ওজাইর ইসলাম
সম্প্রতি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট (রাজস্ব বিভাগ) ও পররাষ্ট্র দপ্তর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে বাংলাদেশের র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) এবং এর বর্তমান ও সাবেক সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বেশ পুরানো এবং স্বাভাবিক হলেও, বাংলাদেশের জন্য এটি সম্পূর্ণ নতুন একটি বিষয়। বাংলাদেশের উপর আরোপিত এই নিষেধাজ্ঞা স্বাভাবিকভাবেই জনমনে কিছু প্রশ্নের উদ্রেগ করেছে, “এই নিষেধাজ্ঞার মূল উদ্দেশ্য কী মানবাধিকার রক্ষা নাকি দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন প্রভাব বলয় বিস্তারের ভূরাজনৈতিক কোন কৌশল?” বাংলাদেশের স্বার্থে এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার এখনি উপযুক্ত সময়।
উল্লিখিত বিষয়টি যথাযথভাবে বুঝতে হলে প্রথমেই আমাদেরকে সন্ত্রাস দমনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত এজেন্ডা, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং বৈশ্বিক কার্যক্রম পর্যালোনা করা প্রয়োজন। ২০০১ সালের “নাইন ইলেভেন” হামলার পর, বৈশ্বিক সন্ত্রাস দমনে যুক্তরাষ্ট্র “ওয়ার অন টেরর” ঘোষণা করে। সন্ত্রাস দমনের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে আর্থিক, কারিগরি ও অন্যান্য সহায়তা দিয়ে আসছে। যেমনঃ আমেরিকার ব্যুরো অব কাউন্টার টেরোরিজম ১৯৮৩ সাল থেকে এ যাবৎ ১৫৪ টি দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ৯০ হাজারেরও বেশি সদস্যকে প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে, যা সন্ত্রাস দমনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সদিচ্ছার বার্তা বহন করে।
আলোচনার স্বার্থে বিগত কয়েক দশকে বাংলাদেশে সন্ত্রাস দমনের চিত্রের দিকে আলোকপাত করা প্রয়োজন। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশে সন্ত্রাস দমনে র্যাব সবচেয়ে সফল ভূমিকা পালন করেছে। উদাহরণস্বরূপঃ র্যাব কর্তৃক আল কায়দার সাথে সংশ্লিষ্ট উগ্রপন্থী সংগঠনের নেতা “বাংলা ভাই” কে গ্রেফতার কিংবা হরকাতুল-উল-জিহাদ আল-ইসলামী বাংলাদেশি শাখার প্রধান “মুফতি হান্নানে” কে গ্রেফতারসহ অন্যান্য উগ্রবাদী এবং সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারের বিষয়সমূহ উল্লেখ করার যথেষ্ট প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে। এছাড়া, জংগীবাদ ও সন্ত্রাসবাদ দমনের বিভিন্ন অভিযানে র্যাবের অনেক সদস্য আহত ও নিহত হয়েছেন। প্রসংগত, ২০১৭ সিলেটে জঙ্গিবিরোধী অভিযান “অপারেশন টুইলাইট” এ অংশগ্রহণকালে র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক লেফট্যানেন্ট কর্ণেল আবুল কালাম আজাদ এর মৃত্যুর বিষয়টি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। প্রতিষ্ঠার পর হতে উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করে একটি অসহিংস ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় র্যাবের যে অবদান, তা কোনভাবেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।
উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, পৃথিবীর যে কোন প্রান্ত থেকে সন্ত্রাসবাদ দমনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বদ্ধপরিকর। অন্যদিকে, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও মাদকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকার ঘোষিত “জিরো টলারেন্স” নীতি বাস্তবায়নে র্যাব সফলভাবে কাজ করে চলেছে। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী এজেন্ডা, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সাথে র্যাবের কাজের ধরণ বহুলাংশে মিলে যায়, সেহেতু জনমনে এ প্রশ্নের উদ্রেগ হওয়াটাই স্বাভাবিক যে, “যুক্তরাষ্ট্র কী বাংলাদেশের উপর চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে ভূরাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যেই র্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করল?” এবং “নিষেধাজ্ঞাই কী র্যাবের উপর আনীত অভিযোগের একমাত্র সমাধান?” কিংবা “সমাধান হিসেবে নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টিই বা কতটা যৌক্তিক, গ্রহণযোগ্য এবং কার্যকর?”
এবার, যে ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র র্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, যুক্তরাষ্ট্র পুলিশ কর্তৃক একই ইস্যু অর্থাৎ মানবাধিকার লঙ্ঘনের উপর আলোকপাত করা প্রয়োজন। ল্যানসেট এর একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৯৮০ সাল থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের হাতে নিহত হয়েছে প্রায় ৩২ হাজার মার্কিন নাগরিক। পরিতাপের বিষয় হলেও সত্য যে, যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ কর্তৃক সংগঠিত হত্যাকান্ড মূলতঃ বর্ণবৈষম্য দ্বারা উৎসাহিত। কেননা ল্যানসেট এর ঐ রিপোর্ট অনুযায়ী পুলিশের হাতে “কালো আমেরিকান”দের মৃত্যুর হার “সাদা আমেরিকান”দের চেয়ে ৩.৫ গুণ বেশি। একই রিপোর্টে এটাও উল্লেখ করা হয়েছে যে, পুলিশ কর্তৃক সংগঠিত হত্যাকান্ড বা নির্যাতনের প্রায় ৫৫ শতাংশই অভিযোগ হিসেবে গ্রহণ করা হয়নি কিংবা অথবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভুল ভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এসব তথ্য জনমনে নতুন প্রশ্ন তৈরি করতেই পারে যে, “যেখানে যুক্তরাষ্ট্র নিজের দেশের পুলিশ কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘন ঠেকাতে ব্যার্থ, সেখানে বাংলাদেশের র্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি কতটুকু যৌক্তিক?”
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস দমনের লক্ষ্যে ২০০৪ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তত্ত্ববধানে র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাব নামের এলিট ফোর্সটি যাত্রা শুরু করে। বাংলাদেশ পুলিশ, বাংলাদেশ সেনা বাহিনী, নৌ বাহিনী, বিমান বাহিনীর, আনসার, বিজিবি, কোস্টগার্ডের সদস্যদের সমন্বয়ে র্যাব ফোর্স গঠন করা হয়। ফোর্সটির গঠনের দিকে নজর দিলেই একটা বিষয় স্পষ্ট যে, এটি কোন স্থায়ী ফোর্স নয় বরং একটি বিশেষায়িত ফোর্স, যা বাংলাদেশে জংগীবাদ ও সন্ত্রাসবাদ দমনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালনের মাধ্যেমে বিশেষ সুনাম অর্জন করেছে। র্যাবের যা অতীত অর্জন, প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে যা করছে কিংবা ভবিষ্যতে যা করবে তা কোন বাহিনীর একক কৃতিত্ব বা দায় নয় বরং বাংলাদেশের প্রায় সকল বাহিনীর একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা মাত্র। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে মানবাধিকার লঙ্ঘন আখ্যা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যদি র্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা প্রয়োজন বলে মনে করে, তাহলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশকেও একই কারণে নিষেধাজ্ঞার আওতায় নিয়ে আসা প্রয়োজন। কিন্ত, “বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাধবে কে?”
একটি বাহিনীর কোন কর্মকর্তার ব্যক্তিগত ক্ষোভ, লোভ কিংবা উচ্চাকাঙ্ক্ষার দায়ে বাহিনীটিকে সম্পূর্ণভাবে দায়ী করা মোটেও যৌক্তিক নয়। বিষয়টি অনেকটা মাথা ব্যাথার কারণে মাথা কেটে ফেলার পরামর্শ দেয়ার মতই। এই বিষয়ে কোন দ্বিমত নেই যে, র্যাবের কোন কর্মকর্তা যদি মানবাধিকার লঙ্ঘন বা বেআইনি কোন কাজ করে তার দায়ভার কিছুটা হলেও র্যাবের উপর বর্তায়। কিন্ত এর অর্থ নিশ্চয় এটা না যে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের উদ্দেশ্যেই র্যাব এর প্রতিষ্ঠা বা র্যাব মানবাধিকার লঙ্ঘনের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে কিংবা যারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে তাদেরকে র্যাব পৃষ্ঠপোষকতা করছে বা সমর্থন কিংবা সহায়তা দিচ্ছে।
২০১৪ সালে সংগঠিত নারায়নগঞ্জের সাতখুন হত্যাকান্ডের বিচারের মাধ্যমে র্যাব প্রমাণ করেছিল যে, প্রতিষ্ঠানের অবস্থান তার কর্মকর্তাদের উর্ধ্বে এবং সবাই বিচারের আওতাধীন। র্যাব কর্তৃপক্ষের সব সময় যেকোন যৌক্তিক সমালোচনা গ্রহণপূর্বক এসব অভিযোগের সমাধানে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে বলেই জনমনে ফোর্সটির গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে।
আমাদের একটি বিষয় মনে রাখা উচিত, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্র এনেছে তা সম্পূর্ণভাবেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। সার্বভৌম দেশ হিসেবে এসব সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশ নিজেই উদ্যোগ গ্রহণ করবে। নিজেদের স্বার্থ কায়েমের লক্ষ্যে কোন পরাশক্তি যদি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ করতে চাওয়ার বিষয়টি কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যদি যুক্তরাষ্ট্র সত্যিই র্যাব কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘন বা এ সংক্রান্ত উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে থাকে, তবে তাদের উচিত র্যাবের ইতিবাচক সংস্কারের জন্যে বাংলাদেশ সরকারের সাথে আরো বেশি আন্তরিকভাবে কাজ করা। নিষেধাজ্ঞা আরোপ কোন সমাধান নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের উচিত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে র্যাবকে এমনভাবে তৈরী করা যাতে র্যাব তাদের দেখানো পথে হেটে একই সাথে যেমন মানবাধিকার রক্ষা করতে পারবে, তেমন উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসবাদ দমনে মূখ্য ভূমিকা রাখবে। উল্লেখ্য, নিষেধাজ্ঞা আরোপ কোন কার্যকর সমাধান নয় বরং আমেরিকার উচিত দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান এবং ভূঅর্থনৈতিক গুরুত্ববিবেচনা করে বাংলাদেশ সরকারের সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে যে কোন সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করা।
ওজাইর ইসলাম, কলামিস্ট ও মানবাধিকার কর্মী
আপনার মতামত জানানঃ