প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে বদলে যাচ্ছে মানুষের যৌন আচরণ। সেই সঙ্গে যৌনতায় অংশ নেয়ার হার কমে যাওয়া নিয়ে শঙ্কিত বিশেষজ্ঞরা। যৌনতার সঙ্গে সুস্বাস্থ্য, আনন্দের পাশাপাশি প্রজননের বিষয়টিও সরাসরি জড়িত। তবে সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, যৌনতার হার উদ্বেগজনক মাত্রায় কমছে।
যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৯ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত করা গবেষণায় মানব সঙ্গীর মাঝে সব ধরনের যৌনতার পরিমাণ কমার প্রমাণ মিলেছে। এমনকি কিশোর-কিশোরীর মাঝে স্ব-মৈথুনের প্রবণতা কমছে।
আর্কাইভস অফ সেক্সুয়াল বিহেভিয়রে গত বছরের ১৯ নভেম্বর গবেষণাটি প্রকাশিত হয়। গবেষকদের দাবি, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে স্ব-মৈথুন বা সঙ্গীর সঙ্গে যৌনতায় অংশ নেয়নি এমন কিশোর-কিশোরীর সংখ্যা বেড়েছে।
এই হার ছেলেদের ক্ষেত্রে ২৮.৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪৪.২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আর মেয়েদের ক্ষেত্রে ৪৯.৫ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৪ শতাংশে।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সার্ভে অফ সেক্সুয়াল হেলথ অ্যান্ড বিহেভিয়রে স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণকারীদের দেয়া তথ্য ব্যবহার করেছেন গবেষকেরা।
তারা ২০০৯ সালে ৪ হাজার ১৫৫ জন ও ২০১৮ সালে ৪ হাজার ৫৪৭ জনের তথ্য পর্যালোচনা করেছেন। নাম ও পরিচয় গোপন রেখে করা এ জরিপে অংশগ্রহণকারীদের বয়স ছিল ১৪ থেকে ৪৯ বছর।
গবেষণায় অবশ্য যৌনতার হার কমে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো ধারণা দেয়া হয়নি। বিষয়টি নিয়ে গবেষক দলের অন্যতম দুই সদস্য ডেবি হারবেনিক ও সুং-চিয়ে (জেন) ফু-এর সঙ্গে কথা বলেছে যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞান সাময়িকী সায়েন্টিফিক আমেরিকান।
অধ্যাপক হারবেনিক ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ পাবলিক হেলথ-ব্লুমিংটনের শিক্ষক এবং ফু একই প্রতিষ্ঠানের গবেষণা সহযোগী।
যৌনতার হার কমে যাওয়ার কারণ
বিশ্বের অন্যান্য জায়গার গবেষণাতেও দেখা গেছে, মানুষের যৌনতার মাত্রা কমছে। এ পরিস্থিতিতে নিজেদের গবেষণা নিয়ে হারবেনিক বলেন, আমাদের গবেষণাতেও একই ধারা লক্ষ্য করা গেছে। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন গবেষণার ধারাকে আমাদের গবেষণাটি আরও বিস্তৃত করেছে।
জেন এবং আমাদের দল বিস্তারিতভাবে মানুষের যৌন আচরণকে বিশ্লেষণ করতে পেরেছে। আমরা সঙ্গম, মাস্টারবেশন ও ওরাল সেক্সের ক্ষেত্রগুলো দেখেছি। সব ক্যাটাগরিতেই যৌনতার মাত্রা কমেছে।
আমাদের গবেষণায় কিশোর-কিশোরীরাও অংশ নিয়েছে। তাদের মাঝে মাস্টারবেশনের হার কমে যাওয়াটা অবাক করার মতো। আমরাই প্রথম এ বিষয়টিকে অন্তর্ভুক্ত করেছি। একে আরও গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া উচিত।
তরুণদের মাঝে যৌনতার হার কমে যাওয়ার কারণ প্রসঙ্গে ফু বলেন, এর উত্তর জানতে হলে আরও গবেষণা করতে হবে। তবে কম্পিউটার গেমস, সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার বৃদ্ধি, ভিডিও গেম তরুণদের যৌনতার সময়টুকু নিয়ে নিচ্ছে। ২০০৯ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের সোশ্যাল মিডিয়া এসেছে। তরুণদের জন্য বিষয়টি ক্রমাগত বিবর্তিত হচ্ছে।
হারবেনিক জানান, যৌনতার হার কমে যাওয়ার পেছনে নির্দিষ্ট একটি কোনো ব্যাখ্যা বা কারণ দায়ী বলে আমরা মনে করছি না। ভিন্ন ভিন্ন বয়স, লিঙ্গ, সঙ্গীর জন্য ভিন্ন ভিন্ন কারণ রয়েছে, এমনটাই আমাদের ধারণা। যৌনতার হার কেন কমে যাচ্ছে- তা সামগ্রিকভাবে বোঝার জন্য আলাদা করে ওই কারণগুলো ব্যাখ্যারও হয়ত খুব বেশি দরকার নেই।
অনেকেই নিজেদের অ্যাসেক্সুয়াল (যৌনতায় অনাগ্রহী) হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন, এটা যৌনতার হার কমে যাওয়ার কারণ হতে পারে কি না প্রসঙ্গে হারবেনিক জানান, আমরা জানি না কেনো অনেকে তাদের অ্যাসেক্সুয়াল হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন। তবে আমার মতে, অনেকেই এটিকে একটি ‘সঠিক লিঙ্গ পরিচয়’ হিসেবে মেনে নিচ্ছেন।
২০০৩ সালে যখন আমি মানব যৌনতা পড়ানো শুরু করি তখন আমার ক্লাসে একজন ছাত্র ছিলেন, যিনি নিজেকে অ্যাসেক্সুয়াল পরিচয় দিতেন। এখন সেখানে তিন থেকে চারজন আছে। বিষয়টি আমার কাছে চমকপ্রদ। তরুণরা নিজেদের প্রকাশ করার জন্য ভিন্ন ভিন্ন উপায় সম্বন্ধে এখন সচেতন- বিষয়টি আমার অত্যন্ত ভালো লাগে। তাদের অনেকের কাছেই মনে হয় তারা যৌনতা বিষয়টি থেকে দূরে থাকবেন।
রাফ সেক্স
‘রাফ সেক্স’ বিষয়ে হারবেনিক বলেন, ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে অনেকের মধ্যেই এই ‘রাফ সেক্স’-এর আচরণ বেড়েছে। এ বিষয়ে গবেষণা খুব বেশি হয়নি।
এখন হাজারও কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীর তথ্য বলছে, তারা একে অপরের গলা চেপে ধরছে বা শ্বাসরোধ করার চেষ্টা করছে। কলেজগামী ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে এ আচরণের আধিক্য বেশি।
অনেকের ক্ষেত্রে এটি সম্মতি নিয়েই ঘটছে এবং অনেকের সঙ্গীই এমনটা করতে বলেন। অনেকের জন্য আবার বিষয়টি উপভোগ্য হলেও ভীতিকর। এ বিষয়টি আমাদের গবেষণার বড় একটা অংশ। আমরা বোঝার চেষ্টা করছি তারা কেমন অনুভব করেন, স্বাস্থ্য ঝুঁকি কী এবং সার্বিকভাবে এমন আচরণ যৌনতার ক্ষেত্রে কোথায় অবস্থান করে।
ফু জানান, আমরা এ ধরনের আচরণে বড় পরিবর্তন দেখেছি। আমরা জানি না ঠিক কী কারণে অনেকেই নিজের যৌনতা থেকে মুক্তি চান। তবে আমরা জানতে পেরেছি, অনেকেই, বিশেষ করে কম বয়সীরা বিষয়টিকে ভয়ের চোখে দেখেন এবং তারা জানেন না কী ঘটতে চলেছে তাদের সঙ্গে।
তারা যৌনতায় সম্মতি দেন, কিন্তু শ্বাসরোধ করার মতো একটি বিষয় হয়ত তাদেরকে ধারণার বাইরে ঘটতে পারে। হেটারোসেক্সুয়াল (বিপরীতকামী) নন, এমন অনেকের ক্ষেত্রে এর বড় ধরনের লৈঙ্গিক প্রভাব দেখেছি, যেমন বাইসেক্সুয়াল (বিপরীত লিঙ্গ এবং সমলিঙ্গ দুইয়ের প্রতিই যৌন আকর্ষণ অনুভবকারী) নারীদের অনেকেই আগ্রাসী আচরণের শিকার হন।
হারবেনিক বলেন, আমরা আসলেই রহস্যটি বোঝার চেষ্টা করছি। আমাদের গবেষণা থেকে এখনও বোঝা যাচ্ছে না, আগ্রাসী যৌনতার বাড়তে থাকা হারের কতটুকু আকাঙ্ক্ষিত অথবা কতটুকু অনাকাঙ্ক্ষিত। এর কারণ হচ্ছে বাইসেক্সুয়াল নারীরাও উচ্চহারে যৌন সহিংসতার শিকার হন।
গবেষণায় দেখা গেছে, অনেকগুলো কারণ রয়েছে যার কারণে মানুষের যৌনতার আচরণ প্রকাশের ধরন পালটে গেছে।
হারবেনিক জানান, বিশ্বের নানা গবেষণায় বিষয়টিকে অর্থনৈতিক অবস্থাসহ নানা দিক থেকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা হয়েছে। আয় কম হলে যৌনতায় অনাগ্রহ বাড়ে। এক গবেষণায় সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হিসেবে তরুণদের কম্পিউটার গেমস খেলার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। অনেকেই যৌন-বিমুখতার সঙ্গে অ্যালকোহলের যোগাযোগ খোঁজার চেষ্টা করছেন। আমরা জানি, অ্যালকোহল নিষ্ক্রিয়তার সঙ্গে সম্পর্কিত।
আমরা সেক্স টয় ব্যবহার বৃদ্ধি পেতে দেখেছি, যদিও সেটি অনেক বেশি মাত্রায় নয়। যে পরিবর্তন দেখা গেছে তা হয়ত যৌন বিমুখতার একটা কারণ, তবে আমি একে পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা হিসেবে গ্রহণ করি না।
আমাদের কী করা উচিত?
এক্ষেত্রে পরামর্শ হিসেবে ফু বলেন, মা-বাবার উচিত যৌনতা নিয়ে সন্তানের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলা, বিশেষ করে টিনএজারদের সঙ্গে। নতুন যৌন আচরণ বা প্রযুক্তির কারণে এখন যৌনতার ধারণা অনেকটাই পালটে গেছে। আমরা আশা করি, মা-বাবারা তাদের সন্তানদের সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারবেন।
বাবা-মা শুধু যে তাদের সন্তানদের বিভিন্ন যৌন আচরণের ঝুঁকি সম্পর্কে সতর্ক করবেন তা নয় বরং কীভাবে অর্থপূর্ণ সম্পর্ক ও তা থেকে আনন্দদায়ক যৌনতা উপভোগ করতে হয় সে সম্পর্কে শিক্ষা দিতে পারেন।
হারবেনিক জানান, আমাদের অনেকেরই কিছু বিষয় নিয়ে প্রশ্ন থাকা উচিত, যেমন: আমার যৌন জীবন নিয়ে আমি কী ভাবছি? আমার সঙ্গী কী ভাবছে- এগুলো নিজেকে জিজ্ঞেস করা উচিত।
অনেকে চারপাশ ভেবে বলবেন, তাদের যৌন সম্পর্কগুলো আনন্দদায়ক, উপভোগ্য এবং তাদের যৌনজীবন সন্তোষজনক। অনেকে বলবেন, ১০-১৫ বছর আগে যখন এতগুলো মজার টিভি শো ছিল না, অনেক কম টিভি দেখতাম তখন অনেক বেশি যৌনতা ছিল।
‘যৌন স্বাস্থ্য’ প্রকৃতপক্ষে কেমন হওয়া উচিত- সে সম্পর্কে হারবেনিক বলেন, যৌনতা জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মানব অভিজ্ঞতা কীভাবে বদলে যাচ্ছে তা বুঝতে হলে যৌনতার পরিবর্তনও আমাদের বুঝতে হবে।
আমরা জানি, যৌন কার্যকলাপ মানুষকে প্রশান্তি দিতে পারে। এটি ঘুমিয়ে পড়তে, মানসিক চাপ কমাতে, ঘনিষ্ঠ বোধ করতে ও সম্পর্ক উন্নত করতে সাহায্য করে। অনেক ক্ষেত্রে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতেও সাহায্য করে।
যৌন স্বাস্থ্য বহুমাত্রিক, এটি কেবল সংক্রমণ বা রোগের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি সম্পর্কিত বিষয় নয়। আনন্দের সম্ভাবনা, যৌনতা সম্পর্কে সঠিক তথ্যের সহজলভ্যতা, শারীরিক নিয়ন্ত্রণ এবং সহিংসতা বা জবরদস্তি থেকে মুক্ত যৌন অভিজ্ঞতা অর্জনও যৌন স্বাস্থ্যের অন্তর্গত।
মহামারির প্রভাব
এ আচরণগুলোর ওপর করোনা মহামারির কোনো ধরনের প্রভাব পড়তে পারে কি না সে প্রসঙ্গে ফু জানান, আমরা জানি, মানুষ ঘরে থাকলে অনেক কিছুই বদলে যায়। ওয়ার্ক ফ্রম হোমের কারণে সঙ্গীদের আগের চেয়ে বেশি সময় কাটানোর সুযোগ করে দিয়েছে বা একসঙ্গে থাকার সুযোগ দিয়েছে।
তবে যারা একসঙ্গে থাকেন না এবং যাদের বাসা থেকে কাজ করার সুযোগ নেই, চলাচলের অসুবিধা রয়েছে তারা হয়তো একসঙ্গে কম সময় কাটিয়েছেন।
আবার সঙ্গীর সঙ্গে বাড়িতে বেশি সময় কাটানো মানেই যে অনেক বেশি আনন্দদায়ক যৌনতা- বিষয়টি সে রকমও নয়। কোয়ারেন্টিনে থাকা, সামাজিক দূরত্ব, আর্থিক অসুবিধা, বাড়িতে থেকে কাজ করা- সবই সম্পর্কের টানাপড়েনের কারণ হতে পারে। মহামারির কারণে শিশুদের যত্ন কমে যাওয়া বা অস্থিরতা মা-বাবার যৌন জীবনকে সীমাবদ্ধ করতে পারে।
হারবেনিক বলেন, যারা সঙ্গীদের সঙ্গে বসবাস করেন না, তাদের যৌন সম্পর্ক গত দুই বছরে বেশি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তবে টিকা ও বুস্টার ডোজের সহজলভ্যতার কারণে এখন পরিস্থিতি কিছুটা সহজ হয়েছে।
আমরা তো দিনশেষে শূন্যে বসবাস করি না, আমাদের যৌন জীবনও শূন্য থেকে আসে না। যে কারণে এতে অসংখ্য দিক রয়েছে। গত দুই বছরে কোভিডে যারা আপনজনকে হারিয়েছেন তাদের জন্য সময়টি ছিল শোকের।
অনেকে কোভিড আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছেন, অনেকে চাকরি হারিয়েছেন ও অনেকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। মহামারি শুরুর পর থেকে সব বয়সী মানুষ অনেক বেশি উদ্বেগ ও বিষণ্ণতায় ভুগছেন। এ সব কিছুই যৌন চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষার ওপর প্রভাব ফেলেছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭১৫
আপনার মতামত জানানঃ