প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ফিলিস্তিনিরা নিজেদের মাটিতে নিজেরাই পড়ে পড়ে মার খাচ্ছে দখলদার ইসরায়েলি ইহুদিদের হাতে। সঙ্গে দীর্ঘ থেকে আরও দীর্ঘ হচ্ছে লাশের মিছিল। মিছিল চলছে এখনো; লাশের স্তূপও জমছে এখনো। অথচ ইসরায়েল ও তার দোসর যুক্তরাষ্ট্রের খবরদারি ঠিকই আছে গোটা বিশ্ব জুড়ে।
একসময় আজকের এই ফিলিস্তিন ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের (সুলতানদের গৌরবময় শাসন) অধীন। আরব মুসলিমরা ছিল এর সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী। উনিশ শতকের শেষভাগে ইহুদিবাদী আন্দোলন দানা বাঁধলে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা, বিচ্ছেদবেদনায় কাতর-অস্থির ইহুদিদের নজর পড়ে এ আরব ভূখণ্ডে।
ধীরে ধীরে বিশ্বের এপ্রান্ত, ওপ্রান্ত থেকে ইহুদিরা জড়ো হয়ে এখানে বাসা বাঁধতে থাকে। এরপর গত শতকের গোড়ার দিকে অটোমান সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়লে সুযোগের সদ্ব্যবহার করে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, হাঙ্গেরিসহ ইউরোপের প্রভাবশালী প্রায় সব শক্তি।
নিজেদের স্বার্থ হাসিলে অটোমানদের বিরুদ্ধে তারা লাগিয়ে দেয় আরবদের। একপর্যায়ে অটোমান সাম্রাজ্যের পতন হয়। ফিলিস্তিনের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে ব্রিটিশরা। ১৯১৭ সালে তারা ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জাতীয় আবাসস্থল প্রতিষ্ঠায় সমর্থন দেয়। সেই থেকে ফিলিস্তিনের বুকে স্থায়ীভাবে শুরু ইসরায়েল নামের দুষ্টক্ষতের বীজ বপন।
ফিলিস্তিনের গাজা থেকে দুই মাইল উত্তরে কিবুটস এলাকা। এখানে ১৯৩০’র দশকে পোল্যান্ড থেকে আসা ইহুদীরা কৃষি খামার গড়ে তুলেছিল। ইহুদিদের পাশেই ছিল ফিলিস্তিনী আরবদের বসবাস। সেখানে আরবদের কৃষি খামার ছিল। তারা কয়েক শতাব্দী ধরে সেখানে বসবাস করছিল।
সে সময় মুসলমান এবং ইহুদীদের মধ্যে সম্পর্ক মোটামুটি বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু ১৯৩০’র দশকে ফিলিস্তিনীরা বুঝতে পারলো যে তারা ধীরে-ধীরে জমি হারাচ্ছে। ইহুদিরা দলে-দলে সেখানে আসে এবং জমি ক্রয় করতে থাকে।
ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার সময় প্রায় সাত লাখের মতো ফিলিস্তিনী বাস্তু-চ্যুত হয়েছে। তারা ভেবেছিল দ্রুত সমস্যার সমাধান হলে তারা বাড়ি ফিরে আসতে পারবে। কিন্তু ইসরায়েল তাদের আর কখনোই বাড়িতে ফিরতে দেয়নি।
পরে বেশ কয়েকবার ইহুদিদের সঙ্গে লড়াই বেধেছে আরবদের। তাতে সুবিধা করতে পারেনি আরবরা। ব্রিটিশ ও ইহুদি জোটের বাড়াবাড়ি মাত্রা ছাড়ালে ১৯৩৬ সালে তাদের দখলদারির বিরুদ্ধে শুরু হয় আরব বিদ্রোহ। নির্মমভাবে দমন করা হয় বিদ্রোহ। তাতে নিহত হয় কয়েক হাজার আরব।
ব্রিটিশ শাসক ও ইহুদিদের সঙ্গে আরবদের বৈরিতা ক্রমেই আরও বাড়তে থাকে। একসময় ফিলিস্তিন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ালে এর ওপর থেকে কর্তৃত্ব তুলে নেয় ব্রিটিশরা।
১৯৩৯ সালের মাঝামাঝি ব্রিটেনের সরকার একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে যেখানে বলা হয়েছিল পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য পঁচাত্তর হাজার ইহুদি অভিবাসী আসবে ফিলিস্তিনী ভূখণ্ডে। অর্থাৎ সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়েছিল।
ব্রিটেনের এ ধরনের পরিকল্পনাকে ভালোভাবে নেয়নি ইহুদিরা। তারা একই সাথে ব্রিটেন এবং হিটলারের বিরুদ্ধে লড়াই করার পরিকল্পনা করে। তখন ৩২ হাজার ইহুদি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়। সেখান থেকে সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে ইহুদি সৈন্যরা ব্রিটেন এবং আরবদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের বাহিনীর দ্বারা লাখ-লাখ ইহুদি হত্যাকাণ্ডের পর নতুন আরেক বাস্তবতা তৈরি হয়। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর যেসব ইহুদি বেঁচে ছিলেন তাদের জন্য জন্য কী করা যায় সেটি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।
তখন ফিলিস্তিনী ভূখণ্ডে ইহুদীদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা আরো জোরালো হয়। আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান ইসরায়েল রাষ্ট্রের পক্ষে জোরালো অবস্থান তুলে ধরেন।
ট্রুম্যান চেয়েছিলেন হিটলারের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া এক লক্ষ ইহুদিকে অতি দ্রুত ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে জায়গা দেয়া হোক। কিন্তু ব্রিটেন বুঝতে পারছিল যে এতো বিপুল সংখ্যক ইহুদিদের ফিলিস্তিনী ভূখণ্ডে নিয়ে গেলে সেখানে গৃহযুদ্ধ হবে।
এরপর ফিলিস্তিনদের ভাগ্য নির্ধারণের ভার ছেড়ে দেয় জাতিসংঘের ওপর। যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ববলয়ে থাকা জাতিসংঘও ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর ফিলিস্তিনকে দুভাগ করে ইহুদি ও আরবদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের পক্ষে ভোট দেয়।
এভাবেই ইউরোপ-আমেরিকার নীলনকশায় ফিলিস্তিনের বুক চিরে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয় ভবঘুরে ইহুদিদের। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইহুদি নেতারা একতরফাভাবে ইসরায়েল রাষ্ট্রের ঘোষণা দেন।
জাতিসংঘের যে অন্যায্য প্রস্তাব অনুযায়ী ইহুদিবাদী ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠা হয়েছে, সেই প্রস্তাব মানলেও ফিলিস্তিনিদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সাত দশক পর এখন ইসরায়েল বিশ্বের শুধু পারমাণবিক শক্তিধর দেশই নয়; বিশ্বমোড়ল যুক্তরাষ্ট্রের ওপর প্রভাব খাটানো দেশগুলোরও একটি সে।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অন্য মিত্রদের প্রত্যক্ষ মদদে ইসরায়েল এখন জ্ঞান-বিজ্ঞান, চিকিৎসা, অস্ত্রসহ সব খাতে একরকম অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্যাতন, নিপীড়ন, দখলদারি ও অস্ত্রবাজিও।
যুক্তরাষ্ট্রের আশকারায় ইসরায়েলের ঔদ্ধত্য, দৌরাত্ম্য বর্তমানে এতটাই যে ৭৩ বছর আগে বইতে শুরু করা ফিলিস্তিনে রক্তগঙ্গা বন্ধ হয়নি আজও। এই সময়ে আরব সাগরে অনেক পানি বয়ে গেছে, এর চেয়ে বেশি বয়ে গেছে ফিলিস্তিনিদের কান্না আর রক্ত। তবে আর কত রক্ত ঝরলে সেই গঙ্গার প্রবাহ বন্ধ হবে, সেটি যে অজানাই রয়ে গেল আজও।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫১০
আপনার মতামত জানানঃ