সময়ের সাথে সাথে এখন সবকিছুই জুড়ে গেছে প্রযুক্তির সাথে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, অফিসের কার্যক্রমসহ সবই চলছে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে। ব্যতিক্রম নয়, মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাও। ব্যস্ততম নগরীর জীবনকে প্রযুক্তির মাধ্যমে স্বাচ্ছন্দ্যময় করতে কাজ করছে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো। বিশেষ করে করোনাকালে লকডাউনের সময়ে ঘরবন্দি মানুষের দ্বারে দ্বারে খাবার, ওষুধ, খাদ্যসামগ্রীসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পৌঁছে দিয়ে আস্থা অর্জন করেছে এই খাত। বিগত অর্ধযুগ ধরে ই-কমার্স যতটা প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল, করোনায় ছাড়িয়ে গেছে সেটাকেও। এছাড়া মানুষকে অভ্যস্ত করে তুলেছে অনলাইন কেনাকাটায়। এর সুফল পাচ্ছে ই-কমার্স খাত। গ্রাহক বৃদ্ধির পাশাপাশি নতুন নতুন প্রতিষ্ঠানও যুক্ত হচ্ছে অনলাইন ব্যবসায়।
করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হওয়ার পরিস্থিতিতে ২০২০ সালের প্রায় পুরোটা সময় অনেকেই অনলাইনে কেনাকাটা করেন। সেই সুবাদে তাদের একটা বড় অংশের মধ্যেই অনলাইনে কেনাকাটা করা এখন অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। বদৌলতে চালডাল, ফুডপান্ডা, দারাজ, আজকের ডিল, বিক্রয়ডটকমসহ বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে কেনাকাটা করলে পণ্যের দাম মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল তথা মোবাইল ফোনে আর্থিক সেবার (এমএফএস) মাধ্যমে পরিশোধ করা যায়। ফলে বাংলাদেশে ই-কমার্সের বাজার সম্ভাবনা বাড়ছে। বিশেষ করে কোভিডের সময়ে মানুষের চাহিদা পূরণ করতে পারায় এই খাতের যথেষ্ট বিকাশ ঘটেছে। এরই ধারাবাহিকতায় আগামী ২০২৩ সালের মধ্যে দেশে ই-কমার্স বাজারের আকার বেড়ে দাঁড়াবে ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার, যা বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী স্থানীয় মুদ্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকার মতো হবে (প্রতি ডলার ৮৬ টাকা ধরে)। এটি দেশের বর্তমান ই-কমার্স বাজারের তিন গুণ হবে। বর্তমান ই-কমার্স বাজারের আকার ১০০ কোটি ডলার বা সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এক প্রতিবেদনে দেশীয় ই-কমার্সের বাজারের এমন চিত্র উঠে এসেছে। কোভিডের সময় অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই) খাতের ওপর তৈরি করা এই প্রতিবেদন সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়েছে।
আগামী ২০২৩ সালের মধ্যে দেশে ই-কমার্স বাজারের আকার বেড়ে দাঁড়াবে ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার, যা বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী স্থানীয় মুদ্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকার মতো হবে (প্রতি ডলার ৮৬ টাকা ধরে)। এটি দেশের বর্তমান ই-কমার্স বাজারের তিন গুণ হবে।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে যেসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান তথ্যপ্রযুক্তি, বিশেষ করে মোবাইল ফোনে আর্থিক সেবার (এমএফএস) ব্যবহার বাড়িয়েছে, তারাই দ্রুত পুনরুদ্ধারের পথে গেছে। ভবিষ্যতে এই বিষয়ে বিশেষ নীতি গ্রহণের সুপারিশ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার মতো মহামারিকালে কিংবা হঠাৎ কোনো আঘাত বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ এলে ছোট কারখানা বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো যাতে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে টিকে থাকতে পারে, সে জন্য তাদের অর্থসহায়তা দিতে হবে। পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করতে হবে।
জানতে চাইলে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াহেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশে যে ই-কমার্সের বিশাল সম্ভাবনা আছে, তা করোনার মধ্যে প্রমাণ হয়েছে। করোনার সময়ে ২ লাখ নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে আরও ৩ লাখ কর্মসংস্থান হবে। স্থানীয় পর্যায়ে উদ্যোক্তা বাড়ছে। ফেসবুকেও উদ্যোক্তা বৃদ্ধি পাচ্ছে।’ তিনি জানান, করোনার আগের চেয়ে এখন পণ্য ডেলিভারি অন্তত পাঁচ গুণ বেড়েছে। এতে প্রমাণ হয়, এই খাতে ব্যবসায়িক সম্ভাবনা বেশ বেড়েছে।
এবার দেখা যাক, করোনার ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে কতটা উপকৃত হয়েছে। এডিবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ৩১ শতাংশ প্রতিষ্ঠান মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সেবা (এমএফএস) নিয়েছে। এমএফএস নেওয়া ৭৪ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের লেনদেন বেড়েছে। আর সার্বিকভাবে ৬০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের বিক্রি বেড়েছে। ডিজিটাল লেনদেন বা এমএফএস ব্যবহারকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর লোকসান পুষিয়ে নেওয়ার গতিও অন্য সাধারণ প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেশি হয়েছে।
এ জন্য এডিবি চার ধাপে সমীক্ষা করেছে। সর্বশেষ ধাপে ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চে ২১৬টি প্রতিষ্ঠানের পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার কতটা কাজে লেগেছে, তা নিয়ে সমীক্ষা করা হয়। সম্প্রতি চার ধাপের সমীক্ষার ফলাফল নিয়ে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে এডিবি।
এডিবি চারটি ধাপে এই সমীক্ষা পরিচালনা করেছে। করোনার শুরুর বছর ২০২০ সালের মার্চ-মে, জুন-সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর-ডিসেম্বর এবং ২০২১ সালের জানুয়ারি-মার্চে সমীক্ষা করা হয়। এতে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার কতটা কাজে লেগেছে, তা দেখা হয়।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০২০ সালের মার্চ-মে সময়ে করোনার আগের বেচাকেনার মাত্র ৪২ শতাংশ পুনরুদ্ধার হয়েছিল। এই হার ২০২১ সালের জানুয়ারি-মার্চে বেড়ে দাঁড়ায় ৭৭ শতাংশ। কিন্তু যেসব প্রতিষ্ঠান এমএফএস সেবা নিয়েছে, তাদের পুনরুদ্ধার আরও প্রায় ১০ শতাংশ বেশি, অর্থাৎ ৮৬ শতাংশ। এসব প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ও মুনাফা দুটোই তুলনামূলকভাবে বেশি বেড়েছে।
এডিবির প্রতিবেদনে বিভিন্ন গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে বাংলাদেশের ই-কমার্সের বাজার সম্পর্কে একটি ধারণা দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, বর্তমানে আড়াই হাজার ই-কমার্স সাইট আছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর মধ্যে ফেসবুক এখন অনলাইনভিত্তিক ব্যবসায়ের অপরিহার্য প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে। বর্তমানে দেশে ফেসবুকে প্রায় ৫০ হাজার বিজনেস পেজ আছে, যা ৩ কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারীর মাঝে ‘বুস্ট’ করে থাকে।
ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) হিসাবে, বিশেষ করে ২০২০ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর সময়ে বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতে বিপ্লব ঘটে গেছে। ওই সময়ে অনলাইনে বেচাকেনা ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ বেড়েছে।
বাংলাদেশে ই-কমার্স ব্যবসাটি নতুন। সম্ভবত ২০১০ সালের দিকে বাংলাদেশে চালু হয় ই-কমার্স এর ধারনা। এরপর থেকে বাংলাদেশে ই-কমার্স দিনের পর দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তবে বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের তুলনায় ই-কমার্সে বেশ পিছিয়ে। যেখানে উন্নত দেশগুলোর মানুষ অনলাইন শপিং-এর উপরেই বেশী নির্ভরশীল আর সেখানে আমরা সবেমাত্র অনলাইনে শপিং করা শুরু করেছি। তবে আশার কথা হল বাংলাদেশে কাজ করে যাচ্ছে বেশ কিছু ই-কমার্স সাইট এবং তরুণ উদ্যোক্তারা। আশা করা যায় আর কয়েক বছরের মাঝেই এসব তরুণ উদ্যোক্তাদের প্রচেষ্টা বাংলাদেশকে নিয়ে যাবে ই-কমার্স খাতে এক নতুন কোঠায়। পাশাপাশি এই খাতকে আরও উন্নত করতে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে এখন ই-কমার্স এক অপার সম্ভাবনাময় খাত। যা আমাদের কেনাকাটাকে করবে আরও গতিশীল, সাশ্রয়ী এবং সহজ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এই মার্কেট প্লেসে তরুণ উদ্যোগতাই বেশি। তরুণ উদ্যোক্তা বেশি হওয়ার কারণ যদি ধরি তাহলে প্রথমেই বলতে হবে এই ব্যবসায় ইনভেস্টমেন্ট কম এবং কম সময়ে বেশি লাভবান হওয়া সম্ভব।।অন্যদিকে একটা ই-কমার্স ওয়েবসাইট তৈরি করতে খুব বেশি অর্থও লাগে না। কারণ বর্তমানে অনেক কম খরচে একটি ই-কমার্স ওয়েবসাইট তৈরি করা সম্ভব। বাংলাদেশে অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যারা অনেক কম খরচে ই-কমার্স ওয়েবসাইট তৈরি করে থাকে। তাই খরচ ও সময় কম ব্যয় হওয়ায় এই ব্যবসার জন্য অনেকই এখন প্রস্তুতি গ্রহণ করছে।
তারা বলেন, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ই-কমার্সের মাধ্যমে শপিং করতে পারলেও এখনও মার্কেটে গিয়ে শপিং করার প্রবণতা থাকার কারণে ই-কমার্স ব্যবসায় প্রভাবিত হচ্ছে। তাই এজন্য সকলকে ই-কমার্সের সুবিধা জানাতে হবে। সেই প্রচেষ্টায় অবদান রাখতেও এগিয়ে এসেছে আমারসাজ ডটকম। বাংলাদেশে অনলাইন শপিং সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে তারা শুরু করেছেন ব্লগিং প্রতিযোগিতা। এছাড়াও অনলাইনে কেনাকাটা করতে সকলকে উৎসাহী করতে দেশের সবচেয়ে সেরা ই-কমার্স সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে আমারসাজ ডটকম । তাই ই-কমার্স খাত সচল করতে এগিয়ে আসতে হবে আমাদের সকলকে।
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোকে একটি যথাযথ নীতিমালার মধ্যে থেকে কাজ করতে বাধ্য করতে পারেনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। পরিকল্পনা আর নীতিমালার যথাযথ বাস্তবায়নের অভাবেই গ্রাহকদের অনেক ভোগান্তি হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ই-কমার্সে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো গ্রাহকের আস্থা। তা রক্ষা করা না গেলে তাতে দু-একটি প্রতিষ্ঠান নয়, গোটা শিল্পের ওপরই মানুষ আস্থা হারাবে। সে জন্য যেসব অভিযোগ আসছে, প্রশাসনিকভাবেই সেগুলো দ্রুত খতিয়ে দেখা দরকার। কেবল ভোক্তার স্বার্থেই নয়, বরং ই-কমার্স খাতের শৃঙ্খলা আনয়নে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। দু-একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য ই-কমার্স খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তা কারও কাম্য নয়। ভোক্তা যাতে প্রতারিত না হন, বাজারে যাতে প্রতিযোগিতা থাকে বা সব প্রতিষ্ঠানের জন্য সমান সুযোগ থাকে, সে জন্য এ খাতে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর বা যথাযথ পরিচালন নীতিমালার দ্রুত বাস্তবায়ন প্রয়োজন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৪৭
আপনার মতামত জানানঃ