করোনা মহামারির প্রকোপ কমে যাওয়ার পর বিশ্বে অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি পড়তে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে এখন খুব কমসংখ্যক মানুষই সংক্রামক রোগে মারা যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মৃত্যুর কারণ অসংক্রামক ব্যাধি। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যান্সার, কিডনি জটিলতা ও দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসতন্ত্রের রোগ। আর এসবের পেছনে কারণ হিসাবে অনেকটা অংশজুড়েই আমাদের খাদ্য ও খাদ্যাভ্যাস।
দ্য গার্ডিয়ানের এক খবরে জানা যায়, বিশ্ব জুড়ে প্রতিদিনই নতুন নতুন মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ার অন্যতম কারণ মানুষের প্রতিরোধ ক্ষমতা সুস্থ কোষ এবং শরীরে অনুপ্রবেশ করা অণুজীবের মধ্যে আর পার্থক্য করতে পারছে না। ফলে রোগের বিরুদ্ধে যা এক সময় প্রতিরক্ষা হিসেবে কাজ করেছে তা এখন মানুষের টিস্যু এবং প্রত্যঙ্গকে আক্রান্ত করছে।
এই প্রবণতা মোকাবিলায় বড় বড় আন্তর্জাতিক গবেষণা হয়েছে। একে বলা হচ্ছে অটোইমিউন অসুখ। লন্ডনের ফ্রান্সিস ক্রিক ইনস্টিটিউটের দুই বিশেষজ্ঞ এই প্রবণতার সুনির্দিষ্ট কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছেন। এই দুই বিশেষজ্ঞ হলেন জেমস লি এবং ক্যারোলা ভিনুয়েসা।
জেমস লি জানান, প্রায় ৪০ বছর আগে পশ্চিমে অটোইমিউন রোগীদের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। বর্তমানে কয়েকটি দেশে এই রোগ বাড়তে দেখা যাচ্ছে, সেসব দেশে আগে এই ধরণের রোগের অস্তিত্ব ছিল না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্য ও পূর্ব এশিয়ায় পেটের প্রদাহ জনিত অসুস্থতা বেড়েছে। অথচ আগে এসব অঞ্চলে এধরণের রোগের কথা কমই জানা যেত।
অটোইমিউন রোগ বিভিন্ন ধরণের হতে পারে। টাইপ ১ ডায়াবেটিস থেকে শুরু করে আর্থারাইটিস, পেটের প্রদাহ থেকে শুরু করে ধমনীর অস্বাভাবিকতা। প্রতিটি ক্ষেত্রেই মানুষের প্রতিরোধ ক্ষমতা সংক্রমণকারী অণুজীবের বদলে সুস্থ কোষ আক্রান্ত করে। কেবল যুক্তরাজ্যেই এই ধরণের রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৪০ লাখের বেশি। কেউ কেউ ভুগছেন একাধিক রোগে।
বেশিরভাগ বিজ্ঞানীর বিশ্বাস এই বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখছে পরিবেশগত প্রভাবক। জেমস লি বলেন, ‘গত কয়েক দশকে মানুষের জিন বদল হয়ে যায়নি। ফলে বাইরের দুনিয়ার কিছু একটা অবশ্যই বদলেছে যাতে করে অটোইমিউন রোগে আক্রান্ত বাড়ছে।’
ওই মতকে সমর্থন করছেন ক্যারোলা ভিনুয়েসা। এক সময়ে অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে কাজ করে আসা ভিনুয়েসা মনে করেন এই পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে মানুষের খ্যাদ্যাভাস। তিনি জানান, যেসব দেশ আরও বেশি পশ্চিমা ধাঁচের খাবারের প্রতি ঝুঁকে পড়ছেন এবং বেশি ফাস্ট ফুড কিনছেন সেসব দেশে এই রোগ বাড়ছে।
ভিনুয়েসা বলেন, ‘ফাস্ট-ফুড খাদ্যাভ্যাসে আঁশের মতো গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের ঘাটতি রয়েছে আর প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে যে, এই পরিবর্তন ব্যক্তির সেইসব অণুজীবের ওপর প্রভাব ফেলছে যেগুলো শারিরীক ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
তিনি বলেন, এই পরিবর্তন মানুষের ওপর প্রভাব ফেলছে আর অটোইমিউন রোগের সূচনা ঘটাচ্ছে। বর্তমানে শতাধিক এই ধরণের রোগের কথা জানা গেছে বলেও জানান তিনি।
যেসব দেশ আরও বেশি পশ্চিমা ধাঁচের খাবারের প্রতি ঝুঁকে পড়ছেন এবং বেশি ফাস্ট ফুড কিনছেন সেসব দেশে এই রোগ বাড়ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপে দেখা গেছে, স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে করোনার বছরে (২০২০) দেশে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু সাড়ে ২২ ভাগ বেড়েছে। ব্রেইন ক্যান্সারে মৃত্যু বেড়েছে ৪৮ ভাগ, ব্রেইন স্ট্রোকে মৃত্যু বেড়েছে প্রায় ৮৮ শতাংশ। কিডনি রোগে মৃত্যুহার দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে আত্মহত্যাও।
বিবিএস জরিপে দেখা যায়, করোনাকালে হৃদরোগ, মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ, ক্যান্সার, শ্বাসতন্ত্র ও কিডনিসহ অসংক্রামক রোগে মানুষের মৃত্যু বেড়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দেশে ২০১৯ সালে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেছিল ১ লাখ ৪৭ হাজার ২৫৯ জন। ২০২০ সালে এই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার ৪০৮ জন। ব্রেইন স্ট্রোকে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৪৫ হাজার ৫০২ জন, ২০২০ সালে এটি বেড়ে হয়েছে ৮৫ হাজার ৩৬০ জনের। ব্লাড ক্যান্সারে মৃত্যুর সংখ্যা ১৮ হাজার ৬২০ থেকে এক বছরের ব্যবধানে বেড়ে হয়েছে ২১ হাজার ৪৭১ জনে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপে যে প্রাক্কলন তুলে ধরা হয় তাতে দেখা যায়, অসংক্রামক রোগে বেশি মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। এ তালিকায় রয়েছে হৃদরোগ, ক্যান্সার, কিডনি রোগ, ডায়বেটিস, শ্বাসতন্ত্রের রোগসহ আরও কিছু রোগ। চিকিৎসকরা বলছেন, প্রক্রিয়াজাত খাবার বেশি খাওয়া এবং কায়িক পরিশ্রম কম করায় হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, সম্প্রতি বহু দেশে করোনার সংক্রমণ থেকে সেরে ওঠার পর ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকে। কম বয়সিরাও ডায়াবেটিসের শিকার হচ্ছেন। তবে আগে থেকে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন না এমন মানুষের মধ্যে ডায়াবেটিস ছড়ানোর জন্য করোনা দায়ী কিনা, তা নিয়ে চিকিৎসকদের মধ্যে বিতর্ক চলছে।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতির তথ্য বলছে, দেশে প্রাপ্ত বয়স্কদের ১০ জনের মধ্যে ১ জন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তবে ৫৭ শতাংশ মানুষই জানে না, তার ডায়াবেটিস আছে। আর বাংলাদেশের জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৭-১৮ তথ্য বলছে, মাত্র ১৩ শতাংশ ডায়াবেটিসে আক্রান্তরা নিয়মিত চিকিৎসা নিয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। ২২ শতাংশের বেশি মানুষের তা নিয়ন্ত্রণে নেই।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের লাইফস্টাইল এবং খাদ্যাভাস এই অসংক্রামক রোগ বেড়ে যাওয়ার জন্য প্রধান দায়ী। খাদ্যাভাস আগে বাংলাদেশে যে রকম ছিল তার থেকে অনেক বদলে গিয়েছে এখন।বর্তমান সময়ে ফাস্টফুড, রিচফুডসহ রাস্তার ধারের পোড়া তেলের খাবার আমাদের শরীরের যে ক্ষতি করে সেটাই এই রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাবার প্রমাণ।
তারা বলেন, একই সঙ্গে আমাদের কায়িক পরিশ্রম কম। জীবন যাপনে নানামুখি চাপ বেড়ে গেছে এখন। আমরা পরিশ্রম করি কম। কিন্তু খুব সহজেই দিনের তিন বেলাতেই রিচ ফুড খেয়ে যাচ্ছি, কায়িক পরিশ্রম হয় না। কিন্তু শরীর তো মেশিন না, তার জন্য সঠিক খাদ্য দরকার। সেটা আমরা নিচ্ছি না। অপরদিকে শাকসবজি যতোটা খাচ্ছি সেখানেও কেমিক্যাল খাচ্ছি। এসব কারণেই মূলত অসংক্রামক রোগ বেড়ে যাচ্ছে। আর এ থেকে মুক্তি পেতে খাদ্যাভ্যাস এবং লাইফস্টাইল অবশ্যই বদলাতে হবে।নয়তো দিন দিন অসংক্রামক রোগীর সংখ্যা বেড়েই যাবে। একই সঙ্গে কায়িক পরিশ্রম করতে হবে। তা হলেই আমরা কিছুটা সুস্থ জীবন কাটাতে পারবো।
তারা বলেন, আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বয়স্কদের মধ্যে এখন অসংক্রামক রোগটাই মূল ইস্যু। তবে শিশুদেরও কম নয়। শিশুদের অসংক্রামক রোগের মধ্যে ওবেসিটি (স্থূলতা) অন্যতম।ওবেসিটির বাইরে শিশুদের এবং বয়ঃসন্ধিকালে কিছু মানসিক সমস্যাও এখন অসংক্রামক রোগের মধ্যে পড়ে।খাদ্য অভ্যাসের কারণে অনেক সমস্যা হচ্ছে শিশুদের। যেমন-ঘনঘন পেট ব্যথা।। পরিবার বিশেষ করে বাবা মায়ের মধ্যে যদি সমস্যা থাকে সেগুলোও শিশুদের অসংক্রামক রোগ হিসেবে দেখা দেয়।
আরও বলেন, বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর যত ভাগ অসংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত, তার চেয়েও বেশি অংশ অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। ঝুঁকির মধ্যে থাকা এই জনগোষ্ঠীর ঝুঁকি নির্ণয় এবং ঝুঁকি কমানোর জন্য কম খরচে বাস্তবসম্মত পদ্ধতি প্রয়োগ করাই হচ্ছে অসংক্রামক রোগের ব্যাপকতা মোকাবিলার সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি। তাই গ্রাম ও শহরের শিশু, কিশোর, তরুণ, যুবকসহ সব বয়সের নারী ও পুরুষের মধ্যে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ওজন নিয়ন্ত্রণ, কায়িক পরিশ্রমের অভ্যাস তৈরিসহ স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সেই সঙ্গে বায়ুদূষণ, পরিবেশদূষণ, পানিতে আর্সেনিক, খাদ্যে ভেজাল, খাদ্য সংরক্ষণের জন্য বেশি মাত্রায় কেমিক্যালের প্রয়োগসহ আরও যে বিষয়গুলো অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়, তা নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় নীতিমালার প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে।
তারা বলেন, অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম এখন শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সীমিত। কিন্তু শহরগুলোর প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থাপনা মূলত সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য শাখার মাধ্যমে পরিচালিত হয়। শহরের সরকারি প্রাথমিক চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম এখনো যুক্ত করা হয়নি। এ জন্য শহরাঞ্চলের মানুষকে বেসরকারি চিকিৎসাসেবার ওপর নির্ভর করতে হয়, যা অনেক ব্যয়বহুল। বাংলাদেশের জনগণ একই সঙ্গে সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের দ্বৈত হুমকির মধ্যে রয়েছে। ফলে এর মোকাবিলার উদ্যোগটি হতে হবে সম্মিলিত।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৪৭
আপনার মতামত জানানঃ