প্রায় দেড় কোটি স্কুলশিক্ষার্থীর শিক্ষা উপকরণ কেনার ভাতা এক বছরের বেশি সময় ধরে আটকে আছে। একই সঙ্গে প্রায় এক বছর ধরে আটকে আছে তাদের নিয়মিত উপবৃত্তির অর্থ। এ নিয়ে দফায় দফায় উদ্যোগ নেয়া হলেও সুরাহা মেলেনি।
এ বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের শুরুতে এক কোটি ৪০ লাখ শিক্ষার্থীকে শিক্ষা উপকরণ কেনার জন্য যে ভাতা দেওয়ার কথা ছিল তা এখনো দেশের সামান্য কিছু উপজেলা ছাড়া সুবিধাভোগীদের হাতে পৌঁছায়নি। এই অর্থ বহুদিনে ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকউন্টে পড়ে আছে। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ২০২২ খ্রিস্টাব্দের শিক্ষা উপকরণ কেনার টাকাও। যা এখনও ছাড় করার দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই মন্ত্রণালয়ের।
জানা যায়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এই অর্থ বিতরণ সম্ভব হচ্ছে না।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সব প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পরও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় চিঠি দিয়ে অর্থ আটকে দিয়েছে। এখানে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কিছুই করার নেই। ২০২১ সালের শিক্ষা উপকরণ কেনার টাকা ইলেক্ট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার (ইএফটি) করা আছে। এখন বিতরণকারী সংস্থার কাছে অর্থ গেলেই বিতরণ সম্ভব।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আমিনুল ইসলাম খান বলেন, ‘আমি কিছুদিন আগে এ মন্ত্রণালয়ে যোগদান করেছি। কেন শিক্ষার্থীদের ভাতার অর্থ বিরতণ করা সম্ভব হয়নি, তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
দীর্ঘ এক বছর ধরে উপবৃত্তি ও ভাতা না পাওয়ায় হতাশ মো. সালাউদ্দিন নামের এক অভিভাবক।
তিনি বলেন, ‘ছেলেমেয়ের পড়ালেখার জন্য উপবৃত্তির টাকা দেয় সরকার। গত এক বছর ধরে এই অর্থ পাচ্ছি না। এতে সন্তানের শিক্ষার ব্যয় সংকুলানে বাড়তি চাপের মধ্যে আছি।’
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে জানা যায়, ২০২১ সালের শুরুতে এক কোটি ৪০ লাখ শিক্ষার্থীর শিক্ষা উপকরণ কেনার ভাতা পড়ে আছে বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে। সে সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ২০২২ সালের শিক্ষা উপকরণ কেনার ভাতাও।
প্রাথমিকের ভাতার টাকা বিতরণ বিষয়ে গত বছরের ১৮ নভেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হয়। কিন্তু তাতেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। ভাতা বিতরণের দায়িত্বে রয়েছে ডাক বিভাগের ডিজিটাল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস নগদ।
বৈঠকে উপস্থিত এক কর্মকর্তা জানান, মোবাইল নম্বর সংক্রান্ত জটিলতার কারণে শুরুর দিকে ২ লাখ ১ হাজার ২৬৫টি অ্যাকাউন্টে ভাতা ও উপবৃত্তির অর্থ বিতরণ সম্ভব হচ্ছিল না। পরে নগদ এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার শিক্ষা কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় এই নম্বরগুলোতে উপবৃত্তির অর্থ বিতরণ করা সম্ভব হয়।
নগদ-এর হেড অব পাবলিক কমিউনিকেশন্স জাহিদুল ইসলাম সজল বলেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি ও শিক্ষা উপকরণ কেনার ভাতা বিতরণের জন্য আমরা পরিপূর্ণভাবে তৈরি আছি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তরের নির্দেশনা পেলেই সব ভাতা ও উপবৃত্তি বিতরণ সম্পন্ন করতে পারব। আমাদের ডেটাবেজও পুরোপুরি তৈরি আছে।’
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এই অর্থ বিতরণ সম্ভব হচ্ছে না।
প্রতি বছরের জানুয়ারি মাসে প্রায় দেড় কোটি শিক্ষার্থীকে শিক্ষা উপকরণ কেনার ভাতা দেবার উদ্যোগ সরকার। নানা প্রক্রিয়া শেষে এখন মোবাইল ফাইনান্সিয়্যাল সার্ভিসের মাধ্যমে এই টাকা পাঠানো হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২১ খ্রিস্টাব্দের শিক্ষা উপকরণ কেনার টাকাগুলো ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার (ইএফটি) করা আছে। এখন কেবল বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে গেলেই এটি বিতরণ করা যাবে।
করোনার ছোবলের মধ্যে দীর্ঘ এক বছর উপবৃত্তি ও ভাতা না পাওয়ার বিষয়ে অভিভাবকেরাও হতাশ। এ বিষয়ে এক শিক্ষার্থীর সেলিনা খাতুন বলেন, করোনার সময়ে সরকারের দেয়া উপবৃত্তির টাকা অনেকটা সাহায্য করেছিল। এখন সবকিছুর দাম বেড়েছে, এই সময়ে উপবৃত্তি ও ভাতার টাকা না পেয়ে কষ্টও বেড়ে গেছে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, পুরো বিষয়টি আটকে আছে। মন্ত্রণালয়ের একটি চিঠির কারণে তৈরি হয়েছে অচলাবস্থা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের শীর্ষ পর্যায়ের দুই-তিনজন কর্মকর্তার অনাগ্রহ এবং বিরোধিতার কারণে প্রায় দেড় কোটি শিক্ষার্থী ভাতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
গত বছরের ১৮ নভেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে এ বিষয়ে উচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠকও হয়েছে। কিন্তু তাতেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। ভাতা বিতরণের দায়িত্ব পেয়েছে ডাক বিভাগের ডিজিটাল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস নগদ।
এর আগে ২০২০ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে প্রাথমিক পর্যায়ের দেড় কোটি শিক্ষার্থীর উপবৃত্তি ও শিক্ষা উপকরণ কেনার ভাতা বিতরণের দায়িত্ব পায় নগদ। এরপর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুসারে শিক্ষার্থীদের মায়ের জাতীয় পরিচয়পত্র, মোবাইল নম্বর এবং শিক্ষার্থীর নিবন্ধিত নাম দিয়ে একটি ডেটাবেজ তৈরি হয়। সেই ডেটাবেজ অনুসারেই নগদ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরের পুরো উপবৃত্তি ও ভাতা বিতরণ করেছে তারা।
এর আগে এই মন্ত্রণালয়ের সদ্য বিদায়ী সচিব হিসেবে গোলাম মো. হাসিবুল আলম যখন দায়িত্ব পালন করছিলেন, তখন নানা কারণে নগদ-এর বদলে অন্য অপারেটরকে ভাতা বিতরণের দায়িত্ব দিতে চেষ্টা করেছেন বলে জানা গেছে। তবে নগদ-এর মাধ্যমে সরকারি ভাতা বিতরণের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসনের কারণে শেষ পর্যন্ত তার পক্ষে এটি সম্ভব হয়নি, বলে জানিয়েছে একটি সূত্র।
বিশ্লেষকরা বলেন, কোনো একটি দেশের উন্নয়ন অনেকটাই নির্ভর করে সে দেশের দক্ষ আমলাতন্ত্রের ওপর। কিন্তু আমাদের দেশের আমলাতন্ত্রের দক্ষতার যে চিত্র আমরা দেখছি, দেশের উন্নয়নের জন্য তার কি আদৌ কোনো উপযোগিতা আছে? বরং অনেকেই যে বর্তমান আমলাতন্ত্রকে উন্নয়নের প্রধান বাধা হিসেবে উল্লেখ করেন, তা কি অযৌক্তিক? আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, অদক্ষতা, অসাধুতাসহ আরো অনেক বিষয় নিয়ে গণমাধ্যমসহ নানা মাধ্যমে প্রতিনিয়ত কথা হচ্ছে। কিন্তু কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না কেন? জানা যায়, প্রশাসনিক কাজে গতি সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায় একটি সচিব কমিটি গঠিত হয়েছে। কিন্তু এই কমিটি কি পারবে সঠিক কারণগুলো চিহ্নিত করে প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের গতিবৃদ্ধির পথ দেখাতে? আমরা উন্নয়নে সহায়ক প্রশাসন চাই, উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে- এমন প্রশাসন নয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪০৮
আপনার মতামত জানানঃ