আফগানিস্তানে হাহাকার চলছে। খাবারের জন্য হন্যে হয়ে ছুটছে মানুষ। তার ওপর চলছে তীব্র শীত, বাড়ছে শঙ্কা। কারণ, ইতিমধ্যে অনেক এলাকা খরার কবলে পড়েছে। ফলে ফসল উৎপাদনে ধস নামার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ ছাড়া তালিবান ক্ষমতায় আসার পর দেশটিতে আন্তর্জাতিক ত্রাণ সহায়তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভয়ংকর বিপর্যয়ের মুখে আফগানরা।
তালিবান আফগানিস্তানের শাসন ক্ষমতা দখলের পর থেকে আফগানদের দুরাবস্থা যেন বেড়েই চলেছে। দেশটিতে চলমান মানবিক ও আর্থিক সংকটও বাড়ছে প্রতিদিন। এই পরিস্থিতিতে আফগানিস্তানের লাখ লাখ নাগরিক ‘মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে’ রয়েছে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তেনিও গুতেরেস। এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে আল জাজিরা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আফগানিস্তানের বিদ্যমান বিপর্যয়কর পরিস্থিতি ঠেকানোর জন্য জাতিসংঘের যে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মানবিক সহায়তা আবেদন রয়েছে, সেটিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অবদান রাখার আহ্বান জানিয়েছেন গুতেরেস।
বৃহস্পতিবার (১৩ জানুয়ারি) সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আফগানিস্তানকে সম্ভাব্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে দেশটির বাজেয়াপ্ত সম্পদ ছেড়ে দেওয়া এবং আফগান ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে অচলাবস্থা থেকে কাটিয়ে জোরেশোরে চালু করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, হিমায়িত তাপমাত্রা এবং হিমায়িত সম্পদ, উভয়ই আফগানিস্তানের জনগণের জন্য প্রাণঘাতী বিষয়। আর তাই মানুষের জীবন ও বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে বাঁচাতে প্রয়োজনীয় অর্থ ব্যবহার করা থেকে বাধা দেয় এমন নিয়ম ও শর্তগুলো এই ধরনের জরুরি পরিস্থিতিতে স্থগিত করতে হবে।
এমনিতেই দশকের পর দশক ধরে যুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত আফগানিস্তান। গত আগস্টে তালিবান কাবুলের ক্ষমতা দখলের পর থেকে সেই পরিস্থিতি দিনে দিনে কেবল খারাপই হয়েছে। আফগানিস্তানে বর্তমানে যা আর্থিক পরিস্থিতি, তাতে এই প্রবল শীতে লাখ লাখ মানুষ অভুক্ত থাকতে হতে পারে।
আফগানিস্তানের বিদ্যমান বিপর্যয়কর পরিস্থিতি ঠেকানোর জন্য জাতিসংঘের যে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মানবিক সহায়তা আবেদন রয়েছে, সেটিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অবদান রাখার আহ্বান জানিয়েছেন গুতেরেস।
২০ বছর পর গত ১৫ আগস্ট আফগানিস্তান দখলে নেয় তালিবান। এরপর সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে তালিবান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভার ঘোষণা দেয়। অবশ্য সরকার গঠন করলেও বিশ্বের কোনো দেশই এখনও পর্যন্ত তালিবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। এর জেরে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ ও এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দাতা সংস্থাও আফগানিস্তানে মানবিক সহায়তাসহ অর্থ সাহায্য পাঠানো বন্ধ করে দেয়।
ফলে দেশটিতে অর্থনৈতিক সংকট প্রতিদিনই খারাপের দিকে যাচ্ছে। এছাড়া তালিবানের ক্ষমতা গ্রহণের আগে থেকেই বিদেশি সহায়তার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল ছিল আফগানিস্তানের অর্থনীতি। আগস্ট থেকে সেই সহায়তা আসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আর্থিক ও মানবিক সংকট কেবলই বেড়েছে।
জাতিসংঘ বলছে, বর্তমানে ৮৭ লাখ আফগান অনাহারের দ্বারপ্রান্তে রয়েছেন। গুতেরেস বলছেন, সংকটের শুরুতে আফগান অর্থনীতিতে তারল্য বাড়ানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং এর মাধ্যমে দারিদ্র্য, ক্ষুধা ও অসহায়ত্বের মুখে পড়া লাখ লাখ আফগানের সম্ভাব্য বিপর্যয়ও এড়ানো যেত।
জাতিসংঘ মহাসচিব জোর দিয়ে বলেন, বিপর্যয় ও সংকট এড়ানোটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বর্তমানে লাখ লাখ আফগান মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে রয়েছেন।
দাতব্য সংস্থাগুলো সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, আফগানিস্তানে খরার কারণে একদিকে ফসল উৎপাদন কম হয়েছে। আরেকদিকে পশ্চিমারা আর্থিক সমর্থন প্রত্যাহারের পর অর্থনীতির পতন ঘটেছে। স্বাস্থ্যখাতের অবস্থা একেবারেই শোচনীয়। বেতন না পাওয়ায় অনেক স্বাস্থ্যকর্মী পালিয়ে গেছেন।
এর আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মুখপাত্র মার্গারেট হ্যারিস জানিয়েছেন, রাতে আফগানিস্তানের তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে যায় এবং শীতকালীন তাপমাত্রার কারণে বৃদ্ধ ও তরুণরা নানা রোগে আক্রান্ত হতে পারে। হাসপাতালগুলোর ওয়ার্ড ইতোমধ্যে শিশুদের দিয়ে পূর্ণ হয়ে গেছে। এদের মধ্যে সাত মাস বয়সী একটি শিশুও রয়েছে দুর্বল স্বাস্থ্যের কারণে যাকে নবজাতকের চেয়েও ছোট দেখাচ্ছে।
কাজ হারিয়ে চরম আর্থিক সঙ্কটে পড়েছে আফগানিস্তানে সাধারণ মানুষ। এখন দু’বেলা দু’মুঠো খাবার জোটাতে তাদের বিক্রি করতে হচ্ছে শীরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ কিডনি। সেখানে ৪ থেকে ৮ হাজার ডলারে বিক্রি হচ্ছে একেকটি কিডনি।
এদিকে আফগানিস্তানের এখন যেখানেই যাওয়া হোক না কেন শিশু শ্রমিকদের দেখতে পাওয়া যায়। গাড়ি পরিষ্কার, আবর্জনার স্তূপ থেকে কিছু সংগ্রহ, জুতো পালিশ থেকে শুরু করে নানা ধরনের কাজ করছে তারা। নিজের ও পরিবারের মুখে খাবার তুলে দিতেই বই-খাতা ছেড়ে উপার্জনের পথে নামতে তাদের এ চেষ্টা।
খাদ্য সংকট কতটা চরমে পৌঁছালে একজন বাবা তার কন্যাসন্তানকে বিক্রি করতে বাধ্য হন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে একজন বাবার এছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। দেশে ভয়াবহ আর্থিক সংকট তৈরি হওয়ায় আফগানিস্তানের অনেক নাগরিককেই এখন এমন মর্মান্তিক বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
২০২১ সালের ১৫ আগস্ট আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল দখলে নেয় তালিবান। এরপর ৩১ আগস্ট টানা ২০ বছরের যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত দেশটি থেকে সব সেনা প্রত্যাহার করে নেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্ররা। এরপর রাজনৈতিক গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলার মধ্যে দেশ ছেড়ে অন্য দেশে আশ্রয় নেয় বহু আফগান পরিবার। কিন্তু যারা দেশ ছাড়তে পারেননি তারা পড়েছেন চরম বিপাকে।
তালিবান আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকেই একের পর এক সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে দেশটিতে। নিরাপত্তার অভাব, সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কা, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছে দেশটি। মুখ থুবড়ে পড়েছে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা।
এদিকে, তালিবান সরকার গঠনের পর একের পর এক বিধিনিষেধ জারি করছে। যার ফলে দেশটির সংকট আরও তীব্র হচ্ছে।
আফগানিস্তান বরাবরই গরিব দেশ। সেখানকার ৭০ শতাংশ মানুষের দৈনিক আয় দুই ডলারের কম। অর্থনীতিবিদদের ধারণা, আগামী দিনে দেশটি আরও দরিদ্র হতে চলেছে। সেই দারিদ্রের মোকাবিলা করতে হবে তালিবান শাসকদের। তারা ইতিমধ্যেই বুঝতে পারছেন, দারিদ্রের বিরুদ্ধে লড়াই করা মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোর চেয়ে বেশি কঠিন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দীর্ঘদিন সন্ত্রাসী কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকা তালিবান ভেবেছিল সরকার চালানো বোধহয় খুব সহজ। মানুষ খুন করা আর দেশ চালানো যে এক নয়, সেটা তারা বোঝেনি। দুর্নীতি আর বেহাল অর্থনীতি শুরুতেই কাঁধে চেপে বসেছে তালিবান শাসকদের। অর্থনীতি তো দূরের কথা, শান্তি ফেরাতেও হিমশিম খাচ্ছে দখলদার সরকার। ক্ষমতায় আসার আগে আন্তর্জাতিক দুনিয়াকে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তালিবান। বোঝাতে চেয়েছিল, গত দুই দশকে তাদের মানসিকতার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু তারা যে বিন্দুমাত্র নিজেদের মানসিকতা বদলায়নি ক্ষমতায় এসেই চরম বর্বরতার পরিচয় দিয়ে তারা সেটা আন্তর্জাতিক দুনিয়াকে বুঝিয়ে দিয়েছে। তাই আন্তর্জাতিক সাহায্যের বহর কমছে।
মনে করা হয়, তালিবানকে সাহায্য করা মানেই জঙ্গিবাদ ও মাদক চোরাকারবারীদের মদদ। আত্মঘাতী বোমারুদের যেমন তারা প্রকাশ্যেই উৎসাহিত করছে, তেমনি ক্ষমতায় আসার পর ফের মাদক ব্যবসার কথাও বলছেন তালিবান মন্ত্রীরা। নারী ও সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের বহরও কমেনি। তাই বেশিরভাগ দেশই তালিবানের ওপর ক্ষুব্ধ।
এদিকে অর্থনীতিবিদরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তার ওপর নির্ভরতা থেকে বের হয়ে অর্থনৈতিক ধস ঠেকিয়ে পরিস্থিতি উন্নয়নে নজর দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
ইরাজ ফাকিরি নামের এক অর্থনীতিবিদ বলেন, কার্যকর সহায়তা অবশ্যই দিতে হবে। একই সঙ্গে সৃষ্টি করতে হবে কর্মসংস্থান। যেসব প্রদেশ থেকে বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে সেখানে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প নিতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩২৫
আপনার মতামত জানানঃ