ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বিভিন্ন হলগুলোতে বিগত পাঁচ মাসে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৮ জন শিক্ষার্থী। এছাড়া ৩ জন সাংবাদিক ও দুইজন ফটো সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এসব ঘটনায় নির্যাতকের ভূমিকা পালন করেছে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।
সোমবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে এই তথ্য প্রকাশ করে মানবাধিকারবিষয়ক শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্ম ‘স্টুডেন্টস অ্যাগেইনস্ট টর্চার (এসএটি)।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ৫ অক্টোবর থেকে শুরু করে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ মাসে ছয়টি হলে ১৮ জন শিক্ষার্থী শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
এর মধ্যে স্যার এ এফ রহমান হলে সবচেয়ে বেশি সাতজনকে নির্যাতন করা হয়। মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান, মাস্টারদা সূর্য সেন ও বিজয় একাত্তর হলে নির্যাতন করা হয় তিনজন করে।
রোকেয়া হল ও জগন্নাথ হলে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন একজন করে।
সংগঠনটি জানায়, ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে চলতি বছর ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবাদ সংগ্রহ করা তিন সাংবাদিক ও দুই ফটোসাংবাদিক ছাত্রলীগের হামলার শিকার হন।
২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে চলতি বছর ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবাদ সংগ্রহ করা তিন সাংবাদিক ও দুই ফটোসাংবাদিক ছাত্রলীগের হামলার শিকার হন।
প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক সোর্সের মাধ্যমে এই প্রতিবেদন তৈরির কথা জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে। প্রাথমিক সোর্স হিসেবে নির্যাতিত শিক্ষার্থীর বক্তব্য আর মাধ্যমিক সোর্স হিসেবে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়া তথ্যকে বোঝানো হয়েছে।
এই সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এসএটির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছে। এর প্রতিষ্ঠাতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী সালেহ উদ্দীন সিফাত। তার সঙ্গে সহপ্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আছেন স্মৃতি আফরোজ সুমি, আহনাফ সায়েদ খান, আনাস বিন মনির, সাদ আরমান নাফিস।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সালেহ উদ্দিন সিফাত বলেন, বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে চলমান নির্যাতন, নিপীড়ন ও সহিংসতাকে আমরা মানবাধিকারের লঙ্ঘন হিসেবে দেখি। নাগরিকরা কোনো নির্যাতন, নিষ্ঠুর ও অমানবিক দণ্ডের শিকার হবে না- এ প্রতিশ্রুতি দেওয়া যেমন রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তেমনি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষেরও দায়িত্ব শিক্ষার্থীরা যে কোনো নির্যাতন, নিপীড়ন কিংবা সহিংসতার শিকার হবে না, তা নিশ্চিত করা এবং শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা। কিন্তু আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি যে, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। এই নির্যাতনের হার সবচেয়ে বেশি আবাসিক হলগুলোর অতিথি কক্ষে। যা নির্যাতিত শিক্ষার্থীদের শিক্ষার অধিকারকেও নীরবে হরণ করছে।
সিফাত জানান, স্যাট প্রতিবছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সংগঠিত নির্যাতনগুলোর পরিসংখ্যান প্রকাশ করবে। ইতোপূর্বে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও এসব ঘটনা তথ্যবহুল আকারে কখনো প্রকাশিত হয়নি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিয়মিত নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও এসব ঘটনার ভয়াবহতা সম্পর্কে আমাদের জানা সম্ভব হয় না।
তিনি বলেন, আমরা এবারের প্রতিবেদনে নির্যাতনকারীর নাম প্রকাশ করছি না। কিন্তু সামনের দিনগুলোতে আমরা নির্যাতনকারীর নাম, বিভাগ, হল এসব প্রকাশ করব। প্রতিবেদন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের কাছে আমরা দেব। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি কোনো ধরনের ব্যবস্থা না নেয় তাহলে আচার্য ও মহামান্য আদালতের দ্বারস্থ হবো, রিট পিটিশন দায়ের করা হবে।
গত কয়েক মাসের ঘটনা সম্পর্কে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস খোলার আগে বিশ্বিবদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রক্টর আশ্বাস দিয়েছিলেন যে কোনো ধরনের নির্যাতনের ঘটনা ঘটবে না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস খোলার পর নির্যাতন শুরু হয়। এসব নির্যাতনের মধ্যে মাত্র তিনটি ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেগুলো নামমাত্র ব্যবস্থা। সত্তর শতাংশ ক্ষেত্রে প্রশাসন নির্বিকার থাকে, বাকী ত্রিশ শতাংশ নির্যাতনের ঘটনায় ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
সংগঠনটির কর্মীরা বলেন, নির্যাতনের মতো অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনীয় অপরাধের ক্ষেত্রে ষাণ্মাসিক ও বাৎসরিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে এই প্রতিবেদন তুলে ধরছি যাতে প্রত্যেকটি নির্যাতনের ঘটনা তদন্তপূর্বক নির্যাতকদের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রশাসনিক ও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এই লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে গেস্টরুম নির্যাতনের বিরুদ্ধে একটি প্রশাসনিক বিধি এবং আইন তৈরি করারও প্রস্তাব রাখছি।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের দৌরাত্ম্য দিনদিন চাউর হয়ে উঠছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে ক্ষমতার চূড়ান্তে বসবাস করেন। তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসন ও সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে আগ্রহবোধ না করায় তাদের দৌরাত্ম্য আরও বেড়ে চলেছে। ছাত্রলীগের এই আইনের উর্ধে চলে যাওয়ার পেছনে অবশ্য রাজনৈতিক নেতাদের কুৎসিত হাতের ভূমিকা রয়েছে। তারা বলেন, ছাত্রলীগ সংগঠনটির ছাত্রদের ধীরে ধীরে উগ্র এবং একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীতে রুপদানের পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক নেতাদের অনৈতিক মদদ ও উস্কানি। এ বিষয়ে প্রশাসনের জরুরি পদক্ষেপ হস্তক্ষেপ কামনা করেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২৩৪৯
আপনার মতামত জানানঃ