অক্টোবর বিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়ার বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা ভ্লাদিমির লেনিন তার সহযোদ্ধাদের নিয়ে জারশাসিত রুশ রাজতন্ত্রকে উৎখাত করেন। কিন্তু রুশ কমিউনিস্টরা জারশাসিত রাজতন্ত্রকে উৎখাত করতে সমর্থ হলেও বিপ্লবের পরে আরও বেশ কিছুদিন তাদের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি, অর্থাৎ জারের প্রতি অনুগত বাহিনীর সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়।
কারণ, ‘হোয়াইটস’ হিসেবে পরিচিত রাজতন্ত্রের সমর্থকরা রাশিয়ার রাষ্ট্রব্যবস্থায় কমিউনিজম প্রতিষ্ঠিত হওয়াকে মোটেও ভালোভাবে নেননি। যুদ্ধফেরত সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, পুঁজিবাদের সমর্থক রুশ সমাজের ধনী সম্প্রদায় ও রুশ রাজপরিবারের প্রতি সহানুভূতিশীল ব্যক্তিরা আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মতো দেশের সহায়তা নিয়ে কমিউনিস্টদের লালফৌজের সাথে গৃহযুদ্ধ চালিয়ে যান।
শেষপর্যন্ত লেনিনের লালফৌজের কাছে রাশিয়ার প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির পতন ঘটে এবং লেনিন সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠনের পর সেখানকার সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচিত হন। লেনিন খুব বেশিদিন সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে দায়িত্ব পরিচালনা করতে পারেননি।
১৯২২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯২৪ সালের ২১ জানুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টিকে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে যান।
লেনিনের মৃত্যুর পর সোভিয়েত রাশিয়ার পরবর্তী নেতা কে হবেন– এ নিয়ে ছোটখাট বিতর্ক শুরু হয়। বলা হয়ে থাকে, লেনিনের পর নেতা হওয়ার দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে ছিলেন লিয়ন ট্রটস্কি।
কারণ তিনি সোভিয়েত রাশিয়ার বিপ্লব-পরবর্তী গৃহযুদ্ধে বলশেভিকদের বিজয়ের মূল কারিগর ছিলেন। যদিও বর্তমান ইতিহাসবিদরা একে অতিরঞ্জিত মনে করেন, তারপরও গৃহযুদ্ধে বলশেভিকদের বিজয়ে ট্রটস্কির যে বড় অবদান ছিল সেটি অস্বীকার করার উপায় নেই। এমনও শোনা যায়, স্বয়ং লেনিন নাকি পার্টির মধ্যে ট্রটস্কির জনপ্রিয়তা নিয়ে বেশ বিপাকে ছিলেন।
এদিকে, ১৯২১ সালে কমিউনিস্ট পার্টির নতুন সাধারণ সম্পাদক হন জোসেফ স্ট্যালিন। তার আগেই তিনি জর্জিয়ার স্বাধীনতা অর্জনে, ইউক্রেনে পোলিশ আক্রমণ রুখে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু ঐতিহাসিক অক্টোবর বিপ্লবে তার খুব একটা ভূমিকা ছিল না।
স্ট্যালিন সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে নিজের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে মন দেন। কিন্তু লেনিন বেশ কিছু কারণে মন থেকে স্ট্যালিনকে পছন্দ করতেন না। জর্জিয়ায় বলশেভিক বিপ্লববিরোধীদের তিনি যেরকম নির্মমভাবে দমন করেছিলেন, সেটি লেনিন মেনে নিতে পারেননি। আর স্ট্যালিন, ট্রটস্কি এবং লেনিনের মতো তিনি বুদ্ধিজীবী গোছেরও ছিলেন না, কর্তৃত্ববাদী মানসিকতাসম্পন্ন ছিলেন। এসব খারাপ দিক থাকা সত্ত্বেও কমিউনিস্ট পার্টিতে স্ট্যালিনের বেশ জনপ্রিয়তা ছিল।
কিন্তু সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ১৯২৭ সালে সোভিয়েত রাশিয়ার একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে স্ট্যালিন ক্ষমতায় আসীন হন। কিন্তু পার্টির অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় নেতারা তার ক্ষমতায় আসীন হওয়াকে ভালো নজরে দেখেননি। বুখারিন, ট্রটস্কি প্রমুখ নেতারা তার ক্ষমতায় আরোহনের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করেন। পার্টির এই অসন্তুষ্ট মেম্বার ও নেতাদের দমন করতেই স্ট্যালিন মূলত দ্য গ্রেট টেরোর চালিয়েছিলেন।
দ্য গ্রেট পার্জের কারণ নিয়ে ইতিহাসবিদদের মাঝে অনেক মতবিভেদ রয়েছে। অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, স্ট্যালিন নিজের ব্যক্তিত্বের ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তা ও ক্ষমতার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে গিয়েই এরকম নৃশংস অভিযান চালিয়েছিলেন।
আবার কেউ কেউ বলছেন, সেই সময়ে জার্মানি ও জাপানে উগ্রপন্থার উদ্ভব ঘটার কারণে স্ট্যালিন নিজেকে একটি সম্ভাব্য যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করছিলেন। এরকম অবস্থায় তিনি দেশকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে বিরোধী মতাদর্শীদের কঠোরভাবে দমন করাকেই সবচেয়ে ভালো উপায় বলে মনে করেছিলেন। কিছু ইতিহাসবিদ আবার বলেন, কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে শৃঙ্খলা আনতেই তিনি এরকমটা করছিলেন। কারণের মধ্যে পার্থক্য যা-ই থাকুক, নিজের শত্রু ও ভিন্ন মতাদর্শের মানুষদের গোড়াশুদ্ধ উপড়ে ফেলতে যে তিনি এমন নির্মমতার আশ্রয় নিয়েছিলেন, এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকে না।
স্ট্যালিন এসেই কমিউনিস্ট পার্টির ভেতরে ও রুশ সমাজে রাজনৈতিক শুদ্ধিকরণ অভিযান পরিচালনা করেন। ‘দ্য গ্রেট পার্জ’ নামের সেই রাজনৈতিক শুদ্ধিকরণ অভিযানের মাধ্যমে কমিউনিস্ট পার্টির এক-তৃতীয়াংশ নেতাকর্মী হত্যাকান্ডের শিকার হন।
১৯৩০ এর দশকের শেষ দিকে শুরু হওয়া সেই অভিযানে প্রাণ হারান প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ। এছাড়াও সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের গ্রেফতারের মাধ্যমে দুর্গম অঞ্চলের খনিগুলোতে শ্রমিক হিসেবে পাঠিয়ে দেয়া হতো। লেবারক্যাম্পে অপুষ্টি, নোংরা পরিবেশ ও হাড়ভাঙা খাটুনি সইতে না পেরে মৃত্যুবরণ করে হাজার হাজার মানুষ, যাদের অনেকের কোনো অপরাধ ছিল না।
দ্য গ্রেট টেরোরের শুরু সের্গেই কিরোভ হত্যাকান্ডের মাধ্যমে। ১৯৩৪ সালের ডিসেম্বরে লেনিনগ্রাদে পার্টি অফিসে প্রকাশ্যে গুলি করে তাকে হত্যা করা হয়। সের্গেই কিরোভ বহু বছর ধরেই স্ট্যালিনের ভালো বন্ধু ছিলেন।
দ্য গ্রেট পার্জ শুরু হওয়ার পর কমিউনিস্ট, সামরিক ব্যক্তিত্ব ও সাধারণ মানুষকে গণহারে গুলাগ শ্রমক্যাম্পে পাঠানো শুরু হয়। ১৯৩০ থেকে স্ট্যালিনের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ৪০ থেকে ৫০ লাখ বন্দী গুলাগে দীর্ঘমেয়াদী সাজা ভোগ করেছিলেন।
গুলাগ লেবার ক্যাম্পে বন্দীদের বাধ্যতামূলকভাবে শারীরিক শ্রম দিতে হতো। কেউ খাটতে অস্বীকার করলে তাকে খাবার দেয়া হতো না এবং ক্ষেত্রবিশেষে ফাঁসিতে ঝোলানো হতো। খাদ্যের অভাব, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, দীর্ঘসময় ধরে খাটার কারণে বন্দীরা সেখানে খুব বেশিদিন টিকতে পারতো না। পশ্চিমা গবেষকদের মতে, ১৯১৮ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত বারো লক্ষ থেকে সতের লক্ষ মানুষ এই লেবারক্যাম্পগুলোতে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছিল।
দ্য গ্রেট টেরোর ছিল সোভিয়েত রাশিয়ার বুদ্ধিজীবিতার উপর চরম আঘাত। ১৯২০ ও ত্রিশের দশকে দুই হাজারেরও বেশি বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, সাহিত্যিক, চিত্রকর ও সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়।
১৯২৯ সালেই লিয়ন ট্রটস্কিকে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ান ও স্ট্যালিনের বিপক্ষে জনমত গঠন করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি মেক্সিকোয় থিতু হন। মস্কো ট্রায়ালে তার অনুপস্থিতিতেই তাকে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেয় আদালত।
বেশ কয়েকবার হত্যাচেষ্টার পর ১৯৪০ সালে র্যামন মারকাদের নামের একজন স্পেনিশ কমিউনিস্ট বরফের খন্ড দিয়ে তার মাথায় উপর্যুপরি আঘাত করেন, যার ফলে ট্রটস্কি মারা যান। এই হত্যাকান্ডের পেছনেও স্ট্যালিনের হাত ছিল– এমন কথা প্রচলিত আছে।
১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে স্ট্যালিন যুদ্ধের প্রতি মনোযোগী হন। গণহারে হত্যার ঘটনাও কমে আসে, কারণ সোভিয়েত রাশিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে প্রচুর সৈন্য দরকার ছিল। ১৯৩৮ সালের পর আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযান শেষ হয়ে গেলেও এনকেভিডির ১৯৪১ সাল পর্যন্ত গণহারে গ্রেফতার, অভিযুক্ত করা এবং ফাঁসিতে ঝোলানো চলমান ছিল।
দ্য গ্রেট টেরোর সোভিয়েত রাশিয়ার সমাজে মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনে। মানবিক সম্পর্ক চরম নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হয় এই অভিযানের ফলে। এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে, এমনকি একই পরিবারের একজন সদস্য আরেকজন সদস্যের সাথে সম্পর্ককে অস্বীকার করে। কারণ, ভয় ছিল, হয়তো অভিযুক্ত কারও সাথে সম্পর্ক রাখলে এনকেভিডির সন্দেহভাজন তালিকায় নাম চলে যাবে।
যে বলশেভিক বিপ্লবী অক্টোবরের বিপ্লবে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের জীবন-যৌবন উৎসর্গ উৎসর্গ করেছিলেন, দ্য গ্রেট টেরোরের সময় তিনিই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে খুনের স্বীকার হলেন। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস!
এসডব্লিউ/এসএস/১৯১০
আপনার মতামত জানানঃ