পৃথিবীতে আজ থেকে প্রায় ৩৮০ কোটি বছর আগে জীবনের উদ্ভব। কিন্তু আধুনিক মানব-সদৃশ জীব তথা হোমিনিডদের আবির্ভাব ঘটে আজ থেকে প্রায় ৭০ লক্ষ বছর আগে। তারা প্রাইমেট বর্গীয় জীবদের মত গাছের উপরে বসবাস করত। ফসিল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে আজ থেকে প্রায় ৪০ লক্ষ বছর আগে আফ্রিকা মহাদেশে অস্ট্রালোপিথেকাস জাতীয় প্রাণীরা বাস করত। অস্ট্রালোপিথেকাস অর্থ দক্ষিণাঞ্চলীয় এপ।
১৯৭৪ সালে ইথিওপিয়াতে ৩০ লক্ষ বছরের পুরনো একটি অস্ট্রালোপিথেকাস প্রাণীর ফসিলের সন্ধান পাওয়া যায়, যার নাম লুসি। অস্ট্রালোপিথেকাসরা মাটিতে দুই পায়ে হাঁটতে পারত। এরপর আজ থেকে ২৫ থেকে ১৫ লক্ষ বছর আগে আফ্রিকাতে হোমো হাবিলিস নামের প্রাণীর আবির্ভাব ঘটে, যাদেরকে প্রথম যথার্থ মানব হিসেবে গণ্য করা যায়। তাদের মস্তিষ্ক বড় ছিল এবং তারাই প্রথম লাঠি ও পাথর দিয়ে বানানো হাতিয়ার ব্যবহার করা শুরু করে।
এর ১০ লক্ষ বছর পরে, অর্থাৎ আজ থেকে ১৫ লক্ষ বছর আগে হোমো ইরেক্টাস নামক আরেকটি মানব প্রজাতির আবির্ভাব ঘটে। এই প্রজাতিটিই প্রথম আফ্রিকা মহাদেশ থেকে ইউরোপ ও এশিয়া মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। তাদের হাতিয়ার ও সরঞ্জামগুলি উন্নততর ছিল যা দিয়ে তারা শিকার করত, তারা আশ্রয়স্থল বানাতে পারত এবং আগুনের ব্যবহার জানত। এই হোমিনিডগুলি থেকেই ধীরে ধীরে বিবর্তনের মাধ্যমে আধুনিক মানব বা হোমো স্যাপিয়েন্স নামক প্রজাতির আবির্ভাব ঘটে।
একটা সময়ে বনভূমিই দুর্যোগের কারণ হয়ে উঠেছিল। তখন পৃথিবীর সিংহভাগ ভূমিই ছিল বন জঙ্গলে ঢাকা। কিন্তু বনানীর এ প্রাচুর্যই জন্ম দিয়েছিল এক ভয়াবহ ঘটনার। ১২ হাজার ৮০০ বছর আগের ওই সময়ে পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়েছিল এক মহা-দাবানল। হঠাৎ লাগা এই অগ্নিঝড় ছিল সর্বগ্রাসী।।
উল্কাপিণ্ডের আঘাতে ডাইনোসরদের যুগেও দাবানল সৃষ্টি হয়েছিল; যা তাদের বিলুপ্তির অন্যতম কারণ। কিন্তু, প্রায় ১৩ হাজার বছর আগের মহা-দাবানলের কাছে পূর্ববর্তী ডাইনোসর যুগের অগ্নিকাণ্ড যেন শিশু।
আগুন যখন লাগে পৃথিবী তখন এক লাখ বছরব্যাপী বরফযুগের গ্রাস থেকে কেবল মুক্তি পেয়েছিল। বরফগলা ভূমিতে জন্ম নিয়েছিল সবুজের মহাসমারোহ। নতুন প্রাণবৈচিত্র্যে ভরপুর ছিল মহারণ্যগুলো।
এরপর আগুন লাগা মাত্রই পুড়ে ছাই হয় বিপুল বনরাজি। ধোঁয়ার কুণ্ডলী বায়ুমণ্ডলকে ঢেকে দেওয়ায় প্রায় হাজার বছর সুর্যালোকের অভাব দেখা যায়। নেমে আসে চিররাত্রির মতো অন্ধকার।
এ ঘটনা প্রমাণ করে আগুনের প্রভাব কোনো অংশে মহাপ্রলয়ের চেয়ে কম কিছু ছিল না। আরও প্রমাণ করে, মানবজাতি এরপরও টিকে গিয়েছে কোনোভাবে। তবে বিপদ শুধু সেখানেই শেষ হয়নি।
আগুনের কারণে ধোঁয়াচ্ছন্ন বায়ুমণ্ডল এক খুদে হিমযুগের জন্ম দেয়—যা পৃথিবীকে আরও হাজার বছর তীব্র শীতের চাদরে মুড়ে রাখে।
ইউনিভার্সিটি অব ক্যানসাসের বিশেষজ্ঞ অ্যাড্রিয়ান মেলট বলেন, আমাদের তাত্ত্বিক অনুমান, বড় একটি ধূমকেতু পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ টানে খণ্ডিত হয়ে যায় এবং বড় কিছু টুকরো পৃথিবীতে আছড়ে পরে।
প্রসঙ্গত, ওই আগুনের জন্য দায়ী ধূমকেতু, এর জ্বলন্ত খণ্ডগুলি প্রায় ১০০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
২০১৮ সালে এ ঘটনা নিয়ে লিখিত একটি গবেষণা নিবন্ধের সহ-লেখক হলেন মেলট। তিনি বলেছেন, কার্বন ডাই-অক্সাইড, নাইট্রেট, অ্যামোনিয়া ও অন্যান্য রাসায়নিকের বিশ্লেষণ প্রমাণ করে ধূমকেতু খণ্ডের আঘাতে পৃথিবীর মোট ভূমির ১০ শতাংশ বা ১ কোটি বর্গকিলোমিটার এলাকায় আগুন লেগে যায়।
উদ্বাহু ওই অগ্নিকাণ্ড সম্পর্কে জানতে ২৪ জন বিজ্ঞানীর দল বিশ্বের ১৭০টি স্থানের ভূযৌগিক রসায়ন ও আণবিক গড়ন বিশ্লেষণ করেছেন। মেলটও ছিলেন সে দলে।
বিশ্লেষণের আরেকটি উৎস ছিল উদ্ভিদের পরাগায়ন। এতে আকস্মিকভাবে বিশাল অঞ্চলের পাইন বন হঠাৎ পুড়ে সেখানে পপলার গাছের বন সৃষ্টির বিষয়টি উঠে আসে।
পপলার যেহেতু বিরান ভূমিতে সহজে জন্মায়- তাই এমন বন সৃষ্টির ঘটনাও ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অগ্নিকাণ্ডের ইঙ্গিতবহ।
১৩ হাজার বছর পরও আগুনের জন্য দায়ী প্রকাণ্ড ধূমকেতুটির খণ্ডিত অংশ সৌর জগতে ভেসে বেড়াচ্ছে বলেও ধারণা করছেন বিজ্ঞানীরা।
ধূমকেতু ও উল্কাপিণ্ডে বিজ্ঞানীরা এর আগে প্ল্যাটিনাম ধাতুর উচ্চ ঘনত্ব লক্ষ করেছেন, হিমবাহে আটকা ১৩ হাজার বছর আগের বাতাসেও পাওয়া গেছে প্ল্যাটিনাম সমৃদ্ধ ধূলিকণার উপস্থিতি।
একইসাথে, তারা বিপুল পরিমাণ জৈবিক উপাদান পুড়ে যাওয়ার প্রমাণ হিসেবে ধুম্রকণার উপাদান- অ্যামোনিয়াম, নাইট্রেট ইত্যাদি পেয়েছেন।
বিজ্ঞানীরা জানান, আগুনের পর ঠাণ্ডা আবহাওয়ার কারণে হিমবাহগুলো আবার পৃথিবীর বিপুল ভূমিকে আচ্ছাদিত করে। ওই সময়ের মানুষকে এসব দুঃসহ পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে বাঁচতে শিখতে হয়েছিল। তবে কমে যায় জনসংখ্যা।
মেলট বলেন, কম্পিউটার সিম্যুলেশন ইঙ্গিত দিচ্ছে এ ঘটনায় বায়ুমণ্ডলের ওজন স্তরও ক্ষয়ে যায়। ফলে ত্বকের ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগব্যাধী অনেকগুণ বেড়ে যায়।
বিজ্ঞানীদের তত্ত্ব অনুসারে, ধূমকেতুর আঘাত ও তার ফলে সৃষ্ট অগ্নিঝড়ই ছিল ‘ইয়ঙ্গার ড্রাইস পিরিয়ড’ বলে পরিচিত একটি যুগের জন্য দায়ী। পৃথিবীর প্রাচীন ইতিহাসের বিচারে স্বল্পস্থায়ী এই সময়ে সমুদ্রস্রোতে পরিবর্তন আসার কথাও ধারণা করা হয়।
অবশ্য সব বিজ্ঞানী ধূমকেতুর আঘাতে মহা-দাবানলের তত্ত্বে বিশ্বাস করেন না। তবে ২০১৭ সালে তুরস্কে আদিম মানুষের আঁকা কিছু গুহাচিত্র আবিষ্কার হয়, যেখানে মহাজাগতিক কোনো বস্তুর আঘাতে ভয়াবহ দুর্যোগের ছবি পাওয়া গেছে। গবেষণায় যুক্ত বিজ্ঞানীরা এসব চিত্রকে ঐতিহাসিক প্রমাণই বলেছেন।
এসডব্লিউ/এসএস/২১১৩
আপনার মতামত জানানঃ