ভারত ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন পানি সংকটে আছে। কোটি কোটি মানুষ ও পশুপাখি হুমকির মধ্যে পড়েছে। ৬০ কোটি ভারতীয় তীব্র পানি সংকটের শিকার এবং নিরাপদ পানি না পাওয়ার কারণে প্রতিবছর এখানে প্রায় দুই লাখ মানুষের মৃত্যু হয়।
নদীর উৎসমুখেই খরা দেখা দেয়ায় অদূর ভবিষ্যতে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র আর সিন্ধুর মতো নদনদীর ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা। অনেক বিজ্ঞানী আশঙ্কা করছেন, আগামী ৩০ বছরে হিমালয়ের হিন্দুকুশ অঞ্চলে তাপমাত্রা ১ থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়বে। কোথাও কোথাও তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার বছরে ৪ থেকে ৫ ডিগ্রি পর্যন্তও হতে পারে। এর ফলে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, সিন্ধু, সালউইন ও মেকং— এই ৫টি নদীর উৎসমুখ তীব্র পানিসঙ্কটে পড়তে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি এখন গোটা বিশ্বের মাথা ব্যথার কারণ। তবে এবার ভারতে এর প্রভাবের মাত্রা ঠিক কী হবে, তা প্রকাশ্যে এল জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আইপিসিসি’র সাম্প্রতিকতম প্রতিবেদনে।
পানি নিয়ে ভারতের সংকট পুরনো। গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউশন ফর ট্রান্সফরমিং ইন্ডিয়ার (নিটি আয়োগ) ২০১৮ সালের কম্পোজিট ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট ইনডেক্সের উপসংহারে যা বলা হয়েছিল তা ভারতের জন্য সতর্কবার্তার মতো। সেখানে বলা হয়, পানির মানের দিক থেকে ১২২টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ১২০তম। এ দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ পানি দূষিত।
২০৩০ সাল নাগাদ ৪০ শতাংশ ভারতীয় নাগরিকের খাওয়ার পানি হাতের নাগালের বাইরে চলে যাবে। ইতিমধ্যে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও সিন্ধু নদের পানি অনেক আগে থেকেই শুকিয়ে যেতে শুরু করেছে। দেশজুড়ে পাঁচ হাজারের বেশি বাঁধ দিয়েছে ভারত। এ বাঁধের কারণেও পানির স্বাভাবিক প্রাপ্যতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
কী বলা হচ্ছে প্রতিবেদনে?
সূত্র মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে ২০৫০ সালের মধ্যেই তীব্র পানি এবং খাদ্য সংকটের শিকার হতে চলেছে গঙ্গা, সিন্ধু এবং আমু দরিয়া উপত্যকা। তাছাড়াও চরম প্রাকৃতিক অবস্থার জন্য গৃহহীন হতে চলেছেন কোটি কোটি ভারতীয় নাগরিক।
ভারত তথা দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশই তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশ। আর এই চরম দারিদ্র এবং বৈষম্যই মারাত্মক জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য অনেকটা দায়ী। আইপিসিসি’র এই রিপোর্টে উঠে আসছে এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য।
প্রশ্ন থেকে যায় দারিদ্র কীভাবে শত্রু হয়ে দাঁড়াচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের? পরিসংখ্যান বলছে ভারতে শহরাঞ্চলে বসবাস করেন ৪৮ কোটির বেশি মানুষ। এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই শহরের সাধারণ ধারণ ক্ষমতার থেকে এই জনসংখ্যা অনেকটাই বেশি।
ঘিঞ্জি বাসস্থান এবং অন্যান্য কার্যকলাপের ফলে ক্রমাগত বাড়ছে শহরগুলির কার্বন ফুটপ্রিন্ট। যা পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করছে আঞ্চলিক জলবায়ুকে। যার ফলে ক্রমশ উষ্ণতা বাড়ছে সিন্ধু ও গাঙ্গেয় উপত্যকায়। আর সেই প্রভাব ইতিমধ্যেই দৃশ্যমান ভারতের বুকে।
সাধারণত, জলবায়ু পরিবর্তন কতটা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে, তা বোঝার জন্য ব্যবহৃত হয় ওয়েট-বাল্ব তাপমাত্রা পরিমাপক। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে নদী এবং অন্যান্য জলাধারের বাষ্পীভবনের হার নির্ণয় করা হয় এই পদ্ধতিতে।
আর এই মূল্যায়নই জানাচ্ছে, বর্তমানে ভারতে ওয়েট-বাল্ব তাপমাত্রা প্রায় ৩১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি। যেখানে প্রথম বিশ্বের, এমনকি ইউরোপের শিল্পনির্ভর দেশগুলিতেও এই তাপমাত্রা ২৫-২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
এই অনিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে যেমন একদিকে দ্রুত গতিতে গলছে হিমবাহ, তেমনই গঙ্গা এবং সিন্ধু উপত্যকায় পানির স্রোত বাড়ায় দেখা দিচ্ছে বন্যা। তবে বরফ এই হারে গলতে থাকলে অল্প দিনের মধ্যেই শুকিয়ে আসবে উত্তর ভারত থেকে জন্ম নেওয়া নদীগুলি। দেখা দেবে পানির সংকট।
সেচের অভাবে কৃষিকাজ ব্যাহত হওয়ায় খাদ্যসংকটেরও সম্মুখীন হবে ভারত। অন্যদিকে ভারতের উপকূলবর্তী অঞ্চলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে প্রভাবিত হচ্ছে বায়ুমণ্ডলীয় চাপ। যা একাধিক ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির অন্যতম কারণ। ওয়েট-বাল্ব সমীক্ষা জানাচ্ছে এমনটাই।
পরিসংখ্যান বলছে ২০১৯ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত চরম প্রাকৃতিক অবস্থার জন্য বাস্তুচ্যুত হয়েছেন প্রায় ১ কোটি মানুষ। গবেষকদের অনুমান, ২০৫০ সালের মধ্যে এই সংখ্যাটা পৌঁছাতে পারে ৪.৫-৫ কোটিতে। অর্থাৎ, প্রায় ৪ গুণ বৃদ্ধি পাবে প্রকৃতির ভয়াবহতা।
পাশাপাশি তার জন্য প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে ভারত। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কার্বন নির্গমনের হার কমিয়ে আনাই এখন একমাত্র হাতিয়ার। আর সেই ব্যাপারেই সতর্ক করছেন গবেষকরা।
কী বলছেন সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা?
তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে হিমবাহগুলো দ্রুত গলে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়ায় বেশ নদীর ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
‘সেন্টার ফর ইন্টিগ্রেটেড মাউন্টেন ডেভেলপমেন্ট’ (আইসিআইএমওডি)-এর পরিচালিত এ সংক্রান্ত এক গবেষণার সঙ্গে যুক্ত এক পরিবেশ বিজ্ঞানী জানান, নদীর উৎসমুখ শুকিয়ে গেলে সমতলে পানির জোগান কমে যাবে। ভারত, বাংলাদেশ, চীন, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম সঙ্কটে পড়বে।
হিন্দুকুশ অঞ্চলে কোথায় ভূগর্ভস্থ পানির পরিমাণ কতটুকু, কোথায় হিমবাহ দ্রুত গলছে, কোথায় ভূমিকম্পে পাহাড় ধসে নদী বন্ধ হয়ে গেছে, ভূমিকম্পে কোথায় নতুন জলাশয় তৈরি হয়েছে, কোন কোন এলাকায় ধসের ফলে জনপদ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে, তার একটি মানচিত্র তৈরি করেছে আইসিআইএমওডি।
সংস্থাটির এক মুখপাত্র বলেন, ওই মানচিত্র দেখে পৃথিবীর যে কোনো এলাকার পরিবেশ বিজ্ঞানী হিন্দুকুশ অঞ্চলের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে পারবেন।
ওই সংস্থার বিজ্ঞানীরা যে সতর্কবার্তা দিয়েছেন তাতে বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে হিন্দুকুশ হিমালয় অঞ্চলে তাপমাত্রা ১ থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়বে। যার ফলে নষ্ট হয়ে যাবে পুরো এলাকার বাস্তুতন্ত্র। এতে বর্ষা দীর্ঘায়িত হবে, কিন্তু বৃষ্টি হবে সামঞ্জস্যহীনভাবে। বৃষ্টিপাতের মাত্রা সম্পর্কে তখন আর পূর্বাভাস দেওয়া যাবে না। পুরো বর্ষাকাল জুড়ে বৃষ্টি না হয়ে কয়েকটা পর্যায়ে অতিরিক্ত বৃষ্টি হবে। হিমবাহ গলতেই থাকবে। বেশি গলবে সিন্ধু অঞ্চলের হিমবাহগুলো।
গবেষকরা জানান, হঠাৎ হঠাৎ ভারী বর্ষণে নদীগুলো দিয়ে একসাথে অনেক পানি নামায় পাহাড়ে ধস ও সমতলে বন্যা হবে। এতে মাটির নিচে যথেষ্ট পানি জমার সুযোগ পাবে না। আবার অন্য সময় নদীতে পানি কম থাকায় পাহাড় সংলগ্ন এলাকায় কৃষিকাজ ব্যাহত হবে।
বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে হিন্দুকুশ হিমালয়ে হিমবাহ কীভাবে গলে যাচ্ছে, ইউরোপের ভূবিজ্ঞানীদের সংগঠন ‘ইউরোপিয়ান জিওসায়েন্সেস ইউনিয়ন’র জার্নাল ‘ক্রায়োস্ফিয়ার’-এ প্রকাশিত নিবন্ধে সম্প্রতি তা ব্যাখ্যা করা হয়। আইসিআইএমওডি’র পানিবিজ্ঞানী জোসেফ শি ওই নিবন্ধে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, হিমালয়ের এই অংশে যে সাড়ে পাঁচ হাজার হিমবাহ রয়েছে, তার একটা বড় অংশ আগামী ১শ’ বছরের মধ্যে গলে যাবে।
এতে বলা হয়েছে, হিন্দুকুশ হিমালয়েই এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘার মতো পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু পর্বতশৃঙ্গগুলো রয়েছে। হিমবাহগুলো একের পর এক গলে গেলে সেসব পর্বতশৃঙ্গের কী অবস্থা হবে, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে নিবন্ধটিতে।
হিমালয়ের হিমবাহ যে দ্রুত গলে যাচ্ছে, ‘ইন্টার গভার্নমেন্টাল প্যানেল অব ক্লাইমেট চেঞ্জ’ (আইপিসিসি)-এর রিপোর্টেও তা উল্লেখ করা হয়েছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৫৭
আপনার মতামত জানানঃ