজার থেকেও এক বা দুই কার্টনের বেশি তেল পাওয়া যাচ্ছে না।
তেজকুনিপাড়ার লোকমান জেনারেল স্টোরের লোকমান মিয়া বলেন, খোলা সয়াবিন নেই। বোতলজাত তেলও দিচ্ছেন না ডিলাররা। ডিলাররা বলছেন, কোম্পানিগুলো তাদের তেল সরবরাহ করছে না। সে কারণে তারা তেল দিতে পারছেন না।
তেল লুকিয়ে কৃত্রিম সংকট
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই বিক্রেতা আরো বলেছেন, কেউ কেউ বলছে, পাঁচ লিটার বোতল ৭৯০ টাকায় নিতে হবে। কিন্তু ৭৯০ টাকায় আনার পর ৭৯৫ টাকায় বেঁচতে হবে, এত সীমিত লাভে কোন দোকানদার আনতে চায় না মাল? এজন্য তেল নাই দোকানে।
তিনি বলছিলেন, তার এলাকার কোন দোকানীই এ মাসে নতুন তেল আনতে পারেননি। গত মাসে আনা তেল, বিশেষ করে এক লিটার এবং তিন লিটারের বোতল বেঁচতে হচ্ছে তাদের।
এদিকে, মুদি দোকানির গোডাউন থেকে থেকে উদ্ধার করা হয়ছে ১ হাজার লিটার সয়াবিন তেল। মান্নান স্টোর নামে দোকানটির অবস্থান শরীয়তপুর পালং বাজার এলাকায়। এটি ওই এলাকার বড় মুদি দোকানের মধ্যে একটি।
তেল লুকিয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করার অপরাধে দোকানটির মালিক মান্নান মাদবরকে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে তার কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে মুচলেকা। এ ছাড়াও আরও তিন দোকানিকে তিন হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মন্দীপ ঘরাই জানান, দোকানিরা তেল মজুদ করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে। জানতে পেরে আমরা মান্নান স্টোরে গিয়ে দেখি বোতালজাত করা কোনো তেল নেই। পরে তার স্টোরে গিয়ে প্রচুর পরিমাণ তেল পাওয়া যায়। তেল লুকিয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করার অপরাধে দোকানের মালিককে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এ ছাড়াও আরও তিনটি দোকানের মালিককে ৩ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৪০
আপনার মতামত জানানঃ