মিডিয়ার পক্ষে নিউজ বা বিনোদনের মাধ্যমে কারো স্বার্থসিদ্ধি করা সহজ। মিডিয়া এমন নেতার পক্ষে জনমত গঠন করতে সক্ষম যে কিনা মানুষের উন্নতি নিয়ে একেবারেই চিন্তিত নয়! মানুষ গর্দভ হতে হতে এতটা নিচে নেমে গেছে যে, ফ্যাক্ট, সংবাদ কিংবা বিজ্ঞান হিসেবে তাদের সামনে যা-ই উপস্থাপন করা হয় তারা সেটা দ্বিতীয়বার না ভেবেই গ্রহণ করে নেয়।
“যে মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে সে জনতার মন নিয়ন্ত্রণ করে।”- নোম চমস্কি
Mass Mind Control Through Network Television এর লেখক, গবেষক অ্যালেক্স আনসারি দেখিয়েছেন যে নতুন বিশ্বে প্রথমত টিভি, দ্বিতীয়ত রেডিও কীভাবে জনগোষ্ঠীকে প্রভাবিত করে। অ্যালেক্স আনসারি লিখেছেন, টিভির সবকিছুই আমাদেরকে প্রভাবিত করার জন্য বানানো, বিষয়টা ঠিক তা নয়। তবে বেশিরভাগ টিভি কর্পোরেশনের সাথে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের যোগ আছে কিংবা তাদের নিজস্ব স্বার্থ আছে। এটা থেকে আন্দাজ করা যায়, বর্তমান সময়ে আমাদের নিউজগুলো এত প্রোপাগান্ডায় ভরা কেন!
স্বার্থের দ্বন্দ্ব এখন চলে গিয়েছে রাজনৈতিক মহলে। রক্ষণশীল ও উদারপন্থীরা ক্যাবল চ্যানেলের মালিক হচ্ছে, মিডিয়া চালাচ্ছে নিজেদের প্রভার বিস্তারে। আমরা বিভিন্ন চ্যানেলের প্রতি আকৃষ্ট হই এবং সব মিথ্যা তথ্য, প্রোপাগান্ডাকে সত্য হিসেবে মেনে নিতে থাকি।
আনসারি আরো বলেন, সময়ের সাথে সাথে প্রযুক্তিগুলো উন্নত হচ্ছে। স্বার্থান্বেষী, মানবিকতা ও নৈতিকতা বর্জিত মনোবিজ্ঞানীরা সরকারকে মানুষের আচরণ, চিন্তা, কাজ পরিবর্তনে নতুন নতুন গবেষণা উপহার দিচ্ছে। মানুষ মস্তিষ্ক সম্পর্কে যত জানবে জনগণের বিবেক নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া তত উন্নত হবে। স্ক্রিন, রেডিওবার্তা ও কলমের মাধ্যমে আমরা ঘটনা সম্পর্কে জানি মাত্র, কিন্তু সত্য কেবল চোখ দিয়েই বোঝা যায়।”
প্রশ্ন হলো : আমরা কি আদৌ অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে তা দেখতে আগ্রহী?
“মিডিয়া এই পৃথিবীর সবেচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম। মিডিয়ার নির্দোষকে দোষী এবং দোষীকে নির্দোষ বানিয়ে দিতে পারে এবং এটাই ক্ষমতা। কারণ মিডিয়া সর্বসাধারণের মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।”- ম্যালকম এক্স
মনোযোগই আসল কথা। অনেক উপায়েই জনগোষ্ঠীর মনোযোগ সরিয়ে দেওয়া যায়। রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে কর্পোরেশনগুলো পর্যন্ত এগুলো ব্যবহার করে।
জাতীয়তাবাদ প্রচার
সরকারের বিরুদ্ধে কিছু হলেই তাকে দেশের হুমকি বলে সম্বোধন করা। যার ফলে মানুষ এমন লোকদের সমর্থন করা শুরু করে যারা একেবারেই অসহিঞ্চু এবং তারা এমন যুদ্ধ সমর্থন করে যা চালানোর সামর্থ তাদের নেই।
দৃষ্টি সরিয়ে দেওয়া
কোনো ঘটনা থেকে জনসাধারণের দৃষ্টি সরাতে চাইলে আরেকটি ঘটনা সামনে নিয়ে আসা। কোনো রাজনৈতিক স্ক্যান্ডাল বা কোনো সেলিব্রেটির ডিভোর্স বা কোনো চটকদার গুজব।
বলির পাঁঠা
সবচেয়ে দূর্বল শত্রু খুঁজে বের করা ও তার দিকে মনোযোগ দেওয়া। চেইনের দূর্বল অংশ ধ্বংস করাই পুরো চেইন ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট। চেইন থেকে মানুষের দৃষ্টি সরানোর এটা একটা ভালো পদ্ধতি।
মিথ্যা তথ্য
আপনি যখন তথ্য লুকিয়ে রাখতে চাইবেন তখন আপনাকে তথ্যের সাথে কিছু মিথ্যা জুড়ে দিতে হবে। কারণ নিরেট মিথ্যার চেয়ে একটু সত্য মিশ্রিত মিথ্যা অনেক বেশি কার্যকরী। তারপর এত বেশি তা প্রচার করতে হবে যেন মানুষের মনে তা স্থায়ীভাবে সেঁটে যায়।
অন্যকে খারাপভাবে উপস্থাপন
আমাদের ভুলকে যদি মানুষের চোখ থেকে সরিয়ে ফেলতে হয় তাহলে সেক্ষেত্রে সবচেয়ে ভাল পদ্ধতি হলো অন্য কাউকে দোষারোপ করা।
ভীতি সঞ্চার করা
মানুষের বিবেক ও চিন্তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে ভয়ের চেয়ে বড় কোনো অস্ত্র নেই। আমরা দেখেছি, আমেরিকায় ইবোলার কয়েকটি কেইসকে কেন্দ্র করে মিডিয়া কীভাবে আতংক ও আফ্রিকা বিরোধী মনোভাব প্রচার করেছিল। অনেক প্রক্রিয়ার মধ্যেই এটাই একমাত্র প্রক্রিয়া যেখানে আমরা সেচ্ছায় নিজেদের বিচার বিবেচনা বিসর্জন দিয়ে থাকি।
প্রোপাগান্ডা
প্রোপাগান্ডা হলো খুবই শক্তিশালী একটি মাধ্যম। প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর জন্য আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক দুটো পদ্ধতি রয়েছে। সামাজিকীকরণ, সাংস্কৃতিক বিচার এবং উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে একপাক্ষিক গ্রহণযোগ্য কিছু আচরণ-পছন্দ ইত্যাদি প্রচার করাকে বলা যায় অনানুষ্ঠানিক পদ্ধতি। অন্যদিকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ব্যবহার করে বা বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করে, বাহ্যিক শক্তি প্রয়োগ করে যেসব তথ্য ছড়ানো হয় তা আনুষ্ঠানিক প্রোপাগান্ডা।
জনসাধারণের ওপর নিয়ন্ত্রণ হলো সবচেয়ে শক্থিশালী নিয়ন্ত্রণ। প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে একটি স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থাও জনগণের সমর্থন লাভ করতে পারে আবার ভাল গণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধেও জনগণকে ক্ষেপিয়ে তুলতে পারে।
“আপনি নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ না করলে অন্য কেউ তা নিয়ন্ত্রণ করবে।” – জন এলস্টোন
তথ্য ভ্রান্তি
বিভিন্ন মিডিয়া উৎস থেকে সংবাদের মাধ্যমে যেসব তথ্য জেনে বিস্ময়ে আমাদের চোখ কপালে ওঠার দশা হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেই সংবাদগুলোর সত্যতা নিশ্চয়তা বা ফ্যাক্ট চেক করা হয় না। অখ্যাত ব্লগ সাইট বা ওয়েবসাইট থেকে চটকদার সব ভুলভাল তথ্য সংবাদ আকারে প্রকাশ করা হয়ে থাকে। বাজে রিপোর্টিঙের মাধ্যমে ওয়েবসাইটে পাঠক তথা ভিজিট বাড়ানোই তাদের মূল উদ্দেশ্য। নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে হলুদ সাংবাদিকতার মাধ্যমে হলেও, তাদের ওয়েবসাইটে যত বেশি মানুষ আসবে তারা বিজ্ঞাপন, অ্যাডসেন্স ইত্যাদির মাধ্যমে তত বেশি ডলার উপার্জন করতে পারবে।
কারা চালাচ্ছে এই মিডিয়া?
আমেরিকার সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেবিগনিউ ব্রজেজিঙ্কসি’র মতে, “বর্তমান সমাজের মেধাবী ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের মানুষরা পুরো জনগোষ্ঠীর বিচ্ছিন্ন মানুষদের সাধারণ, স্বতন্ত্র ও ব্যক্তিগত তথ্য যোগাড় করে আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় তাদের বিবেক এবং আবেগকে কৌশলে বিভ্রান্ত করে এবং নিজেদের স্বার্থ উদ্ধান করে নিচ্ছে।”
ফেসবুক, গুগল, টুইটার ছাড়াও মূল নাটের গুরু মোট ৬টি কর্পোরেশন। যারা আমেরিকার ৯০% মিডিয়া দখল করে রেখেছে এবং এদের দ্বারা পুরো বিশ্ব বিভিন্নভাবে প্রভাবিত হচ্ছে।
1. NBC/Universal: NBC News/Sports, CNBC, MSNBC, Oxygen, SyFy Channel, Telemundo, USA Network, Weather Channel, Focus Features, Universal Pictures, Universal Parks and Resorts, Trio, Paxson, Bravo.
2. News Corp: Fox News, The New York Post, Star World, Star TV India, Star TV Taiwan, ReganBooks, HarperCollins Publishing, National Geographic Channel, Radio Veronica, The Wall Street Journal.
3. Time Warner: HBO, Warner Bros. Entertainment, New Line Cinema, Cinemax, Cartoon Network, Fortune, Sports Illustrated, Castle Rock Films, People magazine.
4. Walt Disney: ABC Television Network, ESPN, Disney Publishing, Disney Records, Hollywood Records, Miramax, Touchstone Films, Hyperion Books, PIXAR, 20th Century Studios.
5. Viacom: Paramount Pictures, BET, MTV Canada, Comedy Central, CMT, LOGO, Nick at Nite, Nick magazine, TV Land, VH1, Spike TV, Noggin.
6. CBS Corporation: CBS Network, CBS News, CBS Sports, Showtime, TV.com, CBS Radio, CBS Outdoor, CBS Consumer, CW Network, Infinity Broadcasting, Simon and Schuster, Westwood One Radio Network.
তথ্যসূত্র :
Mind Wars: A History of Mind Control, Surveillance, and Social Engineering by the Government, Media, and Secret Societies by Marie D. Jones and Larry Flaxman
আপনার মতামত জানানঃ