সীমান্ত নিয়ে চীনের সঙ্গে ভারতের উত্তেজনা দীর্ঘদিন ধরে। চলমান উত্তেজনা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। সর্বশেষ বছরখানেক আগে প্রতিবেশী দেশ দুটি বড় ধরনের রক্তক্ষয়ী সংঘাতেও জড়িয়েছে। এ নিয়ে বারবার আলোচনায় বসেও কোনো সমাধানসূত্র আসেনি। এমন সীমান্ত উত্তেজনার মধ্যেই ভারতের অরুণাচল প্রদেশের কিছু স্থানের নতুন করে নামকরণ করেছে চীন।
নয়াদিল্লি এর কঠোর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। সূত্র মতে, বেইজিং অরুণাচল প্রদেশের ১৫টি স্থানের নিজেদের ভাষায় নামকরণ করেছে। অরুণাচলকে দক্ষিণ তিব্বতের অংশ মনে করে চীন।
চীন ভারতের অরুণাচল প্রদেশের যে ১৫টি স্থানের নতুন নামকরণ করেছে, এর মধ্যে ৮টি আবাসিক এলাকা, ৪টি পাহাড়, ২টি নদী ও ১টি পাহাড়ি পথ।
বেইজিংয়ের এ পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা জানিয়ে ভারত বলেছে, অরুণাচল ভারতের প্রদেশ ছিল এবং থাকবে। নাম পরিবর্তন করে এ সত্য কখনো বদলে দেওয়া যাবে না। বেইজিংয়ের নতুন করে এই নামকরণের পর ভারত এমন প্রতিক্রিয়া জানাল।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি বলেছেন, ‘আমরা আগেও এমনটা দেখেছি। চীনের অরুণাচল প্রদেশের কোনো স্থানের নতুন নামকরণের ঘটনা এটাই প্রথম নয়; ২০১৭ সালের এপ্রিলেও চীন এভাবে অরুণাচল প্রদেশের কিছু স্থানের নতুন করে নামকরণ করেছিল।’
অরিন্দম বাগচি আরও বলেন, ‘অরুণাচল প্রদেশ ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল এবং থাকবে। অরুণাচলের নতুন নামকরণে সত্যটা বদলে যাবে না।’
চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত দৈনিক গ্লোবাল টাইমস এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হচ্ছে, চীনের বেসামরিক–বিষয়ক মন্ত্রণালয় গত বুধবার ঘোষণা দিয়ে জানায়, তারা চীনা অক্ষর, তিব্বতি ও রোমান বর্ণমালায় জাংনানের ১৫টি স্থানের মানসম্মত নাম দিয়েছে। জাংনান হলো অরুণাচল প্রদেশের চীনা নাম।
গ্লোবাল টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চীনের স্টেট কাউন্সিল ও মন্ত্রিসভা কর্তৃক জারি করা ভৌগোলিক নামের প্রবিধান অনুসারে নতুন নামকরণ করা হয়েছে।
এ নিয়ে দ্বিতীয়বার অরুণাচল প্রদেশের বিভিন্ন স্থানের নামকরণ করল চীন। এর আগে ২০১৬ সালে প্রদেশটির ছয়টি স্থানের নতুন নামকরণ করেছিল বেইজিং।
ভুটানের ভূখণ্ড দখল চীনের
এর আগে চীন-ভুটান সীমান্ত এলাকায় ভুটানের ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশ করে চীন। শুধু অনুপ্রবেশই নয়, ভূমি দখল করে গত এক বছরে চারটি গ্রামও তৈরি করেছে বেইজিং।
সূত্র মতে, সীমান্ত লাগোয়া ১০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় গত এক বছরের মধ্যে চারটি গ্রাম গড়ে তুলেছে শি জিনপিংয়ের দেশ। ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স ডিট্রেসফা সম্প্রতি একটি উপগ্রহ চিত্র টুইট করে এই তথ্য সামনে এনেছে।
এদিকে, ভুটানের আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় ভারত সরকার নিজেদের দায়বদ্ধ মনে করে বলে বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে নয়া দিল্লি। ২০১৭ সালে এই ডোকলাম নিয়েই ভারত-চীনের সেনাবাহিনীর মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
চীন-ভুটানের বিতর্কিত ভূখণ্ডে বেইজিংয়ের এই জবরদখল ভারতের পক্ষে উদ্বেগজনক বলেই মনে করছে দেশটির বিশ্লেষকরা। যদিও ৪টি নতুন গ্রাম তৈরির বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত এখনও কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
এনডিটিভির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, চীনের সামরিক উন্নয়নবিষয়ক প্রখ্যাত স্যাটেলাইট ছবি বিশেষজ্ঞ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটারে কিছু ছবি প্রকাশ করেছেন।
ছবিযুক্ত পোস্টটিতে বলা হয়, গত এক বছরে ভুটান সীমান্তের ভেতরে একাধিক চীনা গ্রাম ও বসতি নির্মাণের বিষয়টি স্পষ্ট। প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে গ্রামগুলোর অবস্থান।
চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে কর্মরত এক জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকের প্রকাশ করা ছবিগুলো বিশ্লেষণ করে আরও জানা যায়, ভুটান সীমান্তের ভেতরে দুই কিলোমিটার পর্যন্ত সম্প্রসারিত এসব গ্রাম।
চীন-ভারত সীমান্ত দ্বন্দ্বের কারণ
পাক-ভারত সমীকরণ বদলে গেছে ভারত-চীন সীমান্ত উত্তেজনায়। আর এর কারণ সাম্প্রতিক বৈশ্বিক ভূরাজনীতি। ভারতের প্রতিরক্ষা প্রস্তুতির বেশিরভাগ হয়ে উঠেছে চীনকেন্দ্রিক।
গত অক্টোবরে ভারতীয় সীমানায় ঢুকে পড়েছিল চীনের সেনা। অরুণাচল প্রদেশে। উত্তেজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ফ্ল্যাগ মিটিংয়ের পর সমস্যা মেটে। লাদাখ, উত্তরাখণ্ডের পর এবার অরুণাচল প্রদেশে ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢুকেছিল চীনের সেনা।
সূত্র মতে, তারা অরুণাচলের তাওয়াংয়ের কাছে লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল (এলএসি) পেরিয়ে ভারতে ঢুকে পড়ে। প্রায় দুইশ চীনা সেনা ঢুকেছিল বলে ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রের খবর। চীনের সেনা একটি বাঙ্কার ভাঙার চেষ্টায় ছিল।
গত বছর পাঁচ মে লাদাখে দুই দেশের সেনার মধ্যে প্রবল সংঘর্ষ হয়। ভারতের অভিযোগ ছিল, চীনের সেনা ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢুকে পড়ে ও এলাকা দখল করে। আর চীন অভিযোগ করেছিল, ভারতীয় সেনা তাদের ভূখণ্ডে ঢুকে পড়েছে।
ভারতের বেশ কিছু সেনার প্রাণ যায়। চীনের সেনাও মারা যায়। লাদাখের উত্তেজনা দীর্ঘদিন ধরে চলে। তারপর ছোটখাট সীমান্ত পার হওয়ার ঘটনা চলছেই।
সম্প্রতি বিশেষ করে পূর্ব লাদাখ ও ভুটান–তিব্বত লাগোয়া অরুণাচল সীমান্তে, যেখানে চীন ক্রমাগত ভারতীয় সেনাদের চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। আর এর কারণ চীনের সাম্প্রতিক কয়েকটি পদক্ষেপ।
গত ২৩ অক্টোবর চীনের সংসদে নতুন স্থলসীমান্ত আইন পাস হওয়ার পর ভারত প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি। চীনের অভিসন্ধির প্রতি ভারতের সন্দিহান হওয়ার প্রথম লক্ষণ ছিল দোকলাম। ২০১৭ সালের জুনে চীন–ভুটান–ভারত সীমান্তের দোকলামকে কেন্দ্র করে চীনের তৎপরতার পর থেকে প্রতি বছরই চীন সংলগ্ন সীমান্ত নিয়ে ভারতকে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে।
দোকলামের পর ভারত–চীন সেনারা জড়িয়ে পরে পূর্ব লাদাখের গালওয়ানের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে। ২০২০ সালের সেই সংঘাতের পর বারবার সীমান্তে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে।
চীন কিছুদিন পরপর প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর বিভিন্ন এলাকায় নতুন নতুন দাবি জানিয়ে আসছে। অরুণাচল প্রদেশে ভারতীয় নেতাদের আসা যাওয়াকে কেন্দ্র করে আনুষ্ঠানিক আপত্তি জানিয়েছে দেশটি।
সবচেয়ে বড় কথা, সেনাপর্যায়ে ১৩ দফা বৈঠক সত্ত্বেও পূর্ব লাদাখের বিবাদ অমীমাংসিত রেখেছে বেইজিং।
এই পরিস্থিতিতে সাম্প্রতিক দুটি ঘটনা উদ্বেগ বাড়িয়েছে। দুটি ঘটনাই ঘটেছিল অক্টোবর মাসে। প্রথমটি মাসের মাঝামাঝি। এ সময় চীন ভুটানের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধ মীমাংসার জন্য সমঝোতা চুক্তি সই করে। ভারতের সঙ্গে ভুটানের নিরাপত্তাসংক্রান্ত চুক্তি রয়েছে।
ভুটানের সঙ্গে সীমান্ত চুক্তি করার মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয় যে, ভারতকে বাদ দিয়ে চীন এখন ভুটানের সঙ্গে সরাসরি সীমান্তসংক্রান্ত বিরোধ মিটিয়ে ফেলতে চাইছে।
এই চুক্তি সইয়ের ১৫ দিন না যেতে চীনা সংসদে পাস হয়েছে স্থলসীমান্ত আইন। এই আইন সীমান্তবর্তী এলাকায় চীনা লাল ফৌজকে প্রবল ক্ষমতাধর করে তুলবে। এই আইনের ফলে চীনা সেনাবাহিনী সীমান্তবর্তী এলাকায় সেনা অবকাঠামো উন্নয়ন ত্বরান্বিত করবে।
প্রতিরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নতুন করে তৈরি করবে। সীমান্ত গ্রাম গড়ে তুলবে (তিব্বতে ইতিমধ্যেই ৬০০ এমন গ্রাম তৈরি হয়েছে) এবং সেই গ্রামবাসীদের প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দেবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৫০
আপনার মতামত জানানঃ