বিশ্বের ইতিহাস বারবারই হিংসা আর বিদ্বেষের ইতিহাস; যুদ্ধের ইতিহাস। গেল ১৯ শতকেই বিশ্ব মুখোমুখি হয়েছে দুইটি বিশ্বযুদ্ধের। ১৯১৪ সালের প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আজও দাগ কেটে আছে পৃথিবীর বুকে। চার বছর ধরে চলা এই যুদ্ধের প্রভাব পড়েছিল পৃথিবীর আনাচে কানাচে থাকা সবখানেই।
এই মহাযুদ্ধে প্রায় ১৮৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রত্যক্ষ ও ১৫১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পরোক্ষ খরচ হয়। যা ইতিপূর্বে ঘটিত যেকোনো যুদ্ধব্যয়ের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ৯০ লাখ যোদ্ধা ও ১ কোটি ২০ লাখ নিরীহ মানুষ নিহত হয়।
প্রায় এককোটি সৈন্য এবং ২ কোটি ১০ লাখ সাধারণ মানুষ আহত হয়, এদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ছিল এক লাখ ষোল হাজার পাঁচশত ষোল জন। চারটি সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। রোমানভ সাম্রাজ্য বা রুশ সাম্রাজ্য ১৯১৭ সালে, জার্মান ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্য ১৯১৮ সালে এবং উসমানীয় সাম্রাজ্য ১৯২২ সালে।
অস্ট্রিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, এস্তোনিয়া, হাঙ্গেরি, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া এবং তুরস্ক স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠে। উসমানীয় সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা অধিকাংশ আরব এলাকা ব্রিটিশ ও ফরাসি সাম্রাজ্যের অধীনে আসে।
১৯১৭ সালে বলশেভিকরা রাশিয়ার এবং ১৯২২ সালে ফ্যাসিবাদীরা ইতালির ক্ষমতায় আরোহণ করে। এ যুদ্ধের অন্য ফল হলো ইনফ্লুয়েঞ্জায় বিশ্বব্যাপী ৫ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়।
এর মধ্যে ১৯১৬ সালের ১ জুলাই দিনটা যেন সমস্ত বিভীষিকাকে হারিয়ে দেয়। সে এক ঐতিহাসিক যুদ্ধের সময়। তারিখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তখন সমস্ত ইউরোপের আকাশ ধোঁয়ায় ভরিয়ে রেখেছে।
ঠিক এমন সময়েই জার্মান বাহিনীর বিরুদ্ধে চরম আক্রমণের প্রস্তুতি নিলেন ব্রিটেনের জেনারেল ডগলাস হেইগ। কিন্তু ইতিহাস তো সবসময় মানুষের পরিকল্পনা অনুযায়ী চলে না। সেদিনও তা হয়নি। প্রথম দিনেই জার্মান বাহিনীর প্রতিরোধে প্রায় ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল ব্রিটিশ বাহিনী।
সেদিন যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ হারিয়েছিলেন ১৯ হাজার সৈনিক। আহত হয়েছিলেন ৫৭ হাজারের বেশি।
তবে সেদিনই যুদ্ধের শেষ হল না। ডগলাসের অনুরোধে এবার এগিয়ে এল ফরাসি বাহিনীও। দুই দেশের মিলিত বাহিনী সমে নদী অতিক্রম করল ঠিকই। কিন্তু বেশিদূর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হল না। জার্মান বাহিনীও সমস্ত শক্তি দিয়ে আক্রমণ প্রতিরোধ করে চলেছে।
অন্যদিকে ব্রিটেনের বুকে ডগলাসের এই খামখেয়ালি সিদ্ধান্ত নিয়ে অসন্তোষ জমা হচ্ছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। বিশেষ করে নিহত সৈনিকদের পরিবাররা অবিলম্বে যুদ্ধের সমাপ্তি চাইলেন।
ডগলাসকে এই সিদ্ধান্তের কারণ দেখাতে বলা হল রাষ্ট্রের তরফ থেকে। ওদিকে প্রতিদিন হাজারে হাজারে সৈনিক প্রাণ হারাচ্ছেন যুদ্ধক্ষেত্রে।
মোট ১৪১ দিন, অর্থাৎ প্রায় পাঁচ মাস ধরে চলেছিল যুদ্ধ। ১৮ নভেম্বর অবশেষে সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ডগলাস হেইগ। ততদিনে যে বিরাট সংখ্যক সৈনিক আহত ও নিহত হয়েছেন, তাতে ইতিমধ্যে সভ্যতার ইতিহাসে অন্যতম বিধ্বংসী যুদ্ধের তালিকায় নাম তুলে নিয়েছে ব্যাটল অফ সমে।
সব মিলিয়ে আহত হলেন ৩০ লক্ষ সৈনিক। প্রাণ হারালেন ১০ লক্ষ। ব্রিটিশ বাহিনীর ৪ লক্ষ ২০ হাজার সৈনিক প্রাণ হারিয়েছেন। জার্মানির বাহিনীতে নিহতের সংখ্যা ৪ লক্ষ ৫০ হাজারের বেশি।
যদিও ব্রিটিশ সেনাকর্তাদেরই নিজ দেশে সবচেয়ে বেশি সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। ১৮ নভেম্বর খাতায়-কলমে যুদ্ধ শেষ হলেও আরও প্রায় ১ বছর যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিল ফ্রান্স।
শেষ পর্যন্ত জার্মান বাহিনীর সমস্ত শক্তি তছনছ করে দেওয়া হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অন্তিম ফলাফল ঠিক করে দিয়েছিল সমে উপত্যকার যুদ্ধই।
তবে এর পর এমন খামখেয়ালি যুদ্ধের পরিকল্পনা আর কোনোদিন নেয়নি ব্রিটিশ বাহিনী। ইতিহাসেও এমন যুদ্ধ ঘটেনি আর কোনোদিন।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮৫০
আপনার মতামত জানানঃ