ভারতের বর্ধমান শহর মাইল খানেক এগোলেই ‘বাজেপ্রতাপপুর’। কিন্তু কে এই ‘বাজে প্রতাপ’? সূত্র মতে, প্রতাপ বর্ধমানের রাজা তেজচাঁদের একমাত্র পুত্র। পিতার বর্তমানেই বেশ কিছুদিন জমিদারি দেখাশুনোর কাজও করছিলেন। তারপর একদিন অত্যন্ত অল্প বয়সে মারা গেলেন প্রতাপচাঁদ।
কালনায় নদীর ধারে তার মৃতদেহ সৎকার করা হল তড়িঘড়ি। তবে প্রতাপের মৃত্যুর কথা অবশ্য সবাই ঠিক বিশ্বাস করেনি। স্বয়ং রাজা তেজচাঁদ বলতেন “প্রতাপ আবার ফিরে আসবে।” ‘বাজে প্রতাপ’ সেই মৃত জমিদারের ফিরে আসার গল্প।
উনিশ শতকের শুরুতে তখন ভারতবর্ষে সদ্য আধুনিক বিচার ব্যবস্থার পত্তন হয়েছে। তাছাড়া, ভারতবর্ষের মতো সুদূর উপনিবেশ তো বটেই, পৃথিবীর কোথাও দেহ শনাক্তকরণের কোনো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিই ছিল না। জিন শনাক্তকরণ দূরে থাক, আঙুলের চাপ শনাক্তকরণের প্রক্রিয়া আবিষ্কৃত হয় উনিশ শতকের শেষে।
তাই আগাগোড়া ধোঁয়াশায় ভরা মামলা ‘জাল প্রতাপ মামলা’। কিন্তু তবুও শেষ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল আদালতকে। বিখ্যাত ‘ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলা’র মতোই আরেকটি বহু আলোচিত মামলা এই ‘জাল প্রতাপ মামলা’।
রাজা তেজচাঁদের ব্যক্তিগত জীবনে নানা বদ অভ্যাস থাকলেও, প্রজাপালক হিসাবে তিনি বিখ্যাত ছিলেন। কিন্তু ছয় রানির গর্ভে যে একটিও পুত্রসন্তান জন্মায়নি। তাহলে এরপর জমিদারির দেখাশুনা করবে কে? এই চিন্তা যেমন রাজার, তেমনি প্রজাদেরও।
এমন সময় ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে রানি নানকিকুমারীর গর্ভে জন্ম নিলেন প্রতাপচাঁদ। জমিদারির একমাত্র উত্তরসূরি। পরিবার ও প্রজাদের চোখের মণি তিনি। আদরে প্রশ্রয়ে মানুষ হয়েছেন। নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ান। নানারকম মানুষের সঙ্গে মেশেন।
সাধুসন্তদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা বাড়াবাড়ি রকমের বেশি। শ্রীখণ্ডের প্রাচীন বৈষ্ণব পরিবারের কথায় তো অনেক আবার তাকে অবতার বলেও মেনে নিয়েছিল।
ওদিকে পিতা তেজচাঁদ বয়সের ভারে নুয়ে পড়ছেন। ১৮১৩ সালে পিতার বর্তমানেই জমিদারির ভার নিলেন প্রতাপ। কিন্তু জমা-খরচের হিসাবে যেন তার ঠিক মন বসে না। তার মধ্যে অল্প বয়সে নাকি কী এক পাপ করেছেন প্রতাপ।
সন্ন্যাসীরা নিদান দিয়েছেন, চৌদ্দ বছর অজ্ঞাতবাসে থাকতে হবে। এর আগে একবার পালাতে গিয়ে ধরা পড়েছিলেন। আবার তার মন পালাই পালাই করতে থাকে। প্রায় আট বছর ধরে অবশ্য ভালোই চালাচ্ছিলেন জমিদারি।
হঠাৎ একদিন স্নানের পর জ্বর এল, হাওয়া বদলের জন্য গেলেন কালনায় গঙ্গার ধারে। কিছুদিন থাকার পর সেখানেই নাকি মারা গেলেন প্রতাপ। আগেই বলেছি, তার মৃত্যুর খবর অনেকেই বিশ্বাস করেননি।
স্বয়ং রাজা তেজচাঁদ বলতেন, “প্রতাপ আবার ফিরে আসবে।” আর ঠিক ফিরেও এসেছিলেন ১৪ বছর পর। অবশ্য ফকির সন্ন্যাসীর বেশে, ‘আলেক শাহ’ নামে। ১৮৩৫ সালে গোলাপবাগের গাছতলায় সন্ন্যাসী আলেক শাহকে দেখে চিনতে পেরেছিলেন গোপীনাথ ময়রা।
কিন্তু ততদিনে তেজচাঁদ মারা গেছেন। জমিদারির ক্ষমতা দখল করেছেন প্রতাপের বিমাতা বসন্তকুমারীর ভাই পরাণ। মৃত্যুর আগে পরাণের পুত্রকে দত্তক নিয়ে রাজত্বের ভার দিয়ে গিয়েছেন স্বয়ং তেজচাঁদ।
প্রতাপের ফিরে আসায় প্রমাদ গুনলেন পরাণ। এক দেওয়ানের নেতৃত্বে বিজয় ও রাম নামের দুজন লেঠেল পাঠিয়ে সন্ন্যাসীকে শহরের সীমানার বাইরে বের করে দিলেন। শহরের বাইরে সেই জায়গার নাম হল ‘বাজেপ্রতাপপুর’। আর তার নিকটেই দুটি জায়গার নাম দেওয়ানদীঘি ও বিজয়রাম।
প্রতাপচাঁদ ওরফে আলেক শাহ গেলেন বিষ্ণুপুরের মহারাজার কাছে। তার পরামর্শে বাঁকুড়ায় ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে আলাপ করলেন। আর সেখানে প্রজাবিদ্রোহ শুরু হলে গ্রেফতার করা হয় আলেক শাহকে। সন্ন্যাসী বিদ্রোহের তখন শেষ অবস্থা।
কোথাও অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়লেই কোম্পানীর দৃষ্টি যায় স্থানীয় ফকির সন্ন্যাসীদের দিকে। যাই হোক, মুক্তি লাভের পর তিনি গেলেন কলকাতা। সেখান থেকে সবান্ধবে আবার বর্ধমান প্রত্যাবর্তনের প্রস্তুতি নিলেন। কিন্তু কালনায় পৌঁছোতেই গ্রেপ্তার করা হল তাঁকে।
১৮৩৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর ম্যাজিস্ট্রেট স্যামুয়েল সাহেবের অধীনে বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হল। রায়দান ২০শে সেপ্টেম্বর। সাক্ষ্য দিতে এলেন গণ্যমান্য নানান ব্যক্তি। বিষ্ণুপুরের মহারাজ, জোড়াসাঁকোর দ্বারকানাথ, পাঞ্জাব থেকে রণজিৎ সিংয়ের সেনাপতি ফরাসি জেনারেল অ্যালার্ড। স্যামুয়েল সাহেব শেষ পর্যন্ত তাকে প্রতাপ বলে স্বীকার করলেন না।
কিন্তু এমন অপরাধের কোনো শাস্তির ব্যবস্থা তখনও নেই। সমস্যা মেটাতে সেই এগিয়ে এলেন কাজী। জানালেন মোহাম্মদী আইন মতে আত্মউপকারের জন্য অন্যের নাম ব্যবহার করলে জরিমানা হবে। এক হাজার টাকা জরিমানা হল। তারপর বাকি জীবন আলেক শাহ শ্রীরামপুরে সন্ন্যাসী হয়েই কাটিয়ে দিলেন। বেদান্ত ও স্মৃতির সঙ্গে তিনি বোঝাতেন ফরাসি ও রুশ রাষ্ট্রনীতি। অনেক শিষ্যও জুটেছিল তার। ১৮৫২ অথবা ৫৩ সালে শ্রীরামপুরে তিনি মারা যান।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮০০
আপনার মতামত জানানঃ