মধ্যপ্রাচ্যের উপসাগরীয় দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাণিজ্যিক রাজধানী দুবাইয়ে অবৈধ ম্যাসাজ পার্লারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ২ হাজার ২৫ ব্যাক্তিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে দেশটির জাতীয় দৈনিক গালফ নিউজ।
সম্প্রতি দুবাইজুড়ে গড়ে ওঠা অবৈধ ম্যাসাজ পার্লার উচ্ছেদে অভিযান শুরু করেছে সেখানকার পুলিশ। দুবাই পুলিশের অপরাধ ও তদন্ত বিভাগের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জামাল আল জাল্লাফ গালফ নিউজকে এ প্রসঙ্গে জানান।
তিনি জানান, নগরের ২১৮টি ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে এই ২ হাজার ২৫ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ইতোমধ্যে শালীনতা ভঙ্গের দায়ে তাদের মধ্যে ১ হাজার ৬৪৩ জনের বিরুদ্ধে মামলাও করেছে দুবাই পুলিশ।
এই ম্যাসাজ পার্লারগুলো খদ্দের আকৃষ্ট করতে দালালদের মাধ্যমে কার্ড বিতরণ করে। কার্ডগুলোতে থাকে এক বা একাধিক ফোন নাম্বার। দুবাইয়ের সড়ক বা জনসমাগমপূর্ণ স্থানগুলোতে দালালরা গাড়ির দরজায় এসব কার্ড গুঁজে দেন।
ম্যাসাজ নিতে আগ্রহীরা সেই কার্ডের নাম্বারে ফোন করে পার্লারের ঠিকানা জেনে সেখানে যান এবং সেবা নেন।
জামাল আল জাল্লাফ জানান, বিভিন্ন কার্ডে থাকা এ রকম ৩ হাজার ১১৪টি ফোনের সংযোগ ইতোমধ্যে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। এছাড়া কার্ড ছাপানো ও বিতরণে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে আরও ১৬৫ জনকে।
অবৈধ ম্যাসাজ পার্লারকে ‘অশ্লীলতার কেন্দ্র’ উল্লেখ করে দুবাইবাসীকে এসব পার্লার থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন ব্রিগেডিয়ার জাল্লাফ। যদি কোনো ব্যক্তি এই পরামর্শ না মানেন তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি।
পাশপাশি, অভিযান সফল করতে দুবাইবাসীকের সহযোগিতা করার আহ্বান জানিয়ে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘যদি কেউ আপনাকে এ ধরনের কোনো কার্ড দেয়, সেক্ষেত্রে যতদ্রুত সম্ভব ৯০১ নাম্বারে ফোন করে পুলিশকে তা জানান।’
দুবাইয়ে এ ধরণের ঘটনা নতুন নয়। গত বছর গ্ল্যামারাস আর ধনীদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় শহর দুবাইয়ে ১৫০০ বাংলাদেশি তরুণীর কথা জানা যায়। তাদের কেউ জেনে, না জেনে; আবার কেউ লোভ সামলাতে না পেরে এখানে এসেছেন। এসে দেখেন অন্ধকার জগৎ। না পারছেন সইতে, না পারছেন দেশে ফিরতে। বাধ্য হয়ে থেকে যাচ্ছেন অন্ধকার জগতে।
তাদের বয়স ২০ থেকে ২৫-এর মধ্যে। ‘মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান’ পরিবেশনের নামে বাংলাদেশি এসব মেয়েকে দুবাই আসতে প্রলুব্ধ করা হয়। দেওয়া হয় আর্থিক সচ্ছলতার স্বপ্ন। কিন্তু সেই স্বপ্ন ফিকে হতে বেশি সময় লাগে না। নাচের নামে তাদের কাজের সুযোগ হয় ড্যান্স বারে। কেউ কেউ সুযোগ পান ওয়েটার বারে অথবা ম্যাসাজ সেন্টারে। দিন শেষে তাদের ভাগ্যে নেমে আসে ভয়াল কালরাত।
দুবাইয়ে মেয়েদের নির্যাতন ও পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করানোর হয়। প্যারিস হোটেল, রয়্যাল টোন হোটেল, ক্ল্যারিস হোটেল এবং আবুধাবির মিনা হোটেলে মুজরা অনুষ্ঠিত হয়। দুবাইয়ের একটি বারের নাম ওয়েটার বার। ওয়েটার বার বলতে যেসব বারে ওয়েটার (পরিচারক) হিসেবে বাংলাদেশি তরুণীরা কাজ করেন। এসব বারে আলাদা কেবিন থাকে। পরিবেশ থাকে অন্ধকারাচ্ছন্ন। আগতরা এখানে খুব সহজেই তরুণীদের সান্নিধ্য পান।
দুবাইয়ে বাংলাদেশি তরুণীদের পাচারের অন্যতম কৌশল হচ্ছে বিউটিশিয়ান ভিসা। এক্ষেত্রেও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের হতদরিদ্র পরিবারের মেয়েদের বাছাই করা হয়। ‘উপজাতি’ মেয়েরা এ কাজে বেশি যান। দেশের অধিকাংশ বিউটি পার্লারে উপজাতি মেয়েরা বেশি চাকরি করেন। সেখান থেকে ‘বেশি অর্থ রোজগারের’ প্রলোভন দেখিয়ে তাদের টার্গেট করা হয়।
চেহারা ও শারীরিক গঠন প্রায় একই হওয়ায় চীনা ও কোরিয়ান পর্যটকরা এসব মেয়ের সঙ্গে সময় কাটাতে পছন্দ করেন। দুবাই নিয়ে তাদের প্রথমে বিউটি পার্লারে চাকরি দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে তাদের পার্লারের ঠিক পেছনে আলো-আঁধারের ম্যাসাজ সেন্টারে পাঠানো হয়। জোরপূর্বক তাদের অনৈতিক কাজে বাধ্য করেন মালিকরা। দুবাইয়ের অধিকাংশ ম্যাসাজ পার্লারের মালিক বাংলাদেশি ও ভারতীয়রা। এভাবেই দুবাইয়ে চলছে রমরমা অশ্লীলতা।
এসব ম্যাসাজ পার্লার সম্পর্কে জানতে চাইলে দীর্ঘ আট বছর দুবাইয়ের সোনাপুরে ব্যবসা করা এক বাংলাদেশি বলেন, ‘এখানে বাংলাদেশি মেয়েদের পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা হয়। আমি ভেতরে কয়েকবার গিয়েছি। ভেতরে ঢুকতেই ৮-১০ জন মেয়ে দাঁড়িয়ে যায়, কাছেও আসে। একজনকে বেছে নেওয়ার পর তার সঙ্গে ৩০ মিনিট সময় কাটানো যায়। তবে ২০ মিনিট পার হলেই ব্রোকাররা (দালাল) বাইরে থেকে দরজা খট খট করতে থাকেন।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশি এক ব্রোকার বলেন, এসব মেয়ে ডাউনটাউন দুবাই এলাকার বিভিন্ন ফ্ল্যাটে থাকেন। কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে তাদের রাখা হয়। সিকিউরিটি গার্ডও থাকে। প্রতিদিন সকাল ১০-১১টার দিকে কয়েকটি মাইক্রোবাসে করে তাদের এসব পার্লারে আনা হয়। রাত ১১টার দিকে মালিকরা নিজেদের মাইক্রোবাসে করে তাদের ফ্ল্যাটে রেখে আসেন।
কেউ কেউ নির্যাতনের পর বারে বা পার্লারে কাজ করতে অনাগ্রহ দেখান। তখন তাদের ঘরে আটকে রাখা হয়। সেখানে থেকে বিগো লাইভের মতো বিভিন্ন ভিডিও চ্যাটিং অ্যাপে মধ্যবিত্ত প্রবাসীদের মনোরঞ্জনে বাধ্য করা হয়। এর মাধ্যমেও মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেন মালিকরা।
এসডব্লিউ/এসএস/১২৪৫
আপনার মতামত জানানঃ