মেক্সিকোয় গণমাধ্যমকর্মী হত্যা যেন থামছেই না। মেক্সিকোর দক্ষিণের রাজ্য ওক্সাকাতে হিবার লোপেজ নামে এক সাংবাদিককে নিজ কার্যালয়ে গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। এ নিয়ে চলতি বছরে উত্তর আমেরিকার দেশটিতে এ পর্যন্ত ৫ গণমাধ্যমকর্মী হত্যার শিকার হলেন।
ওক্সাকার প্রসিকিউটর আর্তোরো পেইমবার্ট কেলভো মেক্সিকোর মিলেনিও টিভিকে জানিয়েছেন, অনলাইন বার্তা সংস্থা নোটিসিয়াস ওয়েবের পরিচালক বৃহস্পতিবার নিজ কার্যালয়ে কাজে নিমগ্ন ছিলেন। এমন সময় একদল দুর্বৃত্ত এসে তাকে গুলি করে হত্যা করে। নোটিসিয়াস ওয়েবের কার্যালয়টি ওক্সাকার বন্দরনগরী সেলিনা ক্রুজে অবস্থিত।
চলতি বছর জানুয়ারিতে চার জন সাংবাদিককে হত্যা করার পর গণমাধ্যমকর্মীদের নিরাপত্তা জোরদার করার দাবি যখন জোরালো হচ্ছে, তার মধ্যেই এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটল বলে জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান, বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
আর্তোরো পেইমবার্ট কেলভো বলেন, কারা এই দুর্বৃত্ত তা পুলিশ এখনও নিশ্চিত করতে পারেনি। তবে সন্দেহভাজন দুজনকে আটক করে তারা হাজতে রেখেছে।
স্থানীয় কিছু সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, হিবার লোপেজ বন্দর শহর সালিনা ক্রুজে কাজ করতেন। ২০১৯ সালে তিনি হত্যার হুমকি পেয়েছিলেন। পেশায় স্বাধীন এ সাংবাদিক স্থানীয় সরকারের রাজনীতি ও দুর্নীতি নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি করতেন।
মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেস ম্যানুয়েল লোপেজ ওব্রাডোর নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের খবর সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর তিনি সংবাদমাধ্যমের প্রতি উষ্মা প্রকাশ করেছেন। তারপরই একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটছে। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর টিম কাইন এবং মার্কো রুবিও মেক্সিকোর সাংবাদিকদের সুরক্ষার জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন মেক্সিকোর প্রতি।
মেক্সিকোয় কয়েক সপ্তাহ ধরে একের পর এক সংবাদকর্মীকে হত্যা করা হচ্ছে। গত জানুয়ারিতেই দেশটিতে তিন সাংবাদিক ও এক মিডিয়াকর্মী নিহত হয়েছেন। গত সপ্তাহে হত্যা করা হয়েছে আরেক সাবেক সাংবাদিককে।
মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেস ম্যানুয়েল লোপেজ ওব্রাডোর নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের খবর সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর তিনি সংবাদমাধ্যমের প্রতি উষ্মা প্রকাশ করেছেন। তারপরই একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটছে।
গত ৩১ জানুয়ারি অনলাইন পোর্টাল মনিটর মিচোয়াকানের ভিডিও এডিটর রবার্তো টোলেডোকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। তিনি তখন জিটাকুয়ারোতে একটি সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
তার আগে তিজুয়ানা শহরের সীমান্তে লুডেস মালডোনাডো লোপেজকে নিজের গাড়িতে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। তাকেও গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল।
অপরাধবিষয়ক আলোকচিত্রী মার্গারিটো মার্টিনেজকে তার বাড়ির সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়।
১০ জানুয়ারি ভেরাক্রুজ প্রদেশের গালফ উপসাগরের তীরে গুলি করে হত্যা করা প্রতিবেদক হোসে লুইস গাম্বোয়াকে।
গত মঙ্গলবার মার্কিন সিনেটর টিম কেইন ও মার্কো রুবিও মেক্সিকো সরকারের প্রতি সাংবাদিকদের সুরক্ষায় আরও বেশি কিছু করতে আহ্বান জানিয়েছেন। সমালোচকদের প্রতি মেক্সিকান প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেস ম্যানুয়েল লোপেজ ওব্রাদরের আক্রমণাত্মক মনোভাবেরও সমালোচনা করেছেন তারা।
২০০০ সালের পর মেক্সিকোতে শতাধিক সাংবাদিককে হত্যা করা হয়। দেশটির মাদককারবারীরা প্রায়ই সাংবাদিকদের হত্যা করে। সাংবাদিকরা খবর প্রকাশ করতে যেন ভয় পায় সে জন্যই এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটায় অপরাধীরা। ২০২২ সাল দেশটিতে সাংবাদিকদের অবস্থা আরও ভয়াবহ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের সেক্রেটারি জেনারেল ক্রিস্টোফি ডিলোরি জানান, ‘বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকদের উপর সহিংসতা বেড়েছে। কেউ কেউ ভাবতে পারেন যে সাংবাদিকরা কেবল তাদের পেশাগত ঝুঁকির শিকার। কিন্তু দেখা গেছে, সংবেদনশীল বিষয়গুলো অনুসন্ধান বা রিপোর্ট করতে গিয়েই সাংবাদিকরা দিন দিন লক্ষ্যবস্তু হচ্ছেন। যে কারণে তাদেরকে আক্রমণ করা হচ্ছে অর্থাৎ রিপোর্ট করা, জনগণকে জানানো- এই অধিকার তাদের আছে, এটা সবারই অধিকার।’
অনেক দেশেই দুর্নীতি, পাচার, মানবাধিকার লঙ্ঘন কিংবা পরিবেশ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অনুসন্ধানে গিয়ে সাংবাদিকদের জীবন ঝুঁকিতে পড়ছে। এছাড়া, অপহরণ, নির্যাতন, ডিজিটাল ও অন্যান্য মাধ্যমে গুজব রটানোসহ নানা হয়রানিতে পড়তে হচ্ছে সাংবাদিকদের। নারী সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে অনলাইন সহিংসতার মাত্রা বেশি বলেও জানিয়েছে জাতিসংঘ।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, সাংবাদিকরা আরও অগুনিত হুমকির মুখোমুখি হচ্ছেন। যেমন—অপহরণ, নির্যাতন ও গুম থেকে শুরু করে গুজব রটানো ও হয়রানি, বিশেষত ডিজিটাল মাধ্যমে, অনেক ধরনের ঝুঁকি মোকাবিলা করতে হচ্ছে। নারী সাংবাদিকরা বিশেষত অনলাইন সহিংসতার ঝুঁকিতে বেশি।
তিনি বলেন, সমাজের ওপর সামগ্রিকভাবে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অপরাধের ব্যাপক প্রভাব পড়ে। কারণ তারা তথ্যপ্রাপ্তির মাধ্যমে মানুষকে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সহযোগিতা করেন। কোভিড-১৯ মহামারি এবং ভুল তথ্যের ছায়া মহামারি দেখিয়ে দিয়েছে যে সঠিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য সত্যিকার অর্থেই জীবন-মৃত্যুর পার্থক্য গড়ে দিতে পারে। তথ্যপ্রাপ্তি যখন হুমকিতে পড়ে, তখন তা এমন বার্তা পাঠায়, যা গণতন্ত্র ও আইনের শাসনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, কোনও রাষ্ট্র যদি নিজেকে গণতান্ত্রিক দাবি করে, তবে সেখানে গণমাধ্যমের একশভাগ স্বাধীনতা থাকতেই হবে। যে গণমাধ্যম সরকারের সমালোচনা করবে, সেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আবার সেই সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে। জনসাধারণের কথাই উঠে আসে গণমাধ্যমে। তাই এই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত না করতে পারলে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০২০
আপনার মতামত জানানঃ